ড. মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম
"শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড" কথাটা সত্য। তবে এই মেরুদণ্ড খাড়া হবে নাকি জোড়া হবে, সেই মেরুদন্ডের উপর ভর করে আপনার "উন্নত মম শির" হবে নাকি অবনত অবদমিত "নম নম শির" হবে সেটা নির্ভর করবে জাতীয় শিক্ষানীতির উপর।
এটা সবচেয়ে ভালো বুঝেছিলেন সম্ভবত ইংরেজরা। উপনিবেশিক আমলে তাদের "সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং" এর অংশ হিসেবে তারা যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন তার উদ্দেশ্য ছিলোঃ "এমনসব জনগোষ্ঠী তৈরি করা যারা শুধু রক্ত এবং বর্ণেই হবে ইন্ডিয়ান; কিন্তু তাদের রুচিবোধ, চিন্তা-চেতনা এবং নীতি-নৈতিকতার দিক দিয়ে হবেন পুরো ইংরেজ!" যারা আটশ বছর উপমহাদেশ শাসন করে সংঘাতে লিপ্ত খন্ড খন্ড এলাকা একত্রিত করে গড়েছিলেন এক সুনিপুণ সভ্যতা এবং ইন্ডিয়াকে বানিয়েছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি এবং অসাধারণ নির্মাণশৈলীর কেন্দ্রবিন্দু, এই শিক্ষানীতি দিয়ে শাসক মুসলিম জাতিকে ইংরেজরা মাত্র একশো বছরের মধ্যেই পদানত, নিগৃহীত, নীচুমনা, দুশ্চরিত্রসম্পন্ন এক অনুগত দাশে রুপান্তরিত করতে সক্ষম হন!
সম্প্রতি বাংলাদেশ নামক একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে যে শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে, তা এই একই ধারায় প্রবাহিত। বেশিদূর যাওয়া দরকার নেই। ৭ম শ্রেণী'র ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইয়ের উপরে একটি রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে 'পাঠশালা CBS' গ্রুপে। আমি হুবহু সেটাই (২০ টা পয়েন্ট) এখানে তুলে ধরছিঃ
১। প্রচ্ছদ দেখে প্রথম খটকাটি খেয়েছি। মৌর্য সাম্রাজ্যের আমলের বৌদ্ধ সমাজের পাটলিপুত্র মন্দিরের ছবি। এটা না আমাদের দেশের ইতিহাস সঠিকভাবে রিপ্রেজেন্ট করে, না বর্তমান সমাজ। আমি বলছি না মসজিদের ছবি দিন বা মন্দিরের, দরকার নেই। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট রিপ্রেজেন্ট করে এমন কিছুও দেয়া যেতো। প্রচ্ছদের ময়ূর, পদ্ম ফুল, জবা ইত্যাদি আমাদের জাতীয় পাখি বা ফুলও নয়।
২। বইয়ে চারটি প্রধান অধ্যায়। প্রথমঃ নগর সভ্যতার উত্থান-পতন: দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষের জীবন, অর্থনীতি ও পরিচয়ের রূপান্তর। দ্বিতীয়ঃ সাম্রাজ্যের বিস্তার, নগর-রাষ্ট্র আর বৈচিত্র্য: পরিচয়, ভাষা, জীবনের অবিরাম বদল। তৃতীয়ঃ আঞ্চলিক পরিচয়, চাষাবাদের বিস্তার এবং তৃতীয় নগরায়ণ: যোগাযোগ, মিশ্রণ আর প্রতিযোগিতার পর্ব। চতুর্থঃ সম্পর্ক, মিশ্রণ ও নতুন ধারণা: সুলতানি আমল ও বাংলা। প্রথম তিনটি অধ্যায় মিলে ১০৯ পৃষ্ঠা। আর চতুর্থ অধ্যায়টি মাত্র ১৪ পৃষ্ঠা (১১০-১২৪)।
৩। প্রথম অধ্যায়ের মূল বিষয় হলো উপমহাদেশের আদিম সংস্কৃতি ও সভ্যতা তথা হরপ্পা সভ্যতা। এই সভ্যতার ধর্ম বেদের উপর নির্ভরশীল। তারা খুবই সভ্য আর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছিল। তাদের ছিল অনেক সুন্দর সুন্দর ড্রেইন। সেখান দিয়ে পায়খানা যাওয়া আসা করতো। সকলের সম্মানজনক ভাবে চলতো। সবার ছিল স্বাধীনতা। ছিল বিস্তৃত রাস্তাঘাট, পানি সরবরাহ, ডাস্টবিন, সূক্ষ্ম পরিমাপ পদ্ধতি, শিল্পকলা ইত্যাদি। মূলত তারা ছিল উৎকৃষ্ট এক জনগোষ্ঠী। তাদের ধর্ম বেদের উপর নির্ভরশীল। বেদের প্রকারভেদ নিয়েও বেশ ভালো আলোচনা কয়েকবার এসেছে। এই জনগোষ্ঠী মূলত প্রাকৃতিক কারণে ধীরে ধীরে পতিত হয়েছে।
৪। দ্বিতীয় অধ্যায়ের বিষয় হলো (হিন্দু ও) বৌদ্ধ ধর্ম ও শাসনব্যবস্থা। বৌদ্ধ ধর্ম খুবই ভালো, পরম অহিংসার ধর্ম। গৌতম বুদ্ধের জীবনীর অনেক খন্ডচিত্র (snippet) এখানে সেখানে আছে। আগের অধ্যায়ের মতোই এই অধ্যায়েও এই সমাজের কাঠামোর বিস্তারিত বর্ননা এসেছে। ক্লাস সেভেনের জন্য এত বিস্তারিত আলোচনা কেন জরুরি আমার বোধগম্য হলো না।
৫। তৃতীয় অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে তৎকালীন সভ্যতার নগরায়ন আর ধর্মিয় স্থাপনার চিত্র আর বর্ণনা। ভারত উপমহাদেশে ও বাংলায় শশাংক রাজত্ব। এখানে মুদ্রা, মন্দির, স্থাপনা, ধর্মিয় গ্রন্থ, দেব-দেবীর ছবি, বৌদ্ধ বিহার আর মন্দিরের ছবিতে সয়লাব। প্রতিমা, মূর্তি, দেব-দেবীর আলোচনাই মুখ্য এই অধ্যায়ে।
৬। একশ চব্বিশ পৃষ্ঠার এই বইয়ের ১০৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়লে একে সামাজিক বিজ্ঞানের চাইতে "ধর্মিয় ইতিহাসের বই" বললেই বেশী সঠিক হবে বলে ধারণা হয়েছে।
৭। অবশেষে চতুর্ধ অধ্যায়ঃ সুলতানি আমল। শুরুই হয়েছে এভাবেঃ “তোমাদের যদি জিজ্ঞেস করি, ‘বিদেশি' বলতে তোমরা কাদের বোঝাবে? তোমরা চোখ বন্ধ করে বলবে, বিদেশি হলো তারাই যারা আমাদের দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের বাইরে থেকে এই দেশে এসেছে। তোমাদের উত্তর একদম সঠিক। কিন্তু সুলতানি আমলে যদি কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো ‘বিদেশি' কে? তাহলে সে কী বলত জানো? সে বলত, অপরিচিত কোনো ব্যক্তি যে আমাদের গ্রামে বা অঞ্চলে থাকে না, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ নয়, সেই বিদেশি” (পৃষ্ঠা ১১১)। অর্থাৎ, এতক্ষন পর্যন্ত যা পড়লাম সবকিছুই আমাদের দেশীয়, আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এখন যা আসছে সব ভিনদেশি, অন্য সংস্কৃতির জিনিস। আমাদের উপর “সুলতানি তথা ইসলামী সংস্কৃতি” চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
৮। সুলতানি শাসন ব্যবস্থা এদেশে কীভাবে উড়ে এসে জেঁকে বসেছিল তার ধারণা এখন আসছেঃ
“তোমরা তো আগেই জেনেছে, সুলতানি আমলের আগে এই অঞ্চলে পাল ও সেন শাসকগণ শাসন করতেন। কিন্তু সুলতানরা ছিলেন মুসলিম। তাই নতুন শাসকগণ ক্ষমতায় এসে দেশের আইন-কানুন এবং বিচার ব্যবস্থা পুরোটা পাল্টে ফেললেন। এই আমলে শরীয়ত অনুসারে দেশ পরিচালিত হতো। কিন্তু শাসনব্যবস্থা মোটেও ধর্মতান্ত্রিক ছিল না। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যেহেতু অমুসলিম ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই সবাই সবসময় সুলতানদের শাসন মেনে নিতে চাইত না” (পৃষ্ঠা ১১২)।
৯। সুলতানি আমলের আগে সবাই ছিল উদারপন্থী ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু সুলতানগন যা ইচ্ছা তা-ই করতো। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তারাঃ
“সুলতানগণ ছিলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এখন মনে হতে পারে, ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’ আবার কী? বন্ধুরা, সার্বভৌম ক্ষমতা হলো সর্বময় ক্ষমতা। যে ব্যক্তি এই ক্ষমতার অধিকারী তারা তাদের ক্ষমতার জন্য কারও কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় না। তার ইচ্ছাতেই সবকিছু হয়। তিনি যেমন চান, তেমনই হয়” (পৃষ্ঠা ১১৩)।
১০। সুলতানি আমলের একমাত্র ভালো জিনিস ছিল যে সে সময়ে উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম একজন নারী শাসক বনে যান। তার নাম রাজিয়া সুলতানা। ১২৩৬ থেকে ১২৪০ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লীর সালতানাতের দায়িত্বে ছিলেন। শাসক হিসেবে ছিলেন প্রসিদ্ধ, সুলতানের পোশাকে দরবারে উপস্থিত হতে। যুদ্ধশাস্ত্রে ছিলেন পারদর্শী। যুদ্ধের মাঠে সেনাপতি হতেন।
১১। উপমহাদেশের ইতিহাসে সবসময়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসন থাকলেও বর্ণবাদের শুরু হয় সুলতানি আমল থেকেঃ
“ইতিহাসবিদদের গবেষণা অনুযায়ী, এ সময়ে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীর মানুষ বসবাস করলেও মুসলমানগণ অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। আর এর কারণ কিন্তু একটু আগেই বলা হয়েছে। সেই কারণটা মনে আছে তো? আচ্ছা, কারণটা আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছি। সুলতানি আমলের শাসকগণ সবাই ছিলেন মুসলিম এবং সে জন্যই মুসলিমরা অন্যদের থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল।
মুসলমান সমাজে মূলত দুইটি শ্রেণী ছিল। একভাগে ছিল বাইরে থেকে আসা অভিজাত সম্প্রদায় … অন্যভাগে ছিল স্থানীয় ধর্মান্তরিত সাধারণ শ্রেণী। অভিজাত শ্রেণী নিজেদের আশরাফ ও অন্যদের আতরাফ মনে করতেন। আশরাফ ও আতরাফদের মধ্যে মেলামেশা, বিয়েশাদী, দাওয়াতের আদানপ্রদান একেবারেই ছিল না। বর্তমানেও এ ধরনের বিভাজন আমরা দেখতে পাই। সমাজের ‘দলিতদেরকে' অন্ত্যজ ও অপাংক্তেয় মনে করা হয়” (পৃষ্ঠা ১১৫)।
১২। বর্নবাদের আলোচনা যেহেতু এসেছেই তাই হিন্দুদের বর্নবাদও আসা উচিত। তবে হিন্দু সমাজে বর্নপ্রথা “সুলতানি আমলে” অত্যন্ত কঠোর ছিল (পৃষ্ঠা ১১৯)।
১৩। বর্নভেদ ও সতিদাহের মতো বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ একই ধরণের জঘন্য কাজ। আর এসব জঘন্য কাজ দূর করেছিল হিরোরা। সেই হিরোরা ছিল খোদ হিন্দুদের মধ্যে রাজা রামমোহন রয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর অন্য হিরো ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ।
১৪। “অমানবিক দাসপ্রথা” সুলতানি আমলেই চালু হয়েছিল। এই অমানবিক দাসপ্রথাও আমাদের ব্রিটিশ মনিবগন নিষিদ্ধ করেনঃ
“… ইতিহাসের এই মন্দটুকুও তোমাদের জানতে হবে। সুলতানি আমলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। তোমরা হয়তো জানতে চাইতে পারো দাসপ্রথা কী? দাসপ্রথা হলো অমানবিক একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষের কেনা-বেচা হতো। এই ব্যবস্থায় ধনীরা ব্যক্তিকে কিনে নিত এবং ক্রীত ব্যক্তি তার সম্পত্তি হিসেবে যেকোনো কাজ করতে বাধ্য থাকত। সুলতানি আমলেও এই দাসপ্রথার মাধ্যমে মানুষের কেনা-বেচা হতো। দাসগণ অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করত। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য ছিল না। সুলতানি আমল ও মোগল আমল শেষে ব্রিটিশ উপনিবেশের মধ্যমভাগে আইন করে এই অমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়” (পৃষ্ঠা ১১৯)।
১৫। সুলতানি আমলে নারীদের অবস্থা ছিল অনেক শোচনীয়(পৃষ্ঠা ১২০)।
১৬। প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসনব্যবস্থার অর্থনৈতিক আমলের বিস্তারিত বর্ননা থাকলেও সুলতানি আমলের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না (পৃষ্ঠা ১২০)।
১৭। পুরো বইয়ের শতাধিক ছবি আছে। আছে কয়েক ডজন মন্দিরের ছবি, অনেক অনেক দেবদেবী, মূর্তি-প্রতিমার ছবি। মসজিদের ছবি আছে তিনটা।
১৮। যেতে যেতে সুলতানি আমল কত খারাপ সেটা আবার বলে যাই। যদিও “ইবনে বতুতা সুলতানি আমলে বাংলার ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। তাঁর মতে বাংলায় যত সস্তায় জিনিসপত্র কিনতে পাওয়া যেত, তা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। কিন্তু সস্তায় জিনিসপত্র কেনার মতো সামর্থ্য কতজনের ছিল তা অবশ্য কোনো পর্যটকের লেখায় পাওয়া যায় না। … সে-সময়ে সোনা, রূপা এবং তামার পয়সার প্রচলন ছিল। … তবে সাধারণ মানুষ কড়ির মাধ্যমে বিনিময় করত। সমাজে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট ছিল। সমাজের একদিকে যেমন বিত্তবানদের বিলাসী জীবন, ঠিক তেমনি উল্টো দিকে সংগামী মানুষ দুমুঠো খাবারের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করত” (পৃষ্ঠা ১২১)।
১৯। অত্যন্ত সুক্ষভাবে সুলতানি আমলের নামে মুসলিম বিদ্বেষ ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
২০। হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা ও ইতিহাসের প্রতি মুগ্ধতা সৃষ্টির চেষ্টা করানো হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক হিসাবে আমার দাবিঃ পুরো বইটি বাতিল করুন। রাষ্ট্র এবং সমাজ কাঠামো বিনির্মানের নিমিত্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাস এবং তমুদ্দুনকে সামনে নিয়ে একটা "জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি" গঠন করুন। সেখানে অন্তর্ভুক্ত করুন এমনসব এক্সপার্টদের যারা অন্য দেশের প্রভুত্ব অস্বীকারকারী খাঁটি দেশপ্রেমিক, যারা উপনিবেশের জিঞ্জিরে আবদ্ধ নন, বরং এই জিঞ্জির থেকে এদেশের মানুষকে মুক্তির সংগ্রামে আপসহীন। আর এটা না করলে বাংলাদেশকে হয়তো একদিন রোহিঙ্গা কিংবা কাশ্মীরীদের ভাগ্য বরণ করতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন