ড. মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম
এক.
২০১৮ সালের কথা। তখন ছিলাম বোস্টনে, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি'র ভিজিটিং স্কলার। স্ত্রীকে নিয়ে কিছু ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট কেনার জন্য গেলাম হার্ভার্ড ক্যাম্পাসের পাশে এক ড্রাগ হাউজে। ওষুধ নির্বাচন করলেও ওষুধের ইনগ্রিডিয়েন্ট নিয়ে মনে খটকা ছিলো। শুনেছি, যেসব ওষুধের মধ্যে 'এনিম্যাল ফ্যাট' থাকে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসে শুকরের চর্বি থেকে।
ওষুধটি নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে দেখি এক বাংগালী ভদ্রলোক। চেহারা আর নাম দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তিনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। তারপরও ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম ওষুধটি হালাল কিনা। উনি সম্ভবত এই প্রথম এ ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন। আমাকে জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলেনঃ ওষুধ আবার হালাল হারাম হয় নাকি? আমি বুঝানোর চেষ্টা করলে তিনি তীর্যক হাসি দিয়ে বললেন, "খুব ভালো, আপনি ইসলাম নিয়ে ভাবেন।"
দুই.
মাসখানেক পর এক ভাই তার বাসায় নৈশভোজে দাওয়াত দিলেন। সস্ত্রীক উপস্থিত হলাম মাগরিবের পরে। একটু পরেই দেখি ড্রাগহাউসের সেই ভদ্রলোকও সপরিবারে আমন্ত্রিত। উনি খুব আগ্রহ সহকারে ঠিক আমার পাশেই আসন নিলেন। জানলাম, উনি বাংলাদেশের একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। কথা বেশীদূর না যেতেই উনি বলে বসলেনঃ "ইসলামের ব্যাপারে তো আপনার অনেক আগ্রহ, তাহলে আমার কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিন।" আমি বললাম, "আমি কোন ইসলামিক স্কলার নই, তবে আমরা আলোচনা করে উভয়ই বেনিফিটেড হতে পারি।"
উনার প্রশ্নগুলো শুনে আমি রীতিমতো অবাক। একজন নবী কি করে 'শিশু আয়েশাকে' বিয়ে করতে পারে? দুনিয়ার সব বিজ্ঞানীরা যেখানে বিবর্তনবাদ 'অকাট্য সাইন্টিফিক ফ্যাক্ট' হিসাবে গ্রহণ করেছে, সেখানে 'সেকেলে ইসলাম' নিয়ে পড়ে থাকা গোঁড়ামি নয় কি?... এভাবে অবলীলায় প্রায় গোটা দশেক প্রশ্ন করে বসলেন।
উনার কথা এবং প্রশ্নের ধরণে আমি কয়েকটি জিনিস আঁচ করতে পারলামঃ (ক) সত্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে উনি প্রশ্নগুলো করেননি, বরং করেছেন ইসলাম নিয়ে এক ধরণের "মজা" করার জন্য। (খ) ইসলামের সাম্যবাদী এবং সামাজিক সুবিচারের বিশাল অঙ্গন বাদ দিয়ে 'চেরি পিকিং' এপ্রোচ নিয়ে অন্যান্য ইসলাম বিদ্বেষী অরিয়েন্টালিষ্টদের মতো হাতে গোনা কয়েকটি প্রশ্নের বাণ নিক্ষেপ করে ইসলামকে কটাক্ষ বা বিতর্কিত করার প্রয়াস চালালেন। (গ) এই প্রশ্নগুলোর লেন্স দিয়েই উনি বিচার করেন পুরো ইসলাম এবং মুসলিম জাতিকে। (ঘ) উনি নিজে যে একজন "গোঁড়ামিমুক্ত এনলাইটেন্ড মানুষ", সেই গর্বও তার কথার মধ্য ফুটে উঠছিল বারবার। বুঝলাম, শাহবাগীরা ছড়িয়ে আছে দুনিয়ার প্রায় সবখানে।
আমি সাধারণত তর্ক এড়িয়ে চলি, এবং যারা সত্যে পৌঁছাতে আগ্রহী শুধু তাদের সাথে আলোচনা করি নিজেও কিছুটা বেনিফিটেড হওয়ার জন্য। তাছাড়া যাদের মেন্টালিটি পুরোটাই কলোনাইজড, তাদেরকে ডিকলোনাইজড না করে আলোচনায় বসলে ফলাফল কেবল শূন্য হয় না, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, জেদ ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়।
তিন.
উনার প্রশ্ন শেষ হলে আমি সরাসরি বলে বসলামঃ "আপনার উদ্দেশ্য কি সত্যে পৌঁছানো, নাকি ইসলাম নিয়ে 'মজা' করা?" উনি অপ্রস্তুত ভংগিমার কিছুটা থতমত খেয়ে বলে ফেললেন "সত্যে পৌঁছানো"। আমি সুযোগ নিয়ে বললাম, তাহলে আমাকে কয়েকটা মিনিট সময় দিন।
"শিশু আয়েশার" বিয়ে সংক্রান্ত প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব না দিয়ে উনাকে দেখালাম ড. ইয়াসির ক্বাদীর ৬ মিনিটের একটা ভিডিও "Why did Prophet Muhammad marry Aishah at a young age" (লিংক কমেন্টে)।
উনার মনের খটকা দুর হলো কিনা জানিনা, তবে এ ব্যাপারে আর কোন উচ্চবাচ্য করেননি।
বিবর্তনবাদের ব্যাপারে [এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে রূপান্তর] আমি বললামঃ এটা কোন 'সাইন্টিফিক ফ্যাক্ট' নয়, বরং একটা 'হাইপোথেটিক্যাল এসার্সান'। আর সাইন্টিফিক ফ্যাক্ট হলেও বিজ্ঞানে চিরোসত্য (absolute truth) বলে কিছু নেই। বিজ্ঞানের সব থিয়োরিই পরিবর্তনশীল। আপনার বিজ্ঞানমনস্কতাকে আমি সাধুবাদ জানাই। এই বিজ্ঞানই এখন যা বলছে, তা ইসলামের সাথে বিজ্ঞানের গ্যাপ বা টেনশন অনেকটা কমে এসেছে।
"কিভাবে?"-- উনি প্রশ্ন করলেন। আমি দুইটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উল্লেখ করলাম।
১. মানুষের উদ্ভব অন্য গ্রহে, দুনিয়াতে নয়ঃ Dr Ellis Silver একটা বই লিখেছেন "Humans are not from Earth"। লেখক বলেন, গ্রাভিটি এবং সানলাইট আমরা সইতে পারিনা এবং সবসময় কোন না কোন রোগে ভুগি। মানুষ নিশ্চয়ই অন্য কোন গ্রহ থেকে এসেছে যেখানে রয়েছে অপেক্ষাকৃত কম সানলাইট এবং কম গ্রাভিটি। এভাবে তিনি ১৫ টা সাইন্টিফিক ফ্যাক্ট উল্লেখ করে প্রমাণ করেছেন, এই দুনিয়ায় (বিবর্তনের মধ্য দিয়ে) মানুষের উদ্ভব সম্ভব নয়।
২. দুনিয়ার সব মানুষ এসেছে একজোড়া মানুষ থেকেঃ আমেরিকার রকেফেলার ইউনিভার্সিটি এবং সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ ব্যাসেল এর এক ঝাঁক বৈজ্ঞানিক পাঁচ মিলিয়ন মানুষ এবং প্রানীর ডিএনএ নিয়ে দীর্ঘকাল যাবত গবেষণা চালিয়ে এই ফলাফলে উপনীত হয়েছেন যে, দুনিয়ায় সব মানুষ এসেছে মাত্র একজোড়া মানুষ থেকে। তাদের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে Human Evolution জার্ণালে। সর্বশেষ এই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আবারো প্রমাণ করলো যে মানুষের বিবর্তনবাদ [বানর থেকে মানুষের রূপান্তর] স্রেফ হাইপোথেটিক্যাল এসার্সান। দেখুনঃ New York Post, November 24, 2018)।
উল্লেখ্য, স্থান কাল পাত্র ভেদে একই প্রাণীর মধ্যকার বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞান যেটা বলে, ইসলামের সাথে সেখানে সংঘর্ষ নেই। সংঘর্ষ আছে এক প্রাণী থেকে সম্পূর্ণ অন্য প্রাণীতে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি; যেমন মানুষ বানর থেকে এসেছে।
চার.
পরে খাবার এসে যাওয়াতে বাকি প্রশ্নগুলো নিয়ে আর আলোচনার সুযোগ হয়নি। উনি আমার কথায় কনভিন্স হয়েছিলেন কিনা জানি না, তবে যাওয়ার আগে আমার কাছে সবগুলোর রেফেরেন্স চেয়েছিলেন, যা আমি তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কয়েকটি বিষয় মনে ভাবনার উদ্রেক করলোঃ
(ক) কলোনাইজড বা ওরিয়েন্টালিষ্ট মেন্টালিটি আমাদের সমস্যাগুলোর সবচেয়ে বড় একটা উৎসমূল। পাশ্চাত্যেই এখন "ডিকলোনাইজেশান অফ একাডেমিয়া" মুভমেন্ট শুরু হলেও প্রাচ্যে আমরা এখনো কলোনিয়াল ব্যাগেজ এবং লেগাসি নিয়ে পড়ে আছি। ইসলাম বিদ্বেষের উৎসমূল এটাই।
(খ) বিষয়টি এতোটাই সাংঘাতিক যে এগুলোর উত্তোরণ ব্যতিরেকে একটা আত্মমর্যাদাপূর্ণ মুসলিম জাতি হিসেবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বিষয়টির পূর্ণ অনুধাবন এই উপমহাদেশে আল্লামা ইকবাল, মাওলানা মওদুদী, মাওলানা আব্দুর রহিম, এবং হাসান নদভী সহ খুব কম ইসলামিক স্কলারাই করেছেন, এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মাঝে ইসলামকে জনপ্রিয় করার প্রয়াস চালিয়েছেন। আর অন্যান্যরা এদেরকে সমালোচনা এবং ফতোয়ার তীরে বিদ্ধ করেই তাদের "ইমানী দায়িত্ব" পালন করেছেন বা করে যাচ্ছেন!
(গ) আলেম সমাজের উচিৎ হবে ফিকহী বিষয় নিয়ে তর্ক-বহাস, ঝগড়াঝাটি, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ বাদ দিয়ে সমাজের এই জটিল বিষয়ের দিকে নজর দেয়া; ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হওয়া; ইসলামকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে একটা "জনপ্রিয় এবং অনুকরণীয় আদর্শ হিসাবে" আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাছে তুলে ধরা; আর রিয়াক্টিভ বা যুদ্ধাংদেহী মনোভাব পরিত্যাগ করে আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে গভীর গবেষণা করা এবং ইজতিহাদি শক্তি দিয়ে সেগুলো ইসলামের পক্ষে নিয়ে আসা।
আর এগুলো না করলে, এ জাতি আর আদমের বংশধর থাকবে না, স্রেফ বানরের বংশধরে রূপান্তর হবে। তখন অন্যের ইশারায় বানর হিসাবে বানরামি করেই জীবন কাটাতে হবে, আত্ম-মর্যাদাপূর্ণ মানুষ হিসাবে নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন