মাহমুদুর রহমান
২০১০ সালে আমার দেশ পত্রিকায় ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শিরোনামে মন্তব্য-প্রতিবেদন লিখে আদালত অবমাননা মামলার আসামী হয়েছিলাম। সত্য কথা লিখে সুপ্রীম কোর্টে মাপ চাইতে রাজী না হওয়ায় সেই মামলায় আমার সাজাও হয়েছিল। বিচার বিভাগের কাঁধে সওয়ার হয়ে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ দখলের পরিকল্পনার বিষয় আমি বুঝলেও কেন বি এন পি এবং জামাতে ইসলামীর নীতিনির্ধারকরা বোঝেন নাই সে এক রহস্য। বরঞ্চ, আদালতের মুখোশ খুলে দেওয়া আগাম লেখালেখিতে তারা বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। আমার সমালোচনাকারিদের অভিমত ছিল আমি আদালতকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে তাদের বিপদে ফেলছি। দেশের জাদরেল সব আইনজীবীরা আদালত অবমাননা মামলায় আমাকে সুপ্রীম কোর্টের কাছে ক্ষমা চাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট চাপও দিয়েছিলেন। কিন্তু, আমার বিশ্বাসের কাছে আমি অটল থাকতে পেরেছিলাম। আইনজীবিদের সাথে মতপার্থক্যের কারণে শেষ পর্যন্ত ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থেকে আমার মামলা আমি নিজেই লড়েছিলাম।
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের না চটানোর কৌশল আখেরে বি এন পি এবং জামাতের কোন কাজে আসে নাই। বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে সরকারের দায়েরকৃত সকল মামলায় বিবেকহীন আওয়ামী বিচারকদের দল শেখ হাসিনার প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তাদের দুষ্কর্মের একটা তালিকা আজ সংক্ষেপে লিখে রেখে যাচ্ছি যাতে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের কালিমালিপ্ত ইতিহাস জানতে আমাদের বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের কোন সমস্যা না হয়।
১। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার হাইকোর্ট বেঞ্চ বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের দীর্ঘ দিনের সম্পূর্ণ আইনানুগ বাড়ি শেখ হাসিনাকে খুশি করবার জন্য ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষক, সেক্টর কমান্ডার এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিধবা স্ত্রীর প্রায় চল্লিশ বছরের মালিকানাধীন বাড়ি থেকে তাকে ২০১০ সালের নভেম্বরে নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা হয়। পুরষ্কার স্বরূপ বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা আপীল বিভাগে পদোন্নতি পান।
২। প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা এবং বিচারপতি মাহমুদ হাসান হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বিলুপ্ত করেন। এর সুযোগেই শেখ হাসিনা জনগণের রায় ব্যতিরেকে চৌদ্দ বছর ধরে বেআইনিভাবে একটানা ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছেন। এই চার জনকেই শেখ হাসিনা প্রধান বিচারপতির পদে বসিয়ে পুরষ্কৃত করেছেন।
৩। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা’র সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় (তার নিজের লেখা বইয়ের তথ্য অনুসারে) বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি এনায়েতুর রহীম ইত্যাদিরা দিল্লির নির্দেশে তথাকথিত আইসিটি মামলায় সাক্ষ্য আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে জামাতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং বি এন পির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দিয়েছে। এই পুরো বিচার প্রক্রিয়া যে সাজানো ছিল সেটাও আমার দেশ এবং দি ইকনোমিস্ট পত্রিকায় ২০১২ সালে স্কাইপ কেলেংকারী প্রকাশের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
৪। জজ কোর্টে বেগম খালেদা জিয়াকে বানোয়াট মামলায় প্রথমে সাজা দিয়েছেন বিচারক আখতারুজ্জামান। পরবর্তীতে হাইকোর্টে বিচারপতি এনায়েতুর রহীম বেগম খালেদা জিয়ার সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে অধিকতর কালিমালিপ্ত করেছেন। এই অপকর্মের পুরষ্কার স্বরূপ শেখ হাসিনা এই বিচারপতিকে আপীল বিভাগে পদোন্নতি দিয়েছেন।
৫। ২১ আগষ্ট মামলায় সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট সাক্ষ্যের উপর বি এন পির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানকে সাজা দিয়েছেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। এই মামলার চার্জশীটে তারেক রহমানের নাম পর্যন্ত ছিল না। শাহেদ নূর উদ্দিনকে হাইকোর্টের বিচারক বানিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়েছে।
৬। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় ভারতকে খুশি করবার জন্য আইনকানুনের কোনরকম তোয়াক্কা না করে মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিমকে ফাঁসির সাজা দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক এস এম মজিবর রহমান। আমার বুয়েটের বন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিমকে জেলখানায় বিনা চিকিৎসায় হত্যা করা হয়েছে। রেজ্জাকুল হায়দার ১৩ বছর ধরে কারাগারে আছেন। বিশেষ কোর্টের জজ এস এম মুজিবর রহমানকেও অন্য সকল দালাল বিচারকদের মতই পুরষ্কার দিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি বানানো হয়েছে।
৭। বিচার বিভাগে হাসিনার প্রধান তল্পিবাহক, প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক হাইকোর্টে বিচারপতি থাকাকালিন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলা যাবে না বলে রায় দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই নির্লজ্জভাবে বিকৃত করেছেন।
৮। হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মো: সাইফুর রহমান বি এন পির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের বক্তব্য বাংলাদেশের মিডিয়াতে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকের বাক এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার হরণের মাধ্যমে বিচারকের চেয়ারে বসে নির্দ্বিধায় সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।
৯। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এক এগারোর সরকারের দায়েরকৃত ডজনেরও অধিক মামলার প্রতিটি হাইকোর্টের আওয়ামী বিচারকরা খারিজ করে দিয়ে একই সরকারের বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো কেবল চালুই রাখেন নাই, তাকে অন্যায়ভাবে সাজাও দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের এই জাতীয় অপকর্মে নেতৃত্ব দানকারিদের মধ্যে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক অন্যতম।
১০। বিচারপতি নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদের আওয়ামী লীগের দলীয় শ্লোগান ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় শ্লোগান হিসাবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বাংলাদেশকে উত্তর কোরিয়ার মত এক চরম স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত করবার পথ প্রশস্ত করেছেন।
বিচার বিভাগকে আওয়ামী লীগ ও ভারতের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ এবং শেখ হাসিনার প্রতিহিংসা পালনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে মাত্র দশটি আমি উপরে উল্লেখ করেছি। একটি দেশের বিচারবিভাগে দলীয়করণের নিকৃষ্টতম নজির দেখতে হলে বাংলাদেশের বিচারবিভাগকে নথিপ্রমাণসহ আদর্শ ‘কেস স্টাডি’ হিসাবে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা সম্ভব। এক সময়ের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য পুলিশের চাইতেও অধিক দায় এই দেশের বিচার বিভাগকেই নিতে হবে। মনে পড়ছে, ২০১৩ সালে মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে আমার রিমান্ড চলাকালে পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে আমি এই মন্তব্য করলে তারাও লজ্জা পেয়ে কিছুটা সময় নিরব হয়ে পড়েছিল। আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার যুক্তিতর্ক চলাকালে আমি যখন বলেছিলাম যে, পত্রিকায় যা লিখেছি সব সত্য লিখেছি, তখন আপীল বিভাগের বিচারপতি আবদুল মতিন উপস্থিত সবাইকে চমকে দিয়ে সগর্বে বলেছিলেন, “Truth is no defence”। অর্থাৎ সংবাদের সত্যমিথ্যা নাকি বিচার্য্য বিষয় নয়। আমার উপর ক্রোধান্বিত বিচারপতি আবদুল মতিন হয়ত অনেকটা অজ্ঞাতেই সেদিন তার বক্তব্যের মাধ্যমে হাসিনার জামানায় বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রকৃত রূপ দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি শাসনের তৃতীয় পাঁচ বছর মেয়াদের অন্তিমে এসে বিবেকবিবর্জিত বিচারকের দল এখন মোফাজ্জল হোসেন মায়ার মত দুর্নীতিপরায়ন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পূর্বের সাজা থেকে মুক্তি দেয়া আরম্ভ করেছে। বেগম খালেদা জিয়ার মত বর্ষীয়ান, নিরাপরাধ, জনপ্রিয় নেত্রী চার বছরেরও বেশি সময় ধরে আদালত থেকে জামিন না পেলেও যুবলীগ নেতা সম্রাটের মত সকল সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের আওয়ামী আদালত ঠিকই জামিন দিচ্ছে। তারা হয়ত আশংকায় আছে যে, হাসিনার অবৈধ শাসনের পতন যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে। পাঠক এবার বলুন, এই পঁচে যাওয়া বিচার বিভাগ এবং বিচারকদের দিয়ে আমরা কি করব? বাংলাদেশ কোনদিন ফ্যাসিবাদের রাহুমুক্ত হলে আমার অবশ্য দুটি প্রস্তাব আছে। এক নম্বর প্রস্তাব, সরকার পরিবর্তনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে উচ্চ আদালতের (হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট) সকল বিচারককে একযোগে বরখাস্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভালমন্দ বাছবিচারের কোন অবকাশ রাখা যাবে না। ফ্যাসিবাদের সহযোগী বিচারকদের স্বপদে রেখে দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। আমার দুই নম্বর প্রস্তাব হল, সিনিয়র এবং অবিতর্কিত আইনজীবী ও একাডেমিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বিচারক নিয়োগ কমিশন’ গঠন করে বিচারপতিদের শূন্য পদে হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্টে নতুন বিচারপতিদের নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় যে সকল বিচারপতি মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন তাদের বিচার করতে হবে। ভবিষ্যতের সরকার আমার পরামর্শ ভেবে দেখতে পারেন।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন