মিনার রশিদ
অনেকদিন আগে কোনো এক কলামে লিখেছিলাম যে এদেশের নারীদের চেয়েও অবলা এদেশের শিক্ষিত, ভদ্র ও সৎ মানুষগুলো। কাজেই সংসদে যদি নারীদের জন্যে আলাদাভাবে সংরক্ষিত আসন থাকতে পারে তবে এই অবলাদের জন্যেও কিছু সংরক্ষিত আসন রাখা দরকার। আমার সেই চাওয়াটিই একটি ভিন্ন রকমে ফুটে উঠেছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠণের প্রস্তাবনায়। আশা করব, আমার বিষয়ে আপনার মন থেকে বদ্ধমূল ধারণা সরিয়ে যে কথাগুলো লিখছি তার বিষয়বস্তুর উপর মনোযোগ দেন। এতে আপনার ভবিষ্যত প্রজন্ম ও হতভাগা দেশটির বহুত ফায়দা হবে।
বিষয়টি নিয়ে আমি সকলকে একাডেমিক গবেষণার আহ্বান জানাচ্ছি!
আমরা জেনে এসেছি বা বিভিন্ন কায়দায় জানানো হয়েছে যে রাজনীতি বা পলিটিক্স হল একটা ডার্টি বা নোংরা জায়গা! ফলে যারা নিজেদেরকে ভালো মানুষ বা গুডবয় মনে করেন তারা রাজনীতিতে আসেন না, রাজনীতি নিয়ে কথাও বলেন না। এদের অনেকেই দেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়েছেন। সেসব দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মেওয়া উপভোগ করেন। অথচ এসব তৈরিতে যে সেসব দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি কাজ করেছে সে সব কথা ভুলে যান।
এভাবে রাজনীতিকে ছেড়ে আসলেও রাজনীতি কিন্তু আমাদেরকে ছাড়ে না। বরং আমাদের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ, আনন্দ-বেদনার সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করে এই রাজনীতি! একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে আইনের শাসন , বাক স্বাধীনতা ও সকল মানবিক কমফোর্ট এনে দিতে পারে এই রাজনীতি।
রাজনীতি বা পলিটিক্স শব্দটিকে প্রতারণার প্রতিশব্দ হিসাবে ছড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে নীতিহীন কিছু রাজনীতিবিদ তাদের ধারণাকে পোক্ত করেছে, হতাশাবাদীদের হতাশার পক্ষে অনেক উদাহরণ জুগিয়েছে। কেউ কারও সাথে প্রতারণা করলে বলা হয়, হুম! আমার সাথে পলিটিক্স করা হচ্ছে?
অথচ একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় এই রাজনীতির মাধ্যমে। যারা রাজনীতিকে ঘৃণা করেন তারাও চান দেশটির সবকিছু ঠিক ঠাক মত চলুক। সত্যিই আজব চাওয়া! অর্থাৎ ইনারা টিকেট কাটেন থার্ড ক্লাসের কিন্তু ভ্রমণ করতে চান ফার্ষ্ট ক্লাসে!
এমতাবস্থায় বুঝানো আরও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে যে ভালো মানুষ আসছে না বলেই রাজনীতির গুণগত মানের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না! এই দুষ্ট চক্রে আমরা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছি! ফলে দুর্বৃত্তায়ন বা ক্রিমিনাইলেজশনের হাত থেকে রাজনীতিকে বের করা সম্ভব হচ্ছে না, বরং আরো অন্ধকার গহ্বরের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি!
সমস্যার এই জটিলতা নিয়ে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমরা যে জায়গায় ছিলাম, ২০২২ সালে এসে আরো জটিল জায়গায় আটকে গেছি!
দেশের রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবহারের মাধ্যমে এযাবৎ দুটি উদ্যোগ চোখে পড়ে। এক, বিএনপির ক্লিন-হার্ট অপারেশন। দ্বিতীয়টি, সুশীল সমাজদের কথিত সৎ মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক এগারোর জরুরি সরকারের প্রতিষ্ঠা!
ক্লিন-হার্ট অপারেশনের মাধ্যমে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন সেটির ফলাফলও শেষমেষ ইতিবাচক হয় নাই। বরং এটি বিএনপির জন্যে পলিটিকেলি ইনকারেক্ট উদ্যোগ বলে বিবেচিত হয়েছে! বিএনপির পর পর আওয়ামী লীগ একই পলিসি (দলমত নির্বিশেষে সকল সন্ত্রাসীদের দমন করা) অনুসরন করলে এদেশের রাজনীতির ইতিহাস অন্যরকম অন্য রকম হতে পারত। যাই হোক- সে এক নেভার এন্ডিং দীর্ঘশ্বাস।
এরপর আল্লাহর আইন চাই সৎলোকের শাসন চাই- জামায়াতের এই পুরো শ্লোগানের অর্ধেকটিকে নিজেদের শ্লোগান বানিয়ে এগিয়ে আসে এক-এগারোর কথিত ফেরেশতারা এবং তাদের শেষ পরিণতিও আমরা দেখেছি! এই ফেরেশতারাও ভুলে গিয়েছিলেন যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম বা যুদ্ধটি মূলত: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক সংগ্রামের যুগপৎ ফল। এই চারটি সংগ্রামের একটিকে দাবিয়ে রেখে এই সংগ্রামে জয়ী হওয়া যাবে না।
উপরের সবগুলি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক প্রস্তাবটি খুবই উপযোগী মনে হয়েছে! তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে দ্বি-কক্ষিবিশিষ্ট পার্লামেন্ট তৈরি করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বিষয়টি একবার তারেক রহমানের কন্ঠে ধ্বনিত হলেও প্রতিধ্বনী খুব একটা শোনা যাচ্ছে না। আমাদের রাজনৈতিক বলয় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বলয় উভয়েই নীরবতা পালন করে চলছে। অথচ এর মাধ্যমে এদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের অনেক ব্যারাম দূর করা সম্ভব হতো!
এদেশে একটি হতাশা বা নিরাশাবাদি গ্রুপ রয়েছে। এদের মূল কাজ হলো সবসময় হতাশা বা নিরাশা ছড়িয়ে দেওয়া। এরা প্রায়শই নিজেদের চেহারা বা বয়ানের পরিবর্তন ঘটায়। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখবেন যে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন বয়ান নিয়ে হাজির হওয়া এরা সেই একই গোত্রের লোক।
আদর্শের ক্ষেত্রে এরা চরম সুবিধাবাদী বা ইন্দ্রিয়বাদী । নিজের মতলব প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সময় এরা বিভিন্ন বয়ান ছড়ায়। এরা কখনও নিরপেক্ষতাবাদী, কখনও গড়বাদী বা সমতাকরনবাদী (False equalizer)। কখনও বলে, বিকল্প কী? কখনও বলে, যেই লাউ সেই কদু। এরা আসলে সেই একই যদু (Vested Interest Group) যারা সেই কদু থেকে চির সঞ্জীবনী মধু খেয়েছে বা খাচ্ছে। তবে কিছু না খেয়েও যারা এদের পেছনে আছে এবংযাদের সংখ্যা খুবই কম, এরা ধর্ম বিদ্বেষী নাস্তিক গ্রুপটি। এরাই এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূল প্রতিবন্ধক! এরা গণতন্ত্রের শত্রু, এরা মানবতার শত্রু।
এদের নিজেদের একটা পলিটিকেল এজেন্ডা থাকলেও এরা সবচেয়ে সফল হয়েছে আমাদের জাতীয় মানসকে Depoliticize বা বিরাজনীতিকিকরন করতে। রাজনীতি করা বা এসব নিয়ে চিন্তাভাবনাকে এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক অপরাধ হিসাবে কৌশলে তুলে ধরেছে। সেক্ষেত্রে এরা আমাদের জাতীয় জীবনে নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া আইকনদের সুকৌশলে ব্যবহার করেছে।
আপনি যে দলেরই সমর্থক হোন না কেন- দেশের রাজনীতি এবং দেশটিকে রক্ষার্থে এগিয়ে আসুন ! প্রস্তাবটি তারেক রহমান বা যেই করুক না কেন- বর্তমান খাদ থেকে দেশের রাজনীতি ও দেশকে রক্ষায় এর কোনো বিকল্প নাই!
আর এটি বাস্তবায়ন করতে প্রথমেই এই ফ্যাসিবাদকে রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরাজিত করতে হবে। তজ্জন্যে যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই কাজটি শুরু করতে হবে এবং তা এখনই।
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন