মিনার রশিদ
বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশের যে পরিকল্পনা বিএনপি গ্রহণ করেছে তারই অংশ হিসাবে ১২ই অক্টোবর চট্টগ্রামে এবং আজ ময়মনসিংহে সমাবেশ করেছে। জনসভার দিনে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এবং পথে পথে লাঠিয়াল বাহিনী মোতায়েন করেও সরকার বিশাল জনসমাগম ঠেকাতে পারছে না! সমাবেশগুলিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অনেকের কপালে ভাজ ফেলে দিয়েছে! “বিএনপি মুসলিম লীগ বনে গেছে”, “বিএনপি শেষ হয়ে গেছে”- এসব কথা বলে যারা পরম তৃপ্তি লাভ করতেন তাদের জন্যেও চরম মনকষ্টের কারণ হয়েছে।
এই সমাবেশগুলি যেমন এদেশের গণতন্ত্র-মনা মানুষকে আশান্বিত করেছে তেমনি এই দেশ ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের শত্রু এবং তাদের দেশীয় এজেন্টদের নিরাশ করেছে। বিএনপির মত একটি দলের উপর গত ১৬ বছর যাবত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালিয়েও এই দলটিকে নিঃশেষ করা যাচ্ছে না কেন? এর জীবনী শক্তিটি আসলে কোথায়?
প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের ব্রেইন চাইল্ড ছিল তথাকথিত এক এগারোর জরুরি সরকার। আর সেই এক-এগারোর ফিজিক্যাল চাইল্ড হলো বর্তমান ফ্যাসিবাদি সরকার! সেই হিসাবে ফ্যাসিবাদি সরকারের দাদা-নানা হলো প্রথম আলো-ডেইলি স্টার! সেই সম্পর্ক বা অন্তরের টান এখনও অটুট রয়েছে! আলো-স্টার চক্র এক এগারোর মাধ্যমে এই ফ্যাসিবাদকে শুধু ক্ষমতাতেই বসায় নি- তাদেরকে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় টিকে থাকতেও সহায়তা করে যাচ্ছে!
ফলে এই সমাবেশগুলি প্রথম আলো, ডেইলি স্টারদেরও মনোবেদনার কারণ হচ্ছে। আর তারই প্রকাশ ঘটছে এদের সাম্প্রতিক কিছু নড়াচড়ায়।
চট্টগ্রামের সেই বিশাল জন সভায় বিএনপির নেতৃবর্গ অনেক কথা বললেও এদের কানে বেজেছে শুধু তরুণ হুম্মাম কাদেরের শ্লোগানটি! বিশেষ চেতনায় হাওয়া দিতে ডেইলি স্টার শিরোনাম করেছে, সমাবেশে ‘নারায়ে তাকবীর’ শ্লোগান দিয়ে আলোচনায় সাকার ছেলে! একই মতলবে প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, সাকার ছেলের শ্লোগান নিয়ে বিএনপি নেতারা যা বললেন!
বিজেপি সহ অনেক ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল পার্টি ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দেয়। এটা নিয়ে সেদেশের প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারদের গা চুলকায় না! এসবকে সেদেশের কোনো পত্রপত্রিকা সাম্প্রদায়িক শ্লোগান হিসাবে অভিহিত করে না! বিশ্বের অনেক মডার্ন এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বেও এই ফেইথ বেইজড শ্লোগান সমূহ শোনা যায়। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বেও “Christ is King”, “We Already Have a Savior”, “Kingdom First”, “Light Trumps Darkness”, “Faith Trumps Fear”, or “Vote Your Conscience.” এই ধরণের ধর্ম বা বিশ্বাস মিশ্রিত রাজনৈতিক শ্লোগান শোনা যায় । হিউম্যান ডিগনিটি এবং গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কেউ যদি তাদের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের চর্চা করে তাতে সভ্য দুনিয়া কোনো আপত্তি তুলে না ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার' এই শ্লোগানটি স্বয়ং আওয়ামী লীগ তাদের অনেক লিফলেটে ব্যবহার করেছে।
শুধু ধর্মভিত্তিক দলগুলোই নহে, সেক্যুলার বলে দাবিদার দলগুলোও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারে পিছিয়ে নেই!
রাজিব গান্ধীও তাঁর অনেক জনসভায় রাম রাজত্ব কায়েমের কথা প্রকাশ্যে বলেছেন। তখন মঞ্চে উপস্থিত বা বাইরে অবস্থানরত অনেক মুসলিম নেতা তাতে অস্বস্তি প্রকাশ করেন নি। বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বেগম খালেদা জিয়াকে একবার মা দুর্গার সাথে তুলনা করেছিলেন। তাতে বিএনপির কেউ আপত্তি তুলে নাই। আমাদের কওমী জননীও মদিনার সনদ অনুযায়ী রাষ্ট্র চালানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন! তখন আলো-স্টার চক্র এটা নিয়ে কোথাও কোনো হাওয়া দেয় নাই, কোনো আওয়ামী নেতা বা বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া জানতে চায় নাই, এই ঘোষণা শুনে মনের কষ্ট কমানোর জন্যে জাফর ইকবাল বৃষ্টিতে ভিজেন নাই।
কাজেই হুম্মাম কাদেরের শ্লোগানের পর কতিপয় বিএনপি নেতা যেভাবে এবং যে-ভাষায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তা অনেককে হতবাক করেছে। আমি নিজেও হুম্মাম কাদেরের এই শ্লোগানকে বিএনপি প্লাটফর্মে এপ্রোপ্রিয়েট অথবা পলিটিক্যালি কারেক্ট বলে গণ্য করি না কারণ এর মাধ্যমে শত্রুরা অনেক ভুল বার্তা গ্লোবাল পরিসরে ছড়িয়ে দিতে পারে। যা ফ্যাসিবাদ অপসারণে আমাদের মূল সংগ্রামটিকে ব্যাহত করতে পারে! হুম্মাম কাদের সহ বিএনপির তরুণ নেতাদেরও এই ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। সম্মুখে দন্ডায়মান দানবকে পরাভূত করতে আবেগের চেয়ে প্রজ্ঞার ব্যবহার বেশি করতে হবে।
দেশের ভেতরে আলো-স্টার চক্র এবং বাইরে এদের স্পন্সররা বিশ্ব বিবেককে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে। প্রতিপক্ষকে আল-কায়েদা বলে অভিহিত করে আলো-স্টার-বাকশাল নামে একটা আল-ফায়দা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে।
খুশীর খবর যে বিশ্ব এই আল-ফায়েদা (আল-কায়েদাকে যারা ফায়দা বা সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়েছে) গ্রুপটির চেহারা চিনে ফেলেছে। আগের মত জঙ্গি কার্ড আর কাজে লাগছে না। কাজেই এখন বুদ্ধিমত্তার সাথে সামনে এগোতে হবে। কোনোরূপ ভুল করা যাবে না।
বিএনপির কিছু নেতাদের নিয়ে সমস্যা হলো, ইনারা একদিকে দৃষ্টি দিলে অন্য দিক পুরো বন্ধ করে দেন! গ্লোবাল কনসার্নকে এড্রেস করতে গিয়ে স্থানীয় আবেগ-অনুভূতিকে মুচড়িয়ে ফেলেন! আরো হতাশার ব্যাপার হলো, বিএনপির অনেক নেতা প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের এই কারসাজিটুকু ধরতে পারেন না! প্রথম আলো, ডেইলি স্টার খুঁজে খুঁজে সেই সব নেতাদের প্রশ্ন করে এবং তাদের মনের মত জবাবগুলি বের করে নেয়। মতলববাজ মিডিয়ার বাতাস দেওয়ার মেকানিজমটি বুঝতে না পেরে কুটিল প্রশ্নের প্রশ্নের সরল জবাব দিয়ে বসেন। অথচ এই সব প্রশ্নের জবাব আরেকটি প্রশ্ন দিয়েই দেয়া উচিত। মতলববাজ মিডিয়াকে মোকাবেলার মুন্সিয়ানা ইনারা আয়ত্ত্ব করতে পারেন নাই। অথবা ইনারা এমন মুন্সি সেজেছেন যে মুন্সি জানেন না উনি কার শিরণী খাচ্ছেন!
নিজ দলের মরহুম এক নেতার প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক নেতার ঘনায়িত এবং চেতনায়িত ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা দায় যে ইনি আসলে বিএনপি নেতা নাকি ঘাদানিক নেতা?
ভদ্রলোক যে ক্ষ্যাপা খেপেছেন তাতে মনে হয়, শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী এবং যাদুমিয়ার মত রাজাকারকে মন্ত্রী করার অপরাধে জিয়ার কবর ইনি নিজ হাতেই সরিয়ে ফেলবেন, শেখ হাসিনার আর দরকার পড়বে না! আর সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস যোগ করে এবং শুরুতে বিসমিল্লাহ যোগ করে জিয়া যে অমার্জনীয় অপরাধ (?) করেছেন, সেটার বিচার তাহলে কীভাবে করবেন আল্ট্রা সেক্যুলার এই মহান জাতীয়তাবাদী নেতা? আল্লাহু আকবার বললে যদি ধর্ম ব্যবসা হয় তবে 'বিসমিল্লাহ' বললে হবে না কেন?
বিএনপির নেতৃত্বের অনেকেই ভুলে গেছেন যে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সংহতি ও বিপ্লবে এই ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগানটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। কর্ণেল তাহেরদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলার জন্যে সুসংগঠিত কোনো শক্তি সেদিন ছিল না। কিন্তু রাস্তায় নেমে আসা কিছুসংখ্যক ছাত্রজনতার সাথে সৈনিকরা যখন আল্লাহু আকবার শ্লোগান দেন, তখন মুহূর্তেই পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায় এবং কর্ণেল তাহেরদের সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্ন মুহূর্তেই ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়।
এই শ্লোগানটি সেদিন শুধু শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াকেই রক্ষা করে নাই, পুরো জাতিকে রক্ষা করেছিল। এই শ্লোগানের প্রতি মতি-মাহফুজদের ভয়টি সম্ভবত সেখান থেকেই শুরু!
নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্যে এখানে আল্লাহু আকবার শ্লোগানের কিছু ইতিহাস তুলে ধরলাম মাত্র। এই শ্লোগানকে বিএনপির দলীয় শ্লোগান বানানোর পক্ষে ওকালতি করছি না। সেটার প্রয়োজনও নেই। কারণ বিএনপি অনেক মত ও ধর্মের মানুষ নিয়ে তৈরি একটি মডারেট গণতান্ত্রিক দল।
উপরে বর্ণিত সকল স্থানীয় আবেগ ও প্রত্যাশা এবং গ্লোবাল রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিয়েই বিএনপিকে তার রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। নিজের বিশাল সর্তক গোষ্ঠীর আবেগকে যেমন আহত করা যাবে না তেমনি বিশ্ব পরিস্থিতি যেভাবে অনুকূলে এসেছে সেটাকেও দূরে ঠেলা যাবে না!
আর এই কাজটি সুচারুরূপে করার জন্যেই দরকার সকল স্তরে প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব।
বিএনপির কিছু নেতাদের নিয়ে সমস্যা হলো, ইনারা একদিকে দৃষ্টি দিলে অন্য দিক পুরো বন্ধ করে দেন! গ্লোবাল কনসার্নকে এড্রেস করতে গিয়ে স্থানীয় আবেগ-অনুভূতিকে মুচড়িয়ে ফেলেন! আরো হতাশার ব্যাপার হলো, বিএনপির অনেক নেতা প্রথম আলো - ডেইলি স্টারের এই কারসাজিটুকু ধরতে পারেন না! প্রথম আলো, ডেইলি স্টার খুঁজে খুঁজে সেই সব নেতাদের প্রশ্ন করে এবং তাদের মনের মত জবাবগুলি বের করে নেয়। মতলববাজ মিডিয়ার বাতাস দেওয়ার মেকানিজমটি বুঝতে না পেরে কুটিল প্রশ্নের প্রশ্নের সরল জবাব দিয়ে বসেন। অথচ এই সব প্রশ্নের জবাব আরেকটি প্রশ্ন দিয়েই দেয়া উচিত। মতলববাজ মিডিয়াকে মোকাবেলার মুন্সিয়ানা ইনারা আয়ত্ত্ব করতে পারেন নাই। অথবা ইনারা এমন মুন্সি সেজেছেন যে মুন্সি জানেন না উনি কার শিরণী খাচ্ছেন!
উপরে বর্ণিত সকল স্থানীয় আবেগ ও প্রত্যাশা এবং গ্লোবাল রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিয়েই বিএনপিকে তার রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। নিজের বিশাল সার্থক গোষ্ঠীর আবেগকে যেমন আহত করা যাবে না তেমনি বিশ্ব পরিস্থিতি যেভাবে অনুকূলে এসেছে সেটাকেও দূরে ঠেলা যাবে না! আর এই কাজটি সুচারুরূপে করার জন্যেই দরকার সকল স্তরে প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব।
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন