মিনার রশিদ
আমার স্ত্রীর এক প্রাক্তন কলিগ এবং বর্তমান বান্ধবী, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এই প্রবাসে জব করেন। গত কয়েক দিন যাবত কাজের চাপে দুজনের কেউ বাজার করতে পারছেন না। ফলে ফ্রিজে রাখা খাবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাদের ছোট্ট মেয়ে দেশে অবস্থানরত আত্মীয় স্বজনদের মুখে দুর্ভিক্ষের কথা শোনে শোনে দুর্ভিক্ষ জিনিসটাকে বুঝতে চেষ্টা করছে। দুর্ভিক্ষের আতংক এই ছোট্ট শিশুকেও পেয়ে বসেছে। ঘটনা প্রবাহের উপর নিজের মত করেই নজর রাখছে! দুদিন আগে খালি হওয়া ফ্রিজ খুলে বাবা মাকে জিজ্ঞেস করে, মাম্মি এটাই তাহলে দুর্ভিক্ষ? সত্যি এই ছোট্ট শিশু ডিজিটাল দুর্ভিক্ষের একটি চমৎকার সংজ্ঞা নিজের অজান্তেই সৃষ্টি করে বসেছে।
১৯৭৪-১৯৭৫ ছিল এনালগ দুর্ভিক্ষ, এবার চলছে ডিজিটাল দুর্ভিক্ষ।
আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে দেশের ইকোনোমি বটমলেস বাস্কেট হবে, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে দেশে দুর্ভিক্ষ নামবে- এটা যেন নিয়তি হয়ে পড়েছে। এনালগ (সরব) দুর্ভিক্ষ না হলেও ডিজিটাল বা নীরব দুর্ভিক্ষ হবেই হবে।
সব চেয়ে বড় হলো এদের চাপার জোড়। এই জোড় ঐতিহাসিক। এই লিপ সার্ভিস সেই প্রথম থেকেই চালু ছিল। এমনই এক আবেশে নেতা বলেছেন- আমার সামনে চোর, পেছনে চোর, ডাইনে চোর, বামে চোর। চতুর্দিকে এই চোরদের দেখতে পেলেও তাদের একজনকেও পাকড়াও করতে পারেন নাই! ফলে এসব কথা শুনে চোরেরা তাদের চুরি কর্ম বন্ধ করে নাই। বরং এসব কথার ফুলঝুরিকে এক ধরণের প্রশ্রয় হিসাবে গণ্য করেছে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। দেশ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে যায়!
১৯৭৪-১৯৭৫ সালে সংঘটিত হয়েছিল স্মরণকালের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ, যেটা ছিল আজকের শিরোনামের ভাষায় এনালগ দুর্ভিক্ষ। সেই দুর্ভিক্ষে যত লোক মারা গিয়েছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধেও ততলোক মারা যায় নি। বিষয়টি নিয়েও একাডেমিক গবেষণা জরুরি! যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ যদি সেই দুর্ভিক্ষের কারণ হতো তবে সেই দুর্ভিক্ষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৭২ সালে কোনোক্রমেই তা ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে হওয়ার কথা ছিল না।
মানুষকে বিভ্রান্ত করতে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী বলয় বলতে চান যে তখন শূন্য রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে এবং যুদ্ধের কারণে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হয়।
পিনাকীদা তাঁর একটি ইউটিউব ভিডিওতে বিষয়টি তথ্য উপাত্ত সহ তুলে ধরেছেন। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামীবলয়ের সকল সুশীলগণ জনগণকে বোঝাতে চান যে মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো ফসল ফলে নাই এবং স্বাধীনতার পর শূন্য রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল! কিন্তু এ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত বলে ভিন্ন কথা! ১৯৭২ সালে ফসল ফলে এক কোটি ২ লাখ টন যা অন্যান্য বছরের উৎপাদনের কাছাকাছি ছিল! ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৪ কোটি ৩১ লাখ ডলারের রিজার্ভ নিয়ে। ১৯৭১ সালে যুক্ত পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ১৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। কাজেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল শূন্য রিজার্ভ নিয়ে- এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা!
এদেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট ড. ইউনুসকে খাটো করার জন্যে প্রতিহিংসাপরায়ণ শেখ হাসিনা পাশের দেশের যে নোবেল লরিয়েটকে বেছে নিয়েছিলেন সেই অমর্ত্য সেনের গবেষণার মূল বিষয় ছিল আমাদের সেই এনালগ দুর্ভিক্ষ। সেই গবেষণায় তিনি দেখিয়েছিলেন যে উৎপাদনের অপ্রতুলতা নয় বরং ত্রুটিপূর্ণ বন্টনব্যবস্থা তথা একটা অপশাসনের আওতায় সংঘবদ্ধ লুটপাটই সেই দুর্ভিক্ষের পেছনে মূল কারণ ছিল। অমর্ত্য সেনের সেই নোবেল প্রাপ্তিতে যে গবেষণা কর্মটি ভূমিকা রেখেছে সেটি জানলে ড. ইউনুসের মতই ‘গোলামের পুত গোলাম’ বলে গালি দিতেন।
অন্য সবকিছুর মত দুর্ভিক্ষ এখন এনালগ থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। এনালগ দুর্ভিক্ষ চোখে দেখা যায়। ডিজিটাল দুর্ভিক্ষ চোখে তেমনভাবে দেখা না গেলেও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায়। এনালগ দুর্ভিক্ষ বা ডিজিটাল দুর্ভিক্ষের বাতাস কিন্তু লুটেরাদের স্পর্শ করতে পারে না! ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে যখন হাজার হাজার মানুষ অনাহারে- অর্ধাহারে থেকেছে তখনও কেউ কেউ নিজের ছেলেকে সোনার মুকুট পরিয়ে বিয়ে করিয়েছেন। এনালগ দুর্ভিক্ষের এক সোনার মুকুট পরিয়ের সংখ্যা ডিজিটাল দুর্ভিক্ষে অজস্র হয়েছে। ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় এবং অতি ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রথম। এটি হলো লুটেরা অর্থনীতি বা বটমলেস বাস্কেট অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। অর্থনীতিতে এই অস্বাভাবিক প্রবণতাটি যে আমাদের কপাল খেয়েছে সেই বোধটি এখনও আমাদের মাঝে আসে নাই! কাজেই সরব দুর্ভিক্ষের অপেক্ষা নয়, নীরব দুর্ভিক্ষে অনেক আগেই আমরা ঢুকে পড়েছি। শুধু মগজে কিছু জিনিসের অভাবে বিষয়টি মালুম করতে পারছি না।
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন