অলিউল্লাহ নোমান
হুম্মাম কাদেরের শ্লোগান, বিএনপি’র বিব্রত হওয়া এবং ইন্ডিয়াপন্থি দালাল মিডিয়ার চুলকানি দেখতেছিলাম। ভারতের গোলাম ও আওয়ামী দালাল মিডিয়া গুলো বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির অস্তিত্ব নিয়ে কতটা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে সেটাই স্পষ্ট হয়েছে হুম্মাম কাদেরের শ্লোগানের পর। ইন্ডিয়াপন্থি দালাল মিডিয়া গুলোর একতরফা প্রচারণায় জাতীয় সংস্কৃতির অস্তিত্বকে পুরোপুরি মুছে দিতে সক্ষম হয়নি, এটা নিয়ে তাদের যত উদ্বেগ এখন।
হুম্মাম কাদেরের বক্তব্যের পর প্রিন্ট ও অনলাইন ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, সমকাল এবং এই গোত্রের ইন্ডিয়াপন্থি দালালদের চুলকানি এতটাই উঠেছে, শ্লোগানটি শোনার পর যেন তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আওয়ামী জামানায় তৈরি হওয়া ৭১ টেলিভিশন থেকে শুরু করে আরো কিছু টেলিভিশনে এই নিয়ে টক শো’র নারী উপস্থাপকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও কথা-বার্তা দেখে মনে হয়েছে, নিজেই যেন হুম্মাম কাদেরকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করে দিচ্ছেন।
ধন্যবাদ দিতে হয় শেখ হাসিনাকে। তিনি মিডিয়ার অনুমোদন দিতে ভুল করেন নি। কারণ, এই টেলিভিশন গুলো বিএনপি জামানায় তৈরি হওয়া প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মত নয়। সত্যকে আড়াল করে কথিত নিরপেক্ষ হওয়ার প্রতিযোগিতা করে না শেখ হাসিনার অনুমোদিত মিডিয়া গুলো। তারা নিজেদের এজেন্ডা অনুযায়ী খবর পরিবেশন, টকশো’র আয়োজন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মূল এজেন্ডা হচ্ছে, এদেশের জাতীয় সংস্কৃতিকে মুছে ফেলে বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে পশ্চিম বঙ্গের বিজাতীয় সংস্কৃতিকে মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া।
বিএনপি জামানায় তৈরি হওয়া মিডিয়া গুলোতে দেখেছি কথিত নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য সত্যকে আড়াল করার নিরন্তর চেষ্টা। নিয়োগ দেওয়ার সময় আওয়ামীদের প্রাধান্য দেখেছি তখন। আওয়ামীদের নিয়োগ দিলে নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, এমনটাই ছিল তাদের ধারণায়। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষার মত অবস্থা দেখেছি বিএনপির অনুমোদিত মিডিয়া গুলো চালু করার সময়। একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে এই প্রসঙ্গ থেকে বের হয়ে যাব। কারণ আজকের আলোচনা এই প্রসঙ্গে নয়।
দৈনিক আমার দেশ-যখন একেবারেই পরিকল্পনার মধ্যে তখন পত্রিকাটিতে যোগ দিতে হয়েছিল। রিপোর্টিং বিভাগে সর্ব প্রথম যোগদাতা ছিলাম আমি। তখনো দেশে প্রচার সংখ্যায় সর্বোচ্চে থাকা ইনকিলাব ছেড়ে প্রকাশের পরিকল্পনাধীন একটি প্রজেক্টে অনেক রিস্ক নিয়ে যোগ দিয়েছিলাম। পত্রিকা বের হওয়ার আগেই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম আওয়ামীদের প্রাধান্য দেখে। প্রকাশের পর দেখি পত্রিকাটির সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয়তেও কথিত নিরপেক্ষতার ভান করা হতো। ১/১১-এর জরুরী আইনের সময় সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ও বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান নয়া দিগন্তে লেখা শুরু করেন। তখনো তিনি সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান নন। তিনি তখন একজন শিল্প উদ্যোক্তা হিসাবেই পরিচিত। একই সঙ্গে শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহারও নয়া দিগন্তে লিখেন। তাদের দুইজনের লেখাই অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তৎকালীন আমার দেশ সম্পাদক আমানুল্লাহ কবীরের সাথে সম্পাদকের রুমে বসে একদিন গল্প করছিলাম। সাথে সম্পাদকীয় পাতার দায়িত্বে থাকা সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ছিলেন। আমি প্রস্তাব করলাম, মাহমুদুর রহমান এবং ফরহাদ মজহারের লেখা দেখলাম নয়া দিগন্তে অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাদেরকে আমাদের এখানে লেখার জন্য অনুরোধ করলে ভাল হত। তখন উপস্থিত থাকা সিনিয়র সহকারী সম্পাদক সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, এই দুইজনের লেখা একেবারে বেশি “পার্টিজান” হয়ে যায়। এতে পত্রিকার নিরপেক্ষতা থাকবে না। এটা শোনার পর সম্পাদক আমানুল্লাহ কবীর চুপ রইলেন। বুঝলাম এ বিষয়ে তিনি ওই সিনিয়র সহকারী সম্পাদকের বক্তব্যটিকেই সমর্থন জানাচ্ছেন। মনে মনে ভাবলাম, পত্রিকায় সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় নিরপেক্ষ হতে হয়ে এটা জানা ছিল না। কারণ, সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় লেখাই হয় কোন একটি চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার টার্গেট নিয়ে। তথ্য উপাত্ত ও যুক্তি দিয়ে একটি চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা থাকে সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়তে।
এই দিক থেকে শেখ হাসিনার অনুগত ইন্ডিয়ান দালাল সাংবাদিকরা তাদের চিন্তার সাথে আপস করে না। তাদের টার্গেট অনুযায়ী চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে দেখা যায়। যেমনটা দেখা গেছে হুম্মাম কাদেরের শ্লোগান নিয়ে। তাদের চিন্তা বিএনপি’র ঘাড়ে কতটা চাপাতে সক্ষম হয়েছে দলটির কতিপয় নেতার বিব্রত হওয়া দেখেই অনুমান করা যায়। তারা যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে বিব্রত হওয়া তাই প্রমান করে।
আরেকটি বিষয় এখানে স্পষ্ট। হুম্মাম কাদেরের নারায়ে তাকবীর শ্লোগানে চুলকানি উঠলেও ওবায়দুল কাদের দুর্গাপূজায় গিয়ে দেবী দুর্গার সাহায্য কামনা করার মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িকতা খুজে পায় না দালাল মিডিয়া গুলো। বরং একটি বিশেষ ধর্মীয় উৎসবকে বাংলাদেশের সকল মানুষের উৎসব হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচারণায় দেখা যায় এই দালালদের।
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি দু’টি শ্লোগান নিয়ে বিভক্তি আছে। জয়-বাংলা এবং বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ। কিন্তু ‘নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার’ শ্লোগানে কোন বিভক্তি দেখিনি কখনো। প্রতিটি সভা, সমাবেশ, ওয়াজ মাহফিল এবং নানা দাবী-দাওয়ার মিছিলে প্রথমে শ্লোগান ধরা হতো নারায়ে তাকবীর দিয়ে। দলমত নির্বিশেষে এই শ্লোগান দিতে দেখা গেছে তখন। এই শ্লোগান নিজেও দিয়েছি অনেক। নারায়ে তাকবীর শ্লোগানটি কতিপয় অতি বামপন্থি ছাড়া সব রাজনৈতিক দলের পোষ্টারে ও দাওয়াতনামায় দেখা যেত। সব দলের প্রার্থীর নির্বাচনী পোস্টারের শিরোনামে থাকতে দেখা যায় নারায়ে তাকবীর শ্লোগান নারায়ে তাকবীর নিয়ে কখনো কারো আপত্তি করতে দেখা যায়নি। হুম্মামের মুখে এই শ্লোগান উচ্চারিত হওয়ার পর বিভক্তির রেখা ফুটে উঠেছে। চুলকানি উঠেতে দেখা গেছে ভারতীয় দালাল মিডিয়া ও তাদের অনুগতদের। এই চুলকানির মূল কারণ হচ্ছে, এই দেশ থেকে জাতীয় সংস্কৃতিকে মুছে ফেলা।
বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বিব্রত হওয়ার খবর দেখার পর দলটির চার মূলনীতি ও ১৯ দফা কর্মসূচির দিকে আবারো চোখ বুলানোর চেষ্টা করলাম। দেখলাম যে, ঠিকই রয়েছে চার মূলনীতি ও ১৯ দফা। তাতে কোন পরিবর্তন আসেনি। এখনো চার মূলনীতির প্রথমটি হচ্ছে সকল কাজে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্তা ও বিশ্বাস। যদিও দলটির ৩ নেতা ২০১৭ সালে ভারতে গিয়ে ঘোষণা করে এসেছিলেন ১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশকের নীতি জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। নারায়ে তাকবীরে বিব্রত হওয়া দেখে মনে মনে চিন্তা করেছিলাম তাহলে হয়ত মূলনীতি এবং ১৯ দফায়ও পরিবর্তন এসেছে। তবে, দেখলাম কোন পরিবর্তন আসেনি। আগের মতই রয়েছে।
দলটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মূল শ্লোগান ছিল “নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার।” এই শ্লোগানের মাধ্যমেই সেদিন জাসদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও ষড়যন্ত্র উড়ে গিয়েছিল। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদ। কিন্তু জিয়াউর রহমানকে সামনে পেয়ে সিপাহি জনতা নারায়ে তাকবীর শ্লোগান ধরার পর ভেসে গিয়েছিল জাসদের সেই খায়েস। সবই হারিয়ে গিয়েছিল নারায়ে তাকবীরের আওয়াজে। দিশেহারা মানুষ সেদিন নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছিল এই শ্লোগানের মধ্যে।
পরবর্তীতে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেছিলেন। পরিবর্তন এনেছিলেন চার মূলনীতিতে। সংবিধানের চার মূলনীতির প্রথমটি ছিল সকল কাজে সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র উপর আস্থা ও বিশ্বাস। এখনো বিএনপি’র গঠনতন্ত্রের চার মূলনীতিতে এ গুলো বিদ্যমান রয়েছে।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বেশি প্রচারণা ছিল আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে সংবিধানের শুরু থেকে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বাদ দেওয়া হবে। সংবিধান থেকে আল্লাহর নাম মুছে ফেলা হবে। তাই আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়ে বিএনপিকে ভোট দিতে হবে। বিএনপিকে ভোট দিলে সংবিধানে আল্লাহর নাম থাকবে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম থাকবে। দলটির চেয়ারপার্সন বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায়ও এই কথা উচ্চারণ করেছেন।
অনেকেই বর্তমান দুনিয়ার প্রেক্ষাপট এবং পশ্চিমাদের খুশি করার জন্য নারায়ে তাকবীর নিয়ে কৌশলী হওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। দেশের মানুষের জাতীয় সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে কৌশলী হওয়ার মধ্যে কোন ফায়দা আছে কি না সেটা আমার জানা নেই। রাজনীতির মূল লক্ষ্য যদি হয় দেশের সার্বভৌমত্ব। যেটা বিএনপি’র ১৯ দফার প্রথম দফা। তাহলে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় সংস্কৃতির সাথে আপস করে কাউকে খুশি করার রাজনীতিতে ফায়দা কি সেটা একটি বড় প্রশ্ন। যদি আমার জাতীয় সংস্কৃতির অস্তিত্বই না থাকে শুধু মানচিত্র দিয়েই বা লাভ কী?
লেখকঃ সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন