সিরাজুল ইসলাম শাহীন।
১৯৯৩ সেশনের শেষার্ধ। সদস্য প্রার্থী ও বাছাইকৃত সাথীদের শববেদারী। দারসুল কোরআনের পর গ্রুপ ভিত্তিক স্টাডি চলছে। রাত প্রায় ২টা। প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকায় নাস্তা পর্বের খোঁজ নিয়ে দেখলাম সংশ্লিষ্ট ভাইয়েরা চা আনতে রিকাবীবাজার যাচ্ছেন। শাখা সভাপতি জুবায়ের ভাইর অনুমতি নিয়ে আমিও যোগ দিলাম। মটর সাইকেলে বের হতেই আলিয়া হোস্টেল গেইটে তোপের মুখে পড়লাম। ৫/৭ হোন্ডায় কয়েকজন এস আই সহ কোতোয়ালি ওসি আমাদের ঘিরে ধরলেন। প্রচুর ফোর্স সহ রণসাজে পুলিশ চৌহাট্রা মেইন রোডে অবস্থান নিয়েছে। অফিসারদের চেহারায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করলাম। ইতিমধ্যে ওসি সাহেবের সাথে আমার শুরু হওয়া কথোপকথন ছিল এমন....
- শাহীন ভাই, এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?
- এই তো রিকাবীবাজারে। কী ব্যাপার, এ যে একেবারে যুদ্ধাবস্থা। কী হয়েছে?
- আমাদের নিশ্চিত ইনফরমেশন এখানে ট্রেনিং চলছে।
- মুচকি হেসে বললাম, তাই নাকি, আমরাতো ভিতরে ছিলাম। এমন কিছু জানিনা।
- একেবারে অস্ত্রের ট্রেনিং। ভয়ানক ট্রেনিং। আমরা নিশ্চিত। আমাদের এখনই ভিতরে ঢুকতে হবে।
- কিন্তু আপনাকে প্রিন্সিপালের অনুমতি নিতে হবে।
- আমরা উনাকে পাচ্ছিনা। আপনি আমাদের সাহায্য করেন।
- কিভাবে, তিনি বাইরে অনেক দূরে থাকেন। একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে আপনার ভালই জানা আছে প্রিন্সিপালের অনুমতি ছাড়া সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুলিশ ঢুকতে পরে না।
তারা পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন। ওয়াকিটকিতে বার বার কড়া নির্দেশ আসছিল। ভিতরে প্রায় সকল দায়িত্বশীল রয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতেই হবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, বললাম,
''দেখুন, প্রসিডিউর অনুযায়ী আপনারা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেন না। তবে আমি আপনাদের অনুরোধ রাখতে পারি, শর্ত হচ্ছে আমার সাথে সকল অফিসার সহ আপনাকে চুপি চুপি আসতে হবে। ক্যাম্পাসে কেউ যেন টের না পায়।'' বলা মাত্র পিন পতন নীরবতা নেমে এল। তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আমি যোগ করলাম, ''ভিতরে ট্রেনিং চলছে ঠিকই। আপনাদের এমনভাবে দেখাতে চাই যেন ট্রেইনাররা টের না পায়।''
তাদের বিস্ময় আরো বেড়ে গেল !
- আপনি কি ঠিক বলছেন !
- অবশ্যই! চিন্তা করবেন না, চলুন।
মনে মনে বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা দিলাম। ওসি-র সাথে ৫/৭ জন এস আই এবং এ এস আই। পুরোনো মসজিদের তখন জানালা গুলো ছিল জরাজীর্ণ। তারা সকলে ছিদ্র দিয়ে দীর্ঘ সময় ভিতরের দৃশ্য সেদিন দেখেছিলেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একদল ছাত্র আল্লাহর ঘর মসজিদে রাত্রি যাপন করে ইবাদত বন্দেগী করছিলেন। এক গ্রুপ নিয়ে জুবায়ের ভাই কোরআন স্টাডি ক্লাস নিচ্ছিলেন। আরেক গ্রুপ আয়াত মুখস্ত করছিলেন। অন্যরা তাহাজ্জুদ আদায় করছিলেন। কেউ কেউ তখন জিকির ও দোয়া'রত ছিলেন। এমন পবিত্র দৃশ্য দেখে পুলিশ অফিসাররা অবাক হয়ে গেলেন । বিদায়ী কথাগুলো এখনো কানে বাজে...
- এ কি দেখালেন ভাই !
- এ ট্রেনিং শিবিরের নিয়মিত কর্মসূচি। যা আজ দেখলেন তা মিডিয়ায় কখনো আসে না। আর আপনারা যে ট্রেনিং এর কথা শুনেন বা পড়েন তা আমরা কখনো দেখিনি।
সেদিন ওসি সাহেবের চোখে স্পষ্টত পানি দেখেছিলাম। কয়েক বছর পর তিনি আবার একই দায়িত্বে ফিরে আসলে দরদ-সম্মান লক্ষ্য করেছি। ১৯৯৫ সালের সিলেটে এক এসপি সাহেবকে জানি। আমাদের প্রতি খুবই নির্মম আচরণ করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে তখন তিনি ডি আই জি। ঢাকা পলওয়েল মার্কেটে দেখা হলে সৌহার্দমূলক ব্যবহার ভুলার মত নয়। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে বলেছিলেন, ''আপনারাই আমাদের একমাত্র আশা। গোটা জাতি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।" জামায়াত-শিবির কাছ থেকে দেখার কারনে দেশের বহু বিবেকবানের ধারনা এমনিভাবে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।
সিলেটে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলেম দ্বীন হজরত মাওলানা আব্দুল জলিল (র:) ইমাম সমিতির সভাপতি ছিলেন। কমিটিতে সেক্রেটারি ছিলেন কাজীর বাজার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হজরত মাওলানা হাবিবুর রহমান (র:)। ১৯৮৭ - '৮৮ সালের দিকে জামায়াতের বিরুদ্বে ওলামায়ে কেরামের নামে প্রচারিত বক্তব্য -বিবৃতির প্রথম নাম উনার থাকত। তিনি পুরাতন মেডিকেল কলোনী জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ছিলেন। এই মসজিদে এক রাতে শিবিরের শববেদারীতে কান্নার আওয়াজে হুজরায় ঘুমন্ত হুজুরের ঘুম ভেঙে যায়। রুম থেকে বের হয়ে সেদিন সুবহে সাদেকের সময় তরুণদের আল্লাহর দরবারে ধর্ণা দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ছেড়েছিলেন। অত্যন্ত উচ্চব্যক্তিত্ববান এই আলেমে দ্বীনকে এর পর থেকে আমাদের বিরোধিতায় আর পাওয়া যায় নি।
এ সব ট্রেনিং প্রোগ্রাম আমার মত অনেকের জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছে। ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে এম সি কলেজ একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে শিবিরের জালে আটকা পড়ি। অভ্যাসগত শামুক প্রকৃতি আমাকে পিছনে রাখে। জালাল ভাই, আব্দুর রব ভাই ও বাবুল ভাইদের নিরলস প্রচেষ্টা সফল হতে পারছিল না। মহানগর সেক্রেটারি সায়েফ ভাই একদিন বাসায় হাজির। রিপোর্ট বই সহ নিয়ে গেলেন নিজ রুম শামসুদ্দিন হোস্টেল সি ৭০-তে। বিগত মাসের রিপোর্ট যোগকরা দেখিয়ে হাত ধরে হাজির করলেন পুরাতন মেডিকেল কলোনী মসজিদের বারান্দায়। বাছাইকৃত কর্মী শিক্ষা বৈঠকে দারসুল কোরআন পেশ করছিলেন মেডিকেল সভাপতি ইহতিশামুল হক শাহীন ভাই। তন্ময় হয়ে শুনেছিলাম। কদিন পরে শববেদারীতে গেলাম কুদরত উল্যাহ মসজিদের দুতলায়। টাইমিং (২মিনিট দেরিতে আসায় বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা), নফল ইবাদত ও শেষ রাতে মোনাজাতে আহাজারি আমাকে খুবই আকৃষ্ট করে। বলা যায় এ দুটি কর্মসূচি আমার মঞ্জিল নির্ধারণ করে দেয়। আর পিছনে তাকাইনি।
এ সব তারবিয়াহ থেকে দেশে একটি জেনারেশন তৈরী হয়েছে এবং হচ্ছে । ধূমপান, ড্রাগ, ইভটিজিং মুক্ত - সততা, দক্ষতা, দেশপ্রেম, ঈমানী চেতনায় ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতি গঠনের শপথে বলীয়ান। সংশ্লিষ্ট পরিবার এলাকাবাসী সরাসরি উপকৃত হচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সময়ের ব্যবধানে তা মূল্যায়িত হবে। অবসান হবে কাঙ্ক্ষিত দীর্ঘ অপেক্ষার ইনশাআল্লাহ। ছাত্র শিবির তাই ইতিহাসের এক অমর-অক্ষয় নাম। এ কাফেলাকে মহান মালিক তাঁর কুদরতের হেফাজতে রাখুন সর্বক্ষণ।
এমন সংগঠন -আন্দোলন তাই স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠবেই। হুমকি -ধমকি - জেল - রিমান্ড - ফরমায়েশী রায় -ফাসিঁ - হত্যা -গুলি - জঙ্গি তকমা -ষড়যন্ত্র - অপপ্রচার কোন কিছুই এর অগ্রযাত্রা দমাতে পারে না । আপন প্রয়োজনে জাতি নিজ ঠিকানা খুঁজে নেবে।
আমরা ভাগ্যবান। এই গোলাপ বাগানের ক্ষুদ্র মালী ছিলাম জীবনের সোনালী অধ্যায়ে। বার্ষিক সদস্য সম্মেলনে বিদায়ী কেন্দ্রীয় সভাপতির সমাপনী ভাষণ, শত-সহস্র ডেলিগেট সহ দোয়ায় বুক ফেটে কান্না, পরেরদিন নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় সভাপতির দিকনির্দেশনা নিয়ে নবউদ্দোমে ময়দানে ফিরে আসা খুব মিস করি। সেদিন ফিরে আসবে না জানি কিন্তু স্মৃতি - অর্জনগুলো স্থায়ী পুঁজি শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত।
প্রবাস জীবনে একটি আফসোস থাকে। সন্তানরা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির পায় না। এমন একটি পবিত্র-গতিশীল ঠিকানা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সর্বত্র প্রয়োজন। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা আমাদের ভুলত্রুটি মাফ করে দিন, জীবনের শেষমুহুর্ত পর্যন্ত দ্বীনের পথে সক্রিয় রাখুন। আমীন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন