ড. ফারুক আমিন
ব্রিটেনের সরকারী গণমাধ্যম বিবিসি অর্থাৎ ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন গত ১৭ জানুয়ারী ২০২৩ তারিখে একটি প্রামাণ্যচিত্রের প্রথম পর্ব সম্প্রচার করে, যার শিরোনাম ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’। বাংলায় অনুবাদ করলে বলা যায় ‘ভারত: মোদী প্রশ্ন’। প্রামাণ্যচিত্রটির দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ হয় এক সপ্তাহ পরেই, ২৪ জানুয়ারী। প্রতিটি পর্বের দৈর্ঘ্য প্রায় এক ঘন্টা, এবং দুটি পর্বেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও ধারাবিবরণীর মূল চরিত্র ছিলেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতা নরেন্দ্র দমোদরদাস মোদী।
আজ থেকে দুই দশক আগে বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর গুজরাটের কসাই হিসেবে আন্তর্জাতিক কুখ্যাতি অর্জন করা নরেন্দ্র মোদীর অতীত ও বর্তমানকে ব্যবচ্ছেদ করা দুই পর্বের এ অনুষ্ঠান প্রচারের পর অন্য আর দশটা অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রের মতোই হয়তো এটি আরেকটি মোটামুটি উল্লেখযোগ্য কিংবা অনুল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান হিসেবে থেকে যেতে পারতো। কিন্তু ভারত সরকারের চরম প্রতিক্রিয়া ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ যেন সুপ্ত আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে তর্ক-বিতর্কের দাবানল জ্বালিয়ে দিয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনটির দ্বিতীয় বা শেষ পর্বের শেষে এসে বলা হয়েছিলো ভারতে এখন বাকস্বাধীনতা বিপন্ন। ভারত সরকারের তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া এবং এমনকি ইন্টারনেট থেকেও ভিডিওগুলো সরিয়ে দেয়ার মরণপণ প্রচেষ্টা এখন সেই সমালোচনাতে বাড়তি একটি প্রমাণ যোগ করেছে। অন্যদিকে বিজেপির সমর্থক শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও ভারতীয় জনগণ সমস্বরে প্রোপাগান্ডা এবং কলোনিয়াল মাইন্ডসেটের অভিযোগ তুলে এই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করতে এখন সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ইউটিউব এবং টুইটার থেকে অসংখ্য পোস্ট সরানো হয়েছে। খোদ বিবিসির ওয়েবসাইটে অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য জিওলোকেশন-রেস্ট্রিকশন আরোপ করা হয়েছে যার ফলে ব্রিটেনের বাইরে অন্য কোথাও থেকে দেখা যাচ্ছে না।
তথাপি কৌতূহলী দর্শকদের জন্য ভিপিএন, টরেন্ট, হোয়াটসএপ, বিভিন্ন ক্লাউডের মাধ্যমে ডাউনলোড লিংক ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্ররা প্রতিবেদনটির গণ-প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে তখন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে হামলা চালিয়ে প্রদর্শনী অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সুতরাং আগ্রহী পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে কি আছে দুই পর্বের এই প্রতিবেদনে? কেন ভারত সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে এই ডকুমেন্টারির প্রচার থামানোর জন্য? ডকুমেন্টারিতে উপস্থাপিত তথ্যগুলো কতটুকু সত্য হতে পারে? ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশ ও বর্তমানে অলিখিত করদরাজ্যে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের মানুষদের জন্য এই ডকুমেন্টারিটি কেমন প্রাসঙ্গিক?
এ লেখার প্রথম পর্বে কেবলমাত্র বিবিসি ডকুমেন্টারিটির দুই পর্বের নিরেট বর্ণনা তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে। যারা দেখতে পারেননি কিংবা দেখার পরও পড়ার মাধ্যমে আরো জানতে আগ্রহী, এই লেখাটি সম্ভবত তাদের কাজে আসবে। পরবর্তী পর্বে আশা করছি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের অবকাশ পাওয়া যাবে।
অনুষ্ঠানটির প্রথম পর্বের শুরুতে দেখা যায় ভারতের কোন এক শহর, সম্ভবত গুজরাটের, রাতের দৃশ্য। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে হিন্দুত্ববাদী এক নেতার বক্তব্য। “এখানে হয় নিজে মরার জন্য তৈরী হও, আর না হলে মারার জন্য তৈরী হও। এছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। প্রতিটি পুলিশকে, প্রতিটি সৈনিককে, প্রতিটা নেতাকে, প্রত্যেক হিন্দুকে বিশুদ্ধি অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।”
এই বক্তব্য প্রথমেই বুঝিয়ে দেয় বর্তমান ভারতের বাস্তবতা। হিন্দু-মুসলিমের ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক সহিংস সংঘাত যে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গে পরিণত হয়েছে। দুইটি পর্ব জুড়ে প্রায় ত্রিশ জন মানুষের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গের সূত্র ধরে। একই সাথে এও বলা হয় যে ত্রিশ জনেরও বেশি মানুষ এই প্রতিবেদনটি তৈরির সময় নিজেদের নিরাপত্তাহানির আশংকায় কোন সাক্ষাতকার দেয়া থেকে বিরত ছিলেন। পাশাপাশি ভারত সরকারের কাছে প্রতিক্রিয়া ও মতামত জানতে চাওয়া হলেও তারা সরকারীভাবে কোন মন্তব্যের মাধ্যমে অংশ নেয়া থেকে বিরত ছিলো।
ভারতে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থার চলতি উত্থানের আলোচনা শুরু হয় আলিশান জাফরী নামে ভারতীয় এক তরুণ সাংবাদিকের কথা দিয়ে। তিনি বর্তমান ভারতে হেইট ক্রাইম এবং উগ্রপন্থার উদ্ভাবনের ঘটনাগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রথম ঘটনা ছিলো ২০০২ সালের ট্রেনে আগুনের ঘটনায় ঊনষাট জন হিন্দু তীর্থযাত্রী এবং পরবর্তী তিনদিনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ, যাদের বেশিরভাগ ছিলো মুসলিম, এদের হত্যাকান্ডের ও দাঙ্গার বর্ণনা। ব্রিটিশ নাগরিক ও তখন আঠারো বছর বয়স কিশোর ইমরান দাউদ তার দুই চাচা এবং এক প্রতিবেশী সহ সে সময় ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলো। আগ্রায় তাজমহল দেখে গুজরাটে ফেরার পথে সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তার দুই চাচা শাকিল দাউদ ও সাইয়েদ দাউদ এবং প্রতিবেশী মোহাম্মদ আসলামকে রাস্তার উপর হিন্দু জনতা নির্মমভাবে হত্যা করে।
সে সময় ভারতে বিবিসির সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা জিল ম্যাকগিভারিং তার কাজের স্মৃতিচারণ করে। তার প্রচারিত প্রতিবেদনের ফুটেজও দেখানো হয় যেখানে তিনি পুলিশের নির্লিপ্ততা এবং ভয়াবহ দাঙ্গা ও খুনাখুনির মাঝেও কোন ব্যবস্থা না নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা বলেছিলেন।
এই ট্রেনে আগুন এবং তৎপরবর্তী দাঙ্গার সময় গুজরাটের চিফ মিনিস্টার ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। রাজ্যশাসিত পদ্ধতির সরকারে চিফ মিনিস্টারের হাতেই মূলত রাজ্যের মূল ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকে। বিভিন্ন সাক্ষাতকার, গবেষণা ও প্রতিবেদনে বারবার উঠে এসেছে একটি অভিযোগ। মোদী সে সময় পুলিশকে বলেছিলেন কোন ব্যবস্থা না নিয়ে চুপ থাকার জন্য যেন বিক্ষুব্ধ হিন্দুরা তাদের রাগ মেটাতে পারে। এটিই মূলত মোদীর বিরুদ্ধে মুল অভিযোগ, ক্রিমিনাল কন্সপিরেসির মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিলেন।
ইমতিয়াজ পাঠান নামে একজন, তখন অল্পবয়স্ক শিশু, সাক্ষাতকারে বলেন কিভাবে তার পুরো পরিবার এবং এলাকার অনেকগুলো মুসলিম পরিবার গুজরাটের সাবেক মুসলিম এমপি এহসান জাফরির বাড়িতে দাঙ্গার সময় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
একশরও বেশি মানুষের উপর চালানো নির্মম গণহত্যার পর থেকে সেই বাড়িটি এখন পড়োবাড়ি, পরিত্যক্ত এক দালান। সেই দালানে ঘুরে ঘুরে ইমতিয়াজ দেখাচ্ছিলেন ঠিক কোনখানে এহসান জাফরির টেবিল ছিলো। কিভাবে সেখানে বসে তিনি একের পর এক পুলিশ অফিসার ও সতীর্থ রাজনৈতিক নেতাদেরকে ফোন করছিলেন সাহায্য চেয়ে। সব শেষে এক পর্যায়ে তিনি ফোন করেন রাজ্যের চিফ মিনিস্টার মোদীকে। মোদীর সাথে ফোনালাপের পর তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তারপর তিনি বারান্দায় গিয়ে জমা হওয়া হিন্দু জনতাকে বলেন তোমরা চাইলে আমাকে হত্যা করো কিন্তু মহিলা ও শিশুদেরকে কিছু করো না। সবার নিষেধের পরও তিনি জনতাকে শান্ত করতে নেমে গেলে তারা তাকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে এবং তারপর তারা বাড়িটিতে ঢুকে পড়ে গণহত্যা ও গণ-ধর্ষণের উৎসবে মত্ত হয়। সাক্ষাতকার দেয়া ইমতিয়াজের মা সহ পরিবারের মোট দশজন সদস্য সেদিন নিহত হয়। শিশু ইমতিয়াজ বাড়িটির সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।
ব্রিটিশ নাগরিক শাকিল, সাইয়েদ ও আসলামের হত্যার ফলে ব্রিটেনের সরকার একটি তদন্ত দল পাঠায়। সেই তদন্ত দলের রিপোর্ট আগে কখনো প্রকাশ হয়নি। সে রিপোর্টে বলা হয় পদ্ধতিগত সহিংসতার এই দাঙ্গাতে জাতিগত নির্মূল অভিযানের সব উপাদান দেখা গিয়েছে।
মোদি ও নেতানিয়াহু
দাঙ্গার পরে অনেকে অভিযোগ করে গোধরা অগ্নিকাণ্ডের রাতে তখনকার চিফ মিনিস্টার মোদী পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে এক গোপন বৈঠকে আদেশ দেন হিন্দু দাঙ্গাকারীদেরকে না থামিয়ে বরং পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার জন্য। মোদীর উদ্দেশ্য হলো বিক্ষুব্ধ হিন্দু জনতার ক্রোধ প্রশমনের সুযোগ দেয়া। তিনদিন যাওয়ার পর তিনি পুলিশকে দাঙ্গা থামানোর নির্দেশ দেন, এই তিনদিনের জংলী দাঙ্গায় ততক্ষণে এক হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ধর্ষিতা হয়েছে অসংখ্য নারী, আহত হয়েছে অনেক মানুষ।
দাঙ্গার পর তিনজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির সমন্বয়ে একটি সিটিজেনস ট্রাইব্যুনাল এই ঘটনার তদন্তের চেষ্টা করে। সে তদন্ত কমিটির সামনে মোদীর মন্ত্রীসভার সদস্য ও গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হরেন পান্ডিয়া পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন খোদ মোদী এক গোপন বৈঠকে পুলিশ অফিসারদেরকে ঐ আদেশ দিয়েছিলেন। হরেন পান্ডিয়ার সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অব্যবহিত পরেই প্রাক্তন মন্ত্রী হরেন পান্ডিয়ার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় একটি গাড়িতে, যে হত্যারহস্যের কোন সমাধান আজও হয়নি।
পরবর্তীতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আরেকটি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের সামনে দুইজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা শ্রীকুমার এবং সঞ্জিব ভট্ট সাক্ষ্য দিয়ে মোদীর সেই আদেশের কথা বলেন। এই সাক্ষ্যগুলোকে বাতিল করা হয়। অন্যদিকে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার অপরাধে শ্রীকুমারকে গ্রেফতার করা হয়। ত্রিশ বছরের পুরনো পুলিশ কাস্টডিতে হত্যার এক ঘটনায় জড়িয়ে পুলিশ অফিসার সঞ্জিব ভট্টকে আজীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
একের পর এক ভারতীয় তদন্তে দায়মুক্তির পাশাপাশি মুসলিমবিদ্বেষী ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রচারে মোদী সারা ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মাঝে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। সেই থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে দুইটি নির্বাচনে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিজয় লাভ করেন। গুজরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিলো আমেরিকায় নাইন ইলেভেনের ঠিক পরপর, তখন সারা পৃথিবীজুড়ে মুসলিম বিদ্বেষের বন্যা তার ঘৃণাবাদের সুযোগ প্রসারিত করেছিল। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প ভারত সফরে গিয়ে মোদীর প্রচুর প্রশংসা করেছে।
একসময় গুজরাত হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে যে মোদীর উপর ব্রিটেন ও আমেরিকা নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো, ভিসা বাতিল করেছিলো, তারাই পরবর্তীতে সেসব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে মোদীকে সাদরে গ্রহণ করা শুরু করে। বর্তমান সময়ে ভারত চেষ্টা করে যাচ্ছে মোদীকে একজন আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। মোদী এখন বিশ্বজুড়ে ভারতের প্রতিনিধি, অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরে তিনি হিন্দুত্ববাদের সবচেয়ে সফল নেতা।
বিবিসি ডকুমেন্টারির প্রথম পর্বে মোদীর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের শুরু এবং দল হিসেবে আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বাদে পুরোটা জুড়েই ছিলো গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ।
দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরের ঘটনাবলী দিয়ে। ভারতের একটি রাজ্য গুজরাতের চিফ মিনিস্টার থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মোদী বসেন পুরো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে। মুসলিমবিদ্বেষী রাজনীতির মধ্যমণি মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জাতীয় সংহতির পরিবর্তে বরং ক্রমাগত বিভক্তি ও ঘৃণাবাদের পরিকল্পিত বিস্তার ঘটিয়ে গিয়েছেন। যার পরিণতিতে আজকের ভারত এসে দাঁড়িয়েছে এমন এক অবস্থায় যেখানে জনসংখ্যার প্রায় চৌদ্দ শতাংশ বা বিশ কোটি মুসলমানরা জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যার আশংকায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছে।
দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে বর্ণনা করা হয় আলিমুদ্দীন আনসারীর ঘটনা। ২০১৭ সালে গরুর গোশত বহনের অভিযোগে তাকে রাস্তার উপর গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। একই অভিযোগে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয় মোহাম্মদ আখলাককে। দুইজন নারীকে। গরু রক্ষার এই আন্দোলনকে প্রধানমন্ত্রী মোদী নাম দিয়েছেন পিংক রেভুলিউশন বা গোলাপি বিপ্লব। এই বিপ্লবের অংশ হিসেবে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে গরুর গোশত বহন করা বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে। এই বিপ্লবের বাস্তবায়নে হিন্দু জনতার গণপিটুনিতে এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ৪৪ জন মানুষকে, আহত হয়েও কোন মতে প্রাণে বেঁচে গেছেন ২৮০ জনের বেশি মানুষ।
আলিমুদ্দীন আনসারীকে হত্যার ভিডিওতে স্থানীয় বিজেপি নেতা নিত্যানন্দ মাহাতোকে দেখা যায় আনসারীকে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামাতে। বিপুল প্রতিক্রিয়ার পর মোদী এর নিন্দা করেন এবং মাহাতোকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মোদীর আরেক মন্ত্রী সিনহা তার মামলার সকল খরচ দিয়ে তাকে জামিনে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন। চার বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে, মাহাতো সহ অভিযুক্ত সকল খুনীরা মুক্ত অবস্থাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদী মনোযোগ দেন কাশ্মীর প্রসঙ্গে। ইন্টারনেট, ফোন সহ সব ধরণের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে কাশ্মীরের বিশেষ অবস্থান শীর্ষক আর্টিকেল ৩৭০ সংশোধন করা হয় ভারতীয় সংবিধানে। দ্বিতীয় পর্বে এই সময়কার দমন নিপীড়নের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, মুসলিম বিক্ষোভকারীদেরকে রাতে নির্যাতন করার সময় রুমে মাইক্রোফোন চালু রেখে পুরো গ্রামবাসীকে মাইকে আর্তনাদ শোনানো হতো ভয়ের সংস্কৃতি ও পরিবেশ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। ভারতের বর্তমান বাস্তবতা সাক্ষ্য দেয় এই ভয়ের সংস্কৃতি পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিতে মোদীর নেতৃত্বাধীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এখন অনেকটাই সফল।
এরপর দেখানো হয়েছে ভারতের ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনশিপ বা এনআরসি প্রণয়নের ঘটনা, আসামে যে রেজিস্টারের প্রথম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই রেজিস্টার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছে। যার প্রতিবাদে পুরো ভারতজুড়ে, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লীতে বিপুল বিক্ষোভ হয়েছে। আসামে নাগরিকত্ব আইনের বলি হয়ে বেআইনী ঘোষণা হওয়া রিকশাচালক নুর মোহাম্মদ ও তাঁর স্ত্রী যাহারা সাক্ষাতকারে বলেছেন কিভাবে তারা গ্রেফতারের পর আঠারো মাস ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী থেকেছেন। দিল্লীর জামিয়া মিল্লিয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্রী সাফুরা বলেছেন বিক্ষোভ করার অপরাধে কিভাবে তাকে গর্ভবতী অবস্থায় গ্রেফতার করে তিহার জেলের নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছিলো। সাফুরা এখন জামিনে মুক্ত আছেন এবং বিভিন্ন ভয়াবহ অভিযোগের মামলার চুড়ান্ত রায়ের অপেক্ষা করছেন।
দ্বিতীয় পর্বের একদম শেষদিকে এসেছে গত বছর জুন মাসে মহানবী সা. কে অবমাননা করে বিজেপি মুখপাত্র নুপুর শর্মার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতার ঘটনা। উপসংহারে বলা হয় বর্তমান ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটা নিচে নেমেছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি কতটা বিপন্ন হয়েছে। গুজরাটের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সাক্ষাতকারে মোদী বলেছিলেন, মিডিয়াকে আরো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিলো। মোদীর প্রধানমন্ত্রীত্বের অধীনে বর্তমান ভারতে সেই মিডিয়া দীর্ঘ পরিকল্পনার ও কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে অনেকটাই মোদীর এবং বিজেপির নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
সাংবাদিক আলীশান জাফরী, ব্রিটিশ অধ্যাপক ক্রিস্টোফি জেফ্রিলট, বিবিসি সাংবাদিক জিল ম্যাকগিভারিং, প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায়, সাংবাদিক নীলঞ্জন মুখোপধ্যায়, প্রাক্তন ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি জ্যাক স্ট্র, সাংবাদিক সিদ্ধার্থ ভরদারাজন, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার চেয়ার আকার পাটেল সহ অনেকেই এই ডকুমেন্টারির দুই পর্বে সাক্ষাতকার দিয়েছেন, নানা প্রসঙ্গে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এদের মাঝে অনেকেই বর্তমান উগ্র হিন্দুত্ববাদ আচ্ছাদিত ভারতে নিভু নিভু করে জ্বলতে থাকা বিবেকের আলো হিসেবে পরিচিত।
এছাড়াও বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কথা বলেছেন ফাদার সেড্রিক প্রকাশ, নিহত শাকিল ও সাইয়েদের ভাতিজা ইউসুফ দাউদ, এহসান জাফরী এমপির বাড়িতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ইমতিয়াজ পাঠান, পুলিশ অফিসার সঞ্জিব ভট্টের মেয়ে ড. আকাশী ভট্ট, আলীমুদ্দিন আনসারীর স্ত্রী মরিয়ম, দিল্লী পুলিশের পিটুনিতে নিহত ফায়জানের সাথে একসাথে মার খেয়ে আহত হওয়া ওয়াসিম সহ বেশ কয়েকজন।
অন্যদিকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রাক্তন এমপি স্বপন দাসগুপ্ত, বিজেপির ছাত্রসংগঠনের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় নেতা ও বর্তমানে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. স্বদেশ সিং, বিজেপির নেতা ও মোদীর সমালোচক সুব্রামানিয়ান স্বামী তাদের সাক্ষাতকারে বিজেপির নানা সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষী কাজ এবং কর্মসূচিকে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে সমর্থন করে গিয়েছেন এবং মোটাদাগে তারা মোদীকে ভারতের যোগ্য নেতা হিসেবেই তুলে ধরেছেন।
দুই পর্বের ডকুমেন্টারিটি দেখলে একজন সচেতন পাঠকের মনে হতে পারে সমস্ত ঘটনাগুলোই তো জানা, নতুন কিছু নেই। তবে এসব ঘটনাকে গুছিয়ে এনে এক ফ্রেমে ধারাবাহিকভাবে গ্রন্থিত করার প্রামাণিক মূল্য নিঃসন্দেহে রয়েছে। বর্তমান ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে বেশিরভাগ মানুষই বই পড়ার পরিবর্তে ডকুমেন্টারি ভিডিও দেখে চলমান পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে।
যে সময় ভারত প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে গুজরাটের কসাই মোদীকে বিশ্বনেতা হিসেবে তুলে ধরার জন্য, এমন এক সময়ে এই ডকুমেন্টারি পুরনো স্মৃতির ক্ষত তাজা করে মোদীর সেই ভাবমূর্তির উপর এক পরত আলকাতরা বুলিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক চিন্তা লালন করা বিজেপির সরকার এর জবাব দেয়া কিংবা উপেক্ষা করার বদলে বরং নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে দমনের চেষ্টা শুরু করেছে। যে কোন ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক মতাদর্শের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াতেই দমন করার চেষ্টা অবলম্বন করা।
* ব্যবহৃত ছবিগুলো ফ্লিকার থেকে ক্রিয়েটিভ কমনস লাইসেন্সের আওতায় সংগৃহীত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন