মিনার রশিদ
ইসলামী ব্যাংক থেকে জনগণের আমানতের তিন হাজার কোটি টাকা স্রেফ লুট করেছে চিহ্নিত লুটেরার দল! এদেশের মিডিয়া মুঘলরা অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে এই ঘটনাটিকে ‘ভয়ংকর-নভেম্বর’ হিসাবে অভিহিত করেছেন! অথচ দেশের বৃহত্তম এই ব্যাংকটিকে যখন এদেশের গৌরব ও গর্বের সেনাবাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে দখল করা হয় তখন এই চেতনার মিডিয়া সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করেছিল।
কিছুদিন আগে একই কায়দায় মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দখল করার সময়েও এই মিডিয়া ও সংশ্লিষ্ট সকল সুশীল সমাজ সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে। ভাবখানা এমন যে কথিত মৌলবাদীদের হাত থেকে তাদের সম্পদ কেড়ে নেওয়াতে কোনো পাপ নেই।
২০০৭ সালে জনৈক ইহুদি লেখকের সঙ্গে লেখা একটি আর্টিকেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের সাথে সাথে হাসপাতাল সমূহও মৌলবাদী হয়ে পড়ছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। ইসলামোফোবিক বিশ্বে তাদের সেই আর্টিকেলটি তখন খুব কাজে দিয়েছিল। আমাদের সেনাবাহিনীর অফিসারদের ত্রিশ ভাগ নাকি মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের, যা ছিল ডাহা মিথ্যা কথা। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সেই ইশারা মতই দেশের সেনাবাহিনী, শিক্ষা এবং অর্থনীতিকে "অ-মৌলবাদী" বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসা হয়! সজীব ওয়াজেদ জয়ের সেই ভিশন সফল করতে শিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন জাফর ইকবালরা তেমনি অর্থনীতির ক্ষেত্রে আবুল বারাকাতরা এগিয়ে আসেন।
“মৌলবাদী অর্থনীতি ” শব্দটি সম্ভবত সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকেই নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক জনাব আবুল বারাকাত। বাংলাদেশের অর্থনীতি মৌলবাদী হয়ে পড়ছে বলে জিকির তুলেছিলেন এই চেতনা ব্যবসায়ী। তারই দেখানো রোড ম্যাপ অনুযায়ী এদেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকটিকে দখল করা হয়। লুটেরাদের লুটপাটে এই জ্ঞানপাপী এক ধরনের চেতনা মিশ্রিত নৈতিক ভিত্তি তৈরি করেন। আর সেই দখল কর্মটি করেছিলেন আমাদের গর্বের সেনাবাহিনীর একটি অংশ! অর্থাৎ এক সাথে জাতির দুটি সর্বনাশ করা হয়।
এর ফলে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তিটি ধরে যে টান পড়ছে, লুটেরাদের এই নব্য সহযোগীরা তা খেয়াল করে নাই। এটি মূলত: আর কোনো রাষ্ট্র নেই, এক দস্যু রাণীর ঢেঁড়া বনে গেছে! এখানে গুটিকয় মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এদেরকে বাঁধা দেওয়ার বা নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই।
চেতনার হাত ধরেই এই চেতনা-জীবী এক লাফে বনে যান জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তার সময়েই এননটেক্স নামের এক প্রতিষ্ঠানকে ৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। নিয়ম ভেঙে এক গ্রাহককেই মাত্র ছয় বছরে এ ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। তার সেই অ-মৌলবাদী ছোঁয়ার পরে এই ব্যাংকটি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নি।
আর সেই আবুল বারাকাত এখন বলছেন, “ বাংলাদেশের ৫টি মেগা প্রকল্পের ঋণ শোধ করা শুরু হবে ২০২৭ সাল থেকে। তখন টাকা ছাপিয়েও এই ঋণ শোধ করা যাবে না। তখন সে পরিমাণ ফরেন কারেন্সিও থাকবে কি না, যদি না থাকে তাহলে পেছন ফিরে বলতে হবে তখন ভুল করেছিলাম।
এখন প্রশ্ন, এই জ্ঞানপাপীদের ভুলের মাশুল কি জাতি আদৌ উসুল করতে পারবে?
এদিকে নিজেদের পরম পূজনীয় নেতা মারা যাওয়ার ২০ বছর পর একদম ফ্রেশ বিলাপ করে সকলের দৃষ্টি কেড়েছিলেন অভিনেত্রী তারানা হালিম। সেই অভিনেত্রীর বিবেকও ইদানিং আগের মতই একটু বিলম্বে কাজ শুরু করেছে!
তিনি বলেছেন, ২৫ হাজার টাকার খেলাপিরা জেলে আর ২৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপিরা আরামে ঘুমায়!
এতদিন তারানা হালিমদের ঘুম ভাঙে নাই। খেলাপি ঋণ এখন এক লাখ চৌত্রিশ হাজার কোটি টাকা হওয়ায় এই তারানা হালিমদের হুঁশটি ফিরেছে! গত এক বছরেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা! এই ইঁদুরেরা যখন আমাদের অর্থনীতির ঘরটি এভাবে কাটছে তখন এই তারানা হালিমরা জাতিকে উন্নয়নের গল্প শোনাচ্ছিলেন!
২০১৩ সালেই বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, দেশটি বাজিকরদের হাতে পড়ে গেছে। তারানা হালিম সেই বাজিকরদেরই একজন। সবকিছু ধ্বংস করে এখন এই আফসোস বা লিপ সার্ভিস দিয়ে আসলেই কী হবে? আর এসব লুটপাটের পেছনে মূল দায়ী ব্যক্তিটিকে এই তারানা হালিমরা এখনও আগলে রাখছেন!
এই তারানা হালিমরা গণতন্ত্র, মানবতা, আইনের শাসন, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে অদ্ভুত এক নৈতিকতা বা বিবেকের মডেল তৈরি করেছে। এই তারানা হালিমরা সবাইকে দায়ী করবে কিন্তু পালের গোদা বা মূল দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করবে না। সমস্যার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করবে, রুট কজ এনালাইসিস করবেনা! বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতায় দুর্নীতির কান নিয়ে নাচানাচি করবে কিন্তু কান ধরে এমন টান দিবে না যাতে মাথাটি বেরিয়ে পড়ে।
দুই.
এক বন্ধুর পাঠানো একটা ম্যাসেজ আমাকে গত কয়েক সপ্তাহ যাবত কিছুটা ভাবনায় ফেলে দিয়েছে"। বন্ধুবর লিখেছেন,
“দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর। আজকাল এই আপ্ত বাক্যটি পরিবর্তিত হয়ে- দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত রাজনীতির অনুশীলন কর এরকম হয়ে গেছে। তথাকথিত রাজনীতিবিদরা আমাদের প্রতিটি সামাজিক, আর্থিক, ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছে, যেমন; সত্য গোপন করা, সত্য কথা না বলা, অন্যকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, এনালগ থেকে ডিজিটাল সব কিসিমের চুরি করা। অর্থাৎ এই সব বাটপারিরই আরেক নাম রাজনীতি! ফলে আমাদের সম্পূর্ণ জীবনচক্র ঢুকে পড়েছে রাজনীতির এক বিষাক্ত ধারায়! রাজনীতির নামে তারা তাদের সকল অপকর্মকে সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত বলে প্রমাণ করে। এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি সমাজের প্রায় সবার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি, প্রতি মুহূর্তে শ্বাসকষ্ট অনুভব করছি। আমরা এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাই, নিরাময় কামনা করি। নিরাময়ের সেই সময়টি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা আমরা করতে পারি না। যদিওবা কখনও কখনও আমার অনুমানগুলি বাস্তবতার সাথে মিলে যায়। তুই এই বিষয়ে একটি লেখা লিখতে পারিস এটা সময়ের দাবি।”
জানি না, আমার এই বন্ধুটিকে ডিপলিটিসাইজেশনের শিকার হিসাবে ভাবব নাকি তার এই উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাটি যথাযথ গণ্য করব? কারণ এই বন্ধুটি যা বলেছেন তার একটি কথাও তো মিথ্যা না। আশে পাশে যে সব রাজনীতিবিদ দেখছি তাদের অধিকাংশের সাথে বন্ধুর এই বর্ণনা অত্যন্ত দুঃখজনক-ভাবে মিলে যায়।
তারপরেও এই বন্ধুটি এবং সম্ভাবনার অন্যান্য সুধী-জনদের প্রতি পরামর্শ থাকবে, সামগ্রিকভাবে রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা না বলে ইনডিভিজুয়াল দুর্বলতা বা ত্রুটিকে আইডেন্টিফাই করা উচিত। দাঁতের এক পাটিতে ব্যথা হলে সেই পাটিতেই চিকিৎসা দিতে হবে। এক পাটিতে ব্যথা হলে উভয় পাটির দাঁত তুলে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কিংবা এক দাঁতের ব্যথার জন্যে সকল দাঁত ফেলে দেওয়া যুতসই হবে না। একটু ধৈর্য্যের সাথে ব্যথার উৎস বা কারণটি পিন-পয়েন্ট করতে হবে।
তজ্জন্যে সর্ব প্রথম আমাদের বিবেকের সেন্সর বা বাটখারাটিকে ঠিক করতে হবে এবং সঠিক রিডিংটি বলতে হবে। লীগের শরীরে এই বাটখারা লাগালে যদি গন্ধের এই মাত্রা (রিডিং) দেড় শ দেখা যায়, বিএনপির দেহে যদি এই রিডিং ষাট হয় এবং জামায়াতের গতরে যদি ত্রিশ পাওয়া যায়, তবে সেই কথাটিই নির্ভয়ে বলতে হবে। বিভিন্ন চেতনায় চেতনায়িত হয়ে আমরা কারেক্ট রিডিংটি বলতে ভয় পাই বা দ্বিধায় পড়ে যাই। আর এ কারণেই বন্ধুটির বর্ণিত এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি মিলছে না।
পচন ধরেছে আমাদের মগজে। চিকিৎসাটির শুরু করতে হবে সেখান থেকেই। অযথা রাজনীতিকে দোষে লাভ নেই ব্রাদার!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন