মিনার রশিদ
২০১৮ সালের ১৫ ই সেপ্টেম্বরে একটি পোষ্ট দিয়েছিলাম। বিএনপি তখন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্য জোট এবং বিশদলীয় জোটকে নিয়ে বিপদগ্রস্ত স্বামীর ভূমিকায়! যে স্বামী এক স্ত্রীকে অন্য স্ত্রীর মোকাবেলার সাহস পায় না। সেদিনের সেই লেখার শিরোনামটি ছিল, নিজের অবস্থান থেকেই বিএনপিকে জাতীয় ঐক্য করতে হবে। দেশের রাজনীতিতে কাগুজে বাঘদের উপর নির্ভরতার ঝুঁকিটুকুও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। দেশের তথাকথিত মূলধারার মিডিয়া এবং তাদেরই প্রমোটেড সুশীল সমাজ কানাঅলার (এক প্রকার মেছো ভূত) মত রাজনীতিকে বার বার ভুল পথে ধাবিত করেছিল! এতে শুধু বিএনপি নয়, দেশের পুরো রাজনীতি ও গণতন্ত্র পথ হারিয়েছিল!
আজকের আলোচনার প্রয়োজনে তখনকার পোষ্টের কয়েকটি লাইন উল্লেখ করছি!
“বিএনপি মহল থেকে এখন জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচনের দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। এটিকে সাধুবাদ জানাচ্ছি । কিন্তু এই দাবিটিকে সার্বজনীন করার নিমিত্তে আগামী ৫ টি সাধারণ নির্বাচন জাতিসংঘের অধীনে করার দাবি যুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি । কারণ তাতে প্রমাণিত হবে বিএনপি শুধু নিজে ক্ষমতায় আসার জন্যে এই দাবি তুলছে না । এর মাধ্যমে শুধু বর্তমান জালিম সরকারই দূর হবে না । ভবিষ্যতে অন্য কোনো জালিম তৈরির রাস্তাও বন্ধ হবে। ২০১৬ সালের জানুয়ারী মাসে প্রকাশিত আমার এ সংক্রান্ত কলাম (দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত) ও ফেইসবুক পোষ্টটি দেয়া হলো।”
আমার দেশ সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমান সহ আরো অনেক ইন্টেলেকচুয়াল বিভিন্ন সময় এই দাবিটি তুলেছেন। পরবর্তীতে রাজনীতিবিদদের মধ্যে জনাব নুরুল হক নুরু এবং রেজা কিবরিয়াও (২০২১ সালে) এই দাবিটি তুলেছিলেন।
জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচনের এই দাবিটি ক্ষণেকের জন্যে তখন (২০১৮ সালের মাঝামাঝি) আশার আলো জাগালেও কিছুদিন পরেই ড. কামাল হোসেন বন্দনায় মেতে উঠে! বলা হয়, ড. কামাল হোসেন তাঁর গ্লোবাল কানেকশন কাজে লাগিয়ে বাকশালী হাসিনাকে চোখের পলকেই হাওয়া করে দিবেন ।এই সুখ স্বপ্ন দেখিয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে পুরো পজ বা নিস্তেজ করে ফেলা হয়। ড. কামাল হয়ে পড়েন গরীব শ্বশুরের মহা বড়লোক জামাই! বিএনপির ঘরে এই বড়লোক জামাই শ্বশুরের নাম উচ্চারণ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন! বিএনপিকে সেটাই হজম করে নিতে হয়!
টাফ পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশনের জন্যে ঐক্যজোটের নেতারা সেসময় গণভবনে গমন করলেও সেটিকে পুরনো স্মৃতি রোমন্থনের সুখময় আড্ডা বানিয়ে ফেলা হয়। ড. কামাল হোসেনের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্ব প্রাক্তন মালকিনের সম্মুখে মোমের মত গলে যায়।
২০১৮ সালে যে ফ্যানোমেনা ছিল ২০২৩ এর প্রাক্কালে এসে সেই একই সুড়ং সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে! একই কানাঅলারা ভিন্ন ভূমিকায় অগ্রসর হচ্ছেন।
এসব সুড়ঙ্গ বন্ধ এবং ফাঁদ নিষ্ক্রিয় করতে হলে ফ্যাসিবাদের আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক শক্তি এবং দুর্বলতাগুলি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা দরকার। তারপর সে অনুযায়ী কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা। চিহ্নিত কানাঅলাদের নিবৃত বা নিষ্ক্রিয় করতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরবর্তী কয়েকটি নির্বাচনের দাবি নিয়ে অগ্রসর হওয়া দরকার ।
একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশেই সাধারণত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্ন আসে। কারণ সেসব দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন কার্যকর থাকে না। বাংলাদেশে কোন যুদ্ধ না হলেও বর্তমান সরকার পুরো রাষ্ট্রীয় ইন্সটিটিউশনগুলিকে ধ্বংস করে ফেলেছে । এই বাস্তব সত্যটি জাতিসংঘ সহ বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশে পৌঁছে গেছে। ফলে এ ব্যাপারে আমাদেরকে আর খুব বেশি শক্তি ক্ষয় করতে হবে না। গ্লোবাল রাজনীতিও আজ এই দাবির যথার্থতা মেনে নিবে! বর্তমান পৃথিবী কোনো ধরনের উগ্রতা এফোর্ড করতে পারবে না- সেটি ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো অন্ধ চেতনাজাত হোক না কেন! গতবছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ চাইলে জাতিসংঘ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবে!
বর্তমান সরকার যে বাঘের পিঠে চড়ে বসেছে সেখান থেকে এখন নামতে ভয় পাচ্ছে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী সম্ভাব্য সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে এই শান্তিরক্ষী বাহিনী আরো ছয় মাস অবস্থান করতে পারে! তাতে বাঘের পিঠ থেকে নামার ওবায়দুল কাদেরদের এই ভয়টি কমে যাবে।
কী কারণে এই পদক্ষেপটি জরুরি তা আমার ২০১৬ সালের লেখা থেকেই তুলে ধরছি। আগের সেই যুক্তিগুলি এখনো প্রাসঙ্গিক বলে নিচে তা আপনাদের খেদমতে আবারো পেশ করছি!
“এমতাবস্থায় বিশদলীয় জোট নেতৃত্বের একমাত্র দাবি হবে, জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে অতি শিগগিরই একটি সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কোনোরূপ অস্পষ্টতা না রেখে সুস্পষ্ট উচ্চারণে এই দাবিটি তোলা দরকার। বর্তমান সরকার দেশের প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে এমনভাবে ধ্বংস করে ফেলেছে যে দেশের ভেতরের কোনো শক্তি বা গোষ্ঠী দিয়ে এই কাজটি আর সম্ভব হবে না। এ দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প হাতে নেই। স্বামী স্ত্রী যখন নিজেদের মধ্যকার দাম্পত্য সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারে না, তখন বাইরের কোনো সুহৃদের সাহায্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। ওই দম্পতির ছেলেমেয়ের জন্য বিষয়টি যেমন জরুরি, এ দেশের ১৬ কোটি (২০১৬ সালে) মানুষের জন্য বিষয়টি তার চেয়েও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।
একটা বিশেষ মতলব থেকে আগে থেকেই দেশের নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকলাঙ্গ করে ফেলা হয়েছে। হয় আমার দলে, না হয় তার দলে- এ ধরনের বুশীয় উন্মাদনায় দেশের সব নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিত্বকে সমূলে বিনাশ করা হয়েছে। সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির সংখ্যা এ দেশে মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এই ঘরানার যে কয়জন অবশিষ্ট ছিলেন তাদেরও ‘মুই কার খালু’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকেও অতি চালাকির মাধ্যমে বিতর্কিত করে ফেলা হয়েছে। এই ব্যবস্থাটি আবার ফিরিয়ে এনে কতটুকু কার্যকর করা যাবে তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দেশের গণমাধ্যমগুলোও মারাত্মকভাবে একপেশে হয়ে পড়েছে। এরা কখনো তিলকে তাল বানায়, আবার কখনো আস্ত তিলকেই ভ্যানিশ করে দেয়। কাজেই সবকিছু বিবেচনায় আগামী পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন এই জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার।
বিএনপি জোটকে শুধু সামনের একটা নির্বাচনের দাবি নয়, পরপর পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন জাতিসঙ্ঘের আওতায় অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে জনগণের সম্মুখে উপস্থিত হওয়া দরকার। তখন স্পষ্ট হবে এটা শুধু নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, দেশ ও দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্যই এই দাবিটি তোলা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তাতে সামনের পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হলে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কাঙ্ক্ষিত একটা জায়গায় ফিরে আসবে বলে অনুমিত হয়। জনগণের সার্বিক সচেতনতায় তখন জবাবদিহিতার একটা কালচারও সমাজ ও প্রশাসনের সর্বস্তরে গড়ে উঠবে।
আমাদের সেনাবাহিনী জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সুনাম ও দক্ষতার সাথে কাজ করছে। অন্যান্য দেশ থেকে কিছু পর্যবেক্ষক রেখে বাদবাকি জায়গায় আমাদের সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যের ব্যবহারের মাধ্যমে এই কাজটি সহজেই করতে পারে জাতিসঙ্ঘ।
এই দেশটি একটি কলিসন কোর্সে রয়েছে। আমরা এখনই যদি একটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তবে নির্দিষ্ট সময় পরে একটা মারাত্মক বিস্ফোরণ বা সংঘাতের সৃষ্টি হবে। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিটিও হয়ে পড়বে ইরাক, আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মতো কিংবা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কোনো জায়গা। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথে যদি জনগণের ক্ষোভ, হতাশা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, অনুভূতি প্রভৃতিকে প্রবাহিত করা না যায় তবে এ ধরনের বিস্ফোরণ অনিবার্য। গণতন্ত্রহীনতা মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, আমরা তা নিজের চোখে দেখছি। আবার গণতন্ত্রের কল্যাণে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে যে সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি হয়েছে তাও আমাদের চোখে পড়ছে।বর্তমানে যে রাজনৈতিক বিশ্বাসই ধারণ করি না কেন, তখন আমরা কেউ এর পরিণাম থেকে আত্মরক্ষা করতে পারব না। একবার ওই পর্যায়ে চলে গেলে সেখান থেকে শত চেষ্টা করেও আর ফিরে আসতে পারব না। কাজেই যা করার এখনই সময়।
এ দেশের একজন নগণ্য নাগরিক হিসেবে সবার কাছে নিবেদন, আসুন সময় থাকতে সবাই সজাগ হই। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের ১০ ফোঁড়ের সমান। একদিন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি নামে কোনো দল হয়তোবা এ দেশে থাকবে না। কিন্তু এই দেশটিকে টিকে থাকতে হবে। আমার আপনার সামান্য ক্ষোভ, হতাশা, লোভ যেন ১৬ কোটি (২০১৬ সালে) আত্মা এবং তাদের আগত প্রজন্মকে মারাত্মক বিপদে না ফেলে। আজকে যে মহাপরাক্রমশালী পুলিশ বা আর্মি অফিসার আছেন, আগামী দিন হয়তোবা তারই কোনো রক্তের উত্তরসূরি ইরাক-সিরিয়ার অসহায় নারী ও শিশুর মতো বোমা বা গোলার আঘাতে জর্জরিত হবে। আমার আপনার রক্তের উত্তরসূরির কান্নায় বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত হবে। কোনো সম্মিলিত বাহিনীর স্মার্টবোমা যত স্মার্ট হোক, তখন আওয়ামী লীগ আর বিএনপির উত্তরসূরি বা ঘরবাড়ির মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না।
আমাদের মানতে হবে যে, এই দেশটি যেমন আওয়ামী লীগের, তেমনিভাবে এই দেশটি বিএনপির, এই দেশটি জামায়াতের, এই দেশটি অন্য সবার। এদের কাউকেই এই দেশ থেকে বের করে দেয়া সম্ভব হবে না। এমনকি জামায়াতের যে জনসংখ্যা রয়েছে তা শ্রীলঙ্কার মতো দেশের সর্বসাকুল্য জনসংখ্যার সমান। এসব মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব হবে না। সবাইকে নিয়েই এই দেশটিতে থাকতে হবে। সবাইকে নিয়ে থাকার ফর্মুলা বের করতে হবে। কোনো ক্রুদ্ধ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আদর্শ দিয়ে বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। তা করতে গিয়ে শুধু এই সোনার দেশটিকে জাহান্নাম বানিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
এ ধরনের সর্বনাশা পরিণতি থেকে জাতিকে রক্ষা করতে দেশের বিবেকবান ও সচেতন অংশকে এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য জাতিসঙ্ঘের অধীনে আগামী পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলতে হবে। এ দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকারসহ সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে এই দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান সময় ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এর কোনো বিকল্প নেই।"
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন