মিনার রশিদ
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এক ধাপ নেমে গিয়ে বারোতম হয়েছে। এটুকু শুনেই আমরা বহুত খুশি! আমরা সব সময় সব কিছু সোজাভাবেই দেখি। মাঝে মাঝে কিছু জিনিস যে উল্টিয়ে দেখতে হয়, সেই জরুরি কথাটি ভুলে যাই! আমাদের চিন্তা জগতের এই গলদটি দিয়েই টিআইবি/সিপিডি বলয়ের ২০/২২ জন সুশীল আমাদেরকে তাদের ইচ্ছেমত হাসায়, কাঁদায়, ক্ষেপায় আবার ইচ্ছেমতই ঘুম পাড়িয়ে রাখে। এরাই আমাদের কাউকে অগ্রসর চিন্তার মানুষ বানায়, কাউকে অনগ্রসর, আনকুথ খেতাব দেয়। এরাই ঠিক করে দেয় কাদের দেশপ্রেম টইটুম্বর আর কাদের দেশপ্রেম একদম নেই!
এরা এদের ইন্টেলেকচুয়াল করাপশন বা বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার মাধ্যমে সত্য- মিথ্যা, ন্যায়- অন্যায় মাপার আমাদের সেন্সরগুলোকে নষ্ট বা বিকলাঙ্গ করে ফেলেছে! কোন ইস্যু নিয়ে আমরা কতটুকু চেঁচামেচি করব - একটা জায়গায় বসে এরা এগুলোও ঠিক করে দেয়!
এদের ইন্ধনেই আমরা দুই কোটি টাকার পদ্ধতিগত ত্রুটি দেখে ক্ষেপে যাই আবার বছরে লাখ কোটি টাকার উপরে মুদ্রা পাচার দেখেও না দেখার ভাণ করি। এক ক্যাশিয়ার এক লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নয় ছয় করলেও তাকে পি-নাট বলে গণ্য করি! ফি-বছর বাজেটের এক তৃতীয়াংশ স্রেফ লুটপাট হলেও তাকে উন্নয়ন বলে গণ্য করি! এদের কল্যাণেই সারা দেশটি খাওয়া বা জয়বাংলা হলেও এখনও সেই হাওয়া ভবনের নাম শুনে আঁতকে উঠি!
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক ২০০১ সালে যে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়েছিল তার চেয়ে আজকের বারোতম স্থান অধিকারী হিসাবে বাংলাদেশের দুর্নীতি কি আসলেই কম? গত পনের বছরে এত দুর্নীতি হলো কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল একবারও চ্যাম্পিয়ন বানালও না - এই প্রশ্নটি আমরা কেউ তুললাম না। কিন্তু ডোনারদের ক্ষুদ-কুড়ার প্রবাহ অব্যাহত রাখতে গিয়ে যৎ- সামান্য সত্য কথা লিখেছে সেটুকু প্রচার করেই আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি। মনে করেছি, এতেই বুঝি ফ্যাসিবাদের মসনদ তছনছ হয়ে পড়ল। অথচ এই টিআইবি/সিপিডিরাই যে ফ্যাসিবাদকে এনেছে এবং এখনও টিকিয়ে রেখেছে- সেই কথাটি বেমালুম ভুলে যেতে বসেছি!
২০০১ সালে বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে টিআইবির ইফতেখার দারুণ মওকাটি মারে! কারণ এই হিসাব বা আমলনামাটি ছিল আগের বছরের, যখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামীলীগ! অর্থাৎ ইফতেখার মিয়া এখানে উদোর পিণ্ডিটি চমৎকারভাবে বুধোর ঘাড়ে বসিয়ে দিলেন! ইফতেখারদের সেই বিশেষ তোহফাটি আওয়ামী চাপাবাজেরা এমনভাবে প্রয়োগ করে যে স্বল্পভাষী বিএনপি নেতারা আসল কথাটি আর খুলে বলতে পারেন না। ২০০১ সালে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা ছিল অত্যন্ত হিসাব করা ইফতেখারদের একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ। সেই তকমাটি দিয়েই মূলতঃ দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এক-এগারো নামক ষড়যন্ত্রের বীজটি বপন করা হয়!
কাজেই দুর্নীতিতে ইফতেখাররা আমাদেরকে চ্যাম্পিয়ন বানাবেন নাকি আরেকটু আরামদায়ক পজিশনে রাখবেন সেটা নির্ভর করে ইফতেখারদের দেশীয় পছন্দ-অপছন্দের উপর।
ইফতেখার মিয়াদের টিআইবি ছাড়াও আরও অনেক গ্লোবাল বডি সৃষ্টি হয়েছে। সেই সব রিলায়েবল সূত্র থেকে সবাই জানতে পারছি যে এই দেশ থেকে গত ১৫ বছরে গড়ে পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা বা দশ বিলিয়ন ডলার! প্রতিবছর বাজেটের এক তৃতীয়াংশ অপচয় বা স্রেফ লুট হচ্ছে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হয় সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ অথচ মানের দিকে এসব রাস্তাঘাট এশিয়াতে শুধু নেপালের আগে। রাজকোষকে নিজের বাপের সিন্ধুক মনে করে বিলিয়ন ডলার তুলে নেওয়া হয়। এক ইসলামী ব্যাংক থেকেই লোপাট করা হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। ২০০১ সালে যখন চ্যাম্পিয়ন বানানো হয় তখন দুর্নীতির অংক ছিল মাত্র এক বা দুই ডিজিটের কোটি টাকা- সর্বোচ্চ শত কোটি টাকা। এখন তা চার থেকে ছয় ডিজিটের কোটি টাকা মানে হাজার বা লাখ কোটি টাকা। তারপরেও আমরা দুর্নীতিতে এখনও চ্যাম্পিয়ন না হয়ে বারোতম থাকলাম কেমন করে?
এটিই ইফতেখার ম্যাজিক! এটিই সুলতানা কামাল (টিআইবির প্রাক্তন চেয়ার পার্সন) ম্যাজিক!
তবে জনগণ যাতে তাদের প্রকৃত চেহারাটি চিনে ফেলতে না পারে তজ্জন্যে- আমি খাড়ায়া পড়মু, আফনে বসাইয়া দেবেন, এই ধরণের কিছু খেলা খেলতে হয়! মাঝে মাঝে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী বা নেতাদের সাথে বাকচিতে জড়িয়ে নিজেদের নিরপেক্ষতা যে অত্যন্ত সহীহ- সেটা বুঝিয়ে দেন। হাছান মাহমুদের সাথে এমনই এক বাকচিতে বলে দেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে, টিআইবি এ কথা বলেনি।
রেল লাইনের খরচ ছাড়াই ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর খরচ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার উপরে! ইন্ডিয়ার ভূপেন হাজারিকা সেতু সহ পৃথিবীর আরও অন্যান্য জায়গার সেতুর খরচ তুলনা করলে এটিকে অস্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু ইফতেখারুজ্জামান এখানে দুর্নীতির কোনো গন্ধ খুঁজে পান নাই! কুমারী মেয়ের সাত মাসের পেট নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলেও টিআইবির মেথডলজি বলছে এখনও শতভাগ ভার্জিন। জনগণের খালি চোখে বা সাধারণ অনুভবে যা ধরা পড়ে টিআইবির কথিত মেথডলজিতে তা ধরা পড়ে না! কারণ রেসপন্ডেন্টদের যে স্যাম্পলগুলি নেন তার সবগুলোই বায়াসড।
একারণেই ২০০১ সালের চেয়ে হাজারগুণ দুর্নীতি হলেও এখনও আমরা বারো নম্বরেই আছি, চ্যাম্পিয়ন হতে পারি নাই!
২০১৬ সালে কোনো রাখঢাক না রেখেই এই মিয়াসাব বলেছিলেন, টিআইবি সরকারের সহায়ক শক্তি। এই খুশীর সংবাদটি শিরোনাম করে জানিয়েছিল গোলাম সারওয়ারের দৈনিক সমকাল ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তে। মাঝে মাঝে টিআইবির একটু আধটু খাড়ানো দেখে আমরা এই কথাটি ভুলে যাই।
দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও নিরপেক্ষ এই মিয়াসাব বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন নেই।
কিন্তু কোন জিনিসটা বেশি প্রয়োজন তা ঠিকঠাক মতই জানিয়ে দিয়েছেন। বিএনপির ২৭ দফা ঘোষণায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলা হলেও তাদের নেতৃত্বের শীর্ষে আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্তদের রাখাকে ‘সাংঘর্ষিক ও নৈতিক অবক্ষয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন যুগের এই যুধিষ্ঠির!
জাতির এই ‘মে’সাব’ (মিয়াসাবের সংক্ষিপ্তরূপ) অনেক সময় ঘুমিয়ে কাটান। তাই অনেক কিছু তার চোখে ধরা পড়ে না। যে আদালতের মাধ্যমে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে এই সাজা দেওয়া হয়েছে খোদ সেই আদালতের গ্রহণ যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ইউএস কান্ট্রি রিপোর্ট সহ দেশ বিদেশের নামীদামী অনেক সংস্থা। সরকারের মনের মত রায় না দেওয়ায় সিটিং প্রধান বিচারপতিকে আক্ষরিক অর্থেই লাথি দিয়ে দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছে! বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে একটি দুর্নীতির মামলা থেকে বেকসুর খালাস দেওয়ায় জাজ মোতাহার হোসেনকে জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হয়েছে। বিচারপতি এস কে সিনহা এবং জাজ মোতাহার হোসেনের এই পরিণতি দেখার পর দেশের মধ্যে আর কোন বিচারকের কি সাহস হবে সরকারের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার? ‘মেসাব’ কি বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলবেন?
বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ড সম্পর্কে ইউএস কান্ট্রি রিপোর্টের একটি লাইন - “International and domestic legal experts commented on the lack of evidence to support the conviction, suggesting a political ploy to remove the leader of the opposition from the electoral process.”
পোল্যান্ড থেকে পিএইচডি করা জাতির এই ‘মেসাব’কে (শ্বশুর শ্রেণীর মুরব্বিদের সমীহ করে মেসাব ডাকা হয়) কি এই ইংরেজি বাক্যটি অনুবাদ করে দিতে হবে?
নিরপেক্ষ এই মেসাবদের আরেকটি কৌশল হলো- False Equalization, বা মিথ্যা সমতাকরণ! আওয়ামীলীগকে বিশেষ সুবিধা দিতে বা কোনো আওয়ামী অপকর্মকে ঢাকতে আওয়ামীলীগের সঙ্গে বিএনপির কল্লাও ঢুকিয়ে দেন! সবাই যখন হিরো আলম সম্পর্কে ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য নিয়ে কঠোর সমালোচনা শুরু করেছেন তখন এই আওয়ামী দরদী মির্জা ফখরুলের মন্তব্যেও দারুণ কিছু আবিষ্কার করে ফেললেন!
এই নিরপেক্ষ সমতাকারী বলেন, “গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘হিরো আলম এখন জিরো হয়ে গেছে। হিরো আলমকে বিএনপি নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছে। তারা সংসদকে ছোট করার জন্য হিরো আলমকে প্রার্থী করেছে।’ উল্টোদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এই আওয়ামী লীগ হিরো আলমের কাছেও কতটা অসহায়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে জিততে হয়।’ “দুই ক্ষেত্রেই সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলমকে অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্যসূচক বিবেচনায় পরস্পরকে আক্রমণ করেছেন দুই নেতা।”
'অমুক অত্যন্ত নিরীহ/সহজ/সরল মানুষ' এটা বলা আর অমুক সংসদে আসলে সংসদ ছোট হয়ে যাবে- এই দুটির ভাব কি এক হলো?
এই হিরো আলমকে কারা নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল? কাদের উচ্চারণে অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে?
হিরো আলম একজন সহজ, সরল নিরীহ মানুষ। তার কাছেও আওয়ামী লীগ অসহায় হয়ে পড়েছে। বর্ণনার প্রয়োজনে কারও সঠিক সামাজিক অবস্থান তুলে ধরলে কি তাকে অপমান করা হয়? মির্জা ফখরুল এখানে হিরো আলমের প্রতি কোথায় অবজ্ঞাটি দেখালেন?
আমরা জানি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারটির নাম ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে টিআইবি। মূল সংগঠনটির একটি ভালো উদ্দেশ্য থাকলেও এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারটিকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে ইফতেখার ও সুলতানা কামাল গং! শুধু হীন রাজনৈতিক স্বার্থ নয়- হীন ব্যক্তি স্বার্থেও প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহৃত হচ্ছে! ড. ইউনূসকে বয়সের কারণ দেখিয়ে তার ব্রেইন চাইল্ড গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই ইফতেখারের রিটায়ারমেন্ট বয়স অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনও বহাল তবিয়তে আছেন।
আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটিকে সূক্ষ্মভাবে নিজেদের চেতনায় ব্যবহার করে গেছেন অথবা এখনও করে যাচ্ছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল। এর ট্রাষ্টিবোর্ডটি সর্বদা একই ঘরানার সুশীল দিয়ে গঠন করা হয়। বর্তমান ট্রাষ্টিবোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে ট্রেজারার, সদস্যসমূহ কেহই এই চেতনার বাইরে নন। ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনাম এর ট্রেজারার। আমাদের দিপু মনির হাসবেন্ড ট্রাষ্টি বোর্ডের একজন মেম্বার! আবার মাহফুজ আনামের স্ত্রী শাহীন আনাম মানুষের জন্যে ফাউন্ডেশনের কর্ণধার, সেটার গভর্নিং বডির মেম্বার এই ইফতেখারুজ্জামান। অর্থাৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইনারাই সব।
এদের প্রতি আরেকটু নজর দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করতে না পারলে এই জাতির মুক্তি কোনোদিন হবে না!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন