মিনার রশিদ
আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটিং শুরু হলে নির্বাচনে প্রতীক বা চিহ্নের ব্যবহার শুরু করা হয়েছিল অক্ষর জ্ঞানহীন বা মূর্খ জনগোষ্ঠীর ভোটদানের কথা মাথায় রেখে। ভোটের বাক্সে প্রতীক ব্যবহারের উদ্যোক্তারা হয়তো ধারণা করেছিলেন যে জনগণের বড় অংশকে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন না করা পর্যন্ত এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে থাকবে। এটি এখন একটি স্থায়ী ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সকল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে অন্ধকার বা অন্ধত্বের এই প্রতীকগুলোকে দূরে না ঠেলে কারো কারো অন্ধত্ব বা অন্ধকার আরো ভয়ংকর হয়ে পড়েছে।
শুধু তাই নয়, এই অন্ধত্বের প্রতীক এখন আরো অন্ধ আক্রোশের প্রতীক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে! তারই বহি:প্রকাশ জাতি দেখেছে ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর তারিখে! নিরক্ষর অন্ধের জন্যে যে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছিল সেই নৌকার লগি-বৈঠা আরও কুৎসিততম চেতনায় অন্ধ হয়ে মানুষ মারার নগ্ন উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল। প্রকাশ্য রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মত পিটিয়ে ভিন্নমতের নেতা ও কর্মীদের মেরে তাদের লাশের উপর নৃত্য দেখে পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে পড়ে! অসহায় বাবা লাইভ টিভিতে দেখেছেন তার পুত্রকে কীভাবে দিন দুপুরে সাপের মত পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অসহায়া জননী নিজের চোখে দেখেছেন তার কলিজার টুকরা সন্তানের কারবালা!
নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যে যিনি তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করেছেন সেই তিনিই লগি-বৈঠা নিয়ে এই উন্মাদনা সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছিলেন। জাতির কলিজা ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে ডিজিটাল হিন্দার আহ্বান আজও ইন্টারনেটে সংরক্ষিত রয়েছে। সম্ভবত কেয়ামত পর্যন্ত এটি নৃশংসতার নমুনা হিসাবে মজুদ থাকবে।
এক এগারোর মূল হোতা মঈন ইউ আহমেদ ক্ষমতা দখলের অজুহাত হিসাবে এই নৃশংস ঘটনাটিকে ব্যবহার করেছিলেন। ২৮শে অক্টোবরের ঘাতক এবং এক এগারোর ষণ্ডাদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়ার বিষয়টিও পরবর্তীতে স্পষ্ট হয়ে পড়ে। ২৮ শে অক্টোবরের এই বীভৎস ঘটনাটিকে উল্লেখ করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করলেও কে এর ঘাতক এবং কে এর শিকার, এই বিষয়টি উল্লেখ করেন নাই। বরং জালেম এবং মজলুমকে একই কাতারে ফেলে চিহ্নিত সুশীল (নিকৃষ্ট জ্ঞানপাপী) গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিরাজনীতিকিকরণের মিশনটি শুরু করেছিলেন। ইতিহাস এদের কাউকেই ক্ষমা করবে না।
এই ২৮শে অক্টোবরের পেছনে এর পেছনের কারিগরদের একটা সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক টার্গেট ছিল। সিঙ্গেল ইউনিটের একটি চমৎকার জাতি রাষ্ট্র যেখানে তেমন কোনো ধর্মীয় বা জাতিগত ফল্টলাইন বা ত্রুটিরেখা নেই। এমন একটি দেশ সাস্টেইনেবল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি করে ফেললে পার্শ্ববর্তী অনেকের জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে! কাজেই যে করেই হোক-এটাকে বাঁধা গ্রস্ত করতে হবে। একারণেই এদেশে বিশেষ চেতনার নামে টনকে টন ঘৃণার চাষ করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে সাংস্কৃতিক ও বিনোদন জগতের অনেক মাকাল ফলদের। এদের কাউকে কাউকে অত্যন্ত যতন করে জাতির বিবেক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্থায়ী একটা ত্রুটি রেখা বা ফল্টলাইন সৃষ্টি করার নিমিত্তে ২৮শে অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডব ছিল এদের প্রথম সফল মহড়া। এটা ছিল লগি-বৈঠা তাণ্ডবের সাংস্কৃতিক লক্ষ্য। বেহুঁশ জাতি! আমরা বিষয়টি টের পাই নি!
এর রাজনৈতিক টার্গেটটি ছিল আরো সুদূরপ্রসারী।
এক কৃষক ও চার চোরের গল্প অনুসরণ করে জামায়াতকে তখন আলাদাভাবে আক্রমণ করা হয়। চারদলীয়জোট সরকারের মূল দলটিকে এই আক্রমণ থেকে বাইরে রাখা হয়। বিএনপিকে সহ আক্রমণের এই টার্গেটটি করলে তখন সম্মিলিত প্রতিরোধের সামনে ষড়যন্ত্রকারীরা টিকতে পারতো না। মূল খেলাটি এভাবেই শুরু হয়েছে। ২৮ শে অক্টোবরে জামায়াতের এই কারবালায় জোটের বড় শরীক হিসাবে বিএনপির সহানুভূতি অথবা সহযোগিতা তেমনভাবে পায় নাই-এমন একটা অভিমান জামায়াতের মনে স্থায়ী হয়ে যায়। এটি জামায়াতকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে দিয়ে কৃষকের গল্পের পরের ধাপ শুরু করা হয়!
এবার শুরু করা হয় এক-এগারো নামে বিএনপির উপরে নতুন কারবালা। জামায়াতকে একটু আরামে রাখার সাথে সাথে সৎ মানুষের দল হিসাবে একটু পাম্প-পট্টিও দেওয়া হয়। “আল্লাহর আইন চাই, সৎলোকের শাসন চাই।” নিজেদের শ্লোগানের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ 'সৎ লোকের শাসন চাই' চিহ্নিত সুশীলদের মুখে শুনে জামায়াতের মন কমপক্ষে ৫০ ভাগ গলে যায়।
এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনা হয়। এবার এসে আবার জামায়াতকে ধরা হয় যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে (২০০৯-২০১৫ পর্যন্ত)। জামায়াতের প্রথম সারির সকল নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। জামায়াতের যে দুজন নেতা ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগের সাথে লিঁয়াজো করেছিলেন তাদের দুজনকেই সবার আগে ফাঁসি দেওয়া হয়। দেশের মিডিয়া ও সুশীল সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিএনপিকে 'ইয়া-নাফসি' মোডে রাখা হয়। বিএনপি সামান্য কাশি দিলেও বলা হতো যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতেই বিএনপি এসব করছে!
এভাবে জামায়াতের কোমড় মোটামুটিভাবে ভেঙে আবার চড়াও হয় বিএনপি তথা জিয়া পরিবারের উপর (২০১৬ থেকে আজ পর্যন্ত)!
জানি না, এই ধারাবাহিক খেলাটি এখানেই শেষ হবে নাকি সামনে আরও অনেক পর্ব দেখা যাবে!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন