অলিউল্লাহ নোমান
১ সেপ্টেম্বর ছিল বিএনপি’র ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর র্যালিতে আক্রমণ চালিয়েছে পুলিশ ও আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনী। পুলিশ ও আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমনে নারায়নগঞ্জে একজন নিহত হয়েছেন। পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহদের সংখ্যা অনেক। একইভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর র্যালি ফ্যাসিবাদী আওয়ামী তাণ্ডবের শিকার হয়েছে নেত্রকোনা, মানিকগঞ্জ, বাগেরহাট, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায়। অনেক জেলা-উপজেলায় একই সময়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ সমাবেশ আহ্বান করায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। প্রশ্ন হচ্ছে এই খুন, আক্রমণ ও জুলুমের মাধ্যমে কি বার্তা দিতে চাচ্ছেন শেখ হাসিনা। তার পায়ের নিচে যে মাটি নেই সেটাই কি প্রমান করছে এই আক্রমণ-নির্যাতনের মাধ্যমে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার ভয়ে অস্থিরতা থেকে কি এমনটা করছেন? নাকি ২০১৮ সালের নির্বাচনী তামাশার আগে যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় আক্রমণ চালিয়ে মাঠছাড়া করা হয়েছিল ধানের শীষের প্রার্থীদের, সেই পথে হাঁটছেন শেখ হাসিনা, এ প্রশ্ন এখন অনেকের সামনে।
২০১৮ সালের নির্বাচনী তামাশার আগে ডিসেম্বর মাসের কথা নিশ্চয়ই সবার স্মরণে আছে। প্রতিটি এলাকায় ধানের শীষের প্রার্থীদের পিটিয়ে মাঠছাড়া করা হয়েছিল। পুলিশ দাওয়া করে এলাকা ছাড়া করে দিয়েছিল ধানের শীষের কর্মী-সমর্থকদের। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল আক্রমণের তীব্রতাও বাড়ছিল। তারপরও জনবিচ্ছিন্ন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট নামক জোটের শীর্ষ নেতারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরবেন। এবারও কি সেই প্রত্যাশাই করছেন সবাই। শেখ হাসিনার পায়ের নিচের মাটি নাই। তাই বেশি দিন টিকতে পারবে না। অদৃশ্য চাপে ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হবেন, এমনটাই কি প্রত্যাশা এই আক্রমণ থেকে? কারণ, ইদানিং একটা কথা অনেক রাজনীতিকের মুখে এখন শোনা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না। অদৃশ্য শক্তির চাপ রয়েছে তার ওপর।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতের দুইটি হোয়াটস্অ্যাপ ম্যাসেজ এখানে উল্লেখ করতে চাই। অদৃশ্য শক্তির চাপ ও ড. কামালের সিগন্যালে নেতারা কতটা নিশ্চিত ছিলেন সেটা স্পষ্ট হবে। ২৯ ডিসেম্বর লন্ডন সময় রাত ৯ টা ১৯ মিনিট তখন। তার মানে বাংলাদেশে তখন ঘড়িতে রাত ৩ টা ১৯ মিনিট। আমার মোবাইলের হোয়াটস্অ্যাপে পরপর দু’টি ম্যাসেজ আসে। বিএনপি’র গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতার মোবাইল থেকে আসা ম্যাসেজ গুলো হুবহু নিম্নরূপ-
“আপনাদের সকলের উদ্দেশ্যে একটা কথা। অনেক জায়গা থেকে অপ্রচার শুরু হয়েছে ভোট আগে হয়ে গেছে। তার মানে যাতে করে কেন্দ্রে আর কেহ না যায় ভোট দেয়ার উদ্দেশ্যে। ধরেন ভোট আগেই হয়ে গেছে। সেটা জানতে হলে আপনাকে আগে সকাল বেলায় কেন্দ্রে যেতে হবে। আপনাদের সকলের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ রইলো-আপনারা সকাল ৭টার ভিতর কেন্দ্রে যান এবং সকলকে কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ইনশাল্লাহ দেখবেন সবকিছু উল্টে গেছে। যদি ভোট চুরি করে থাকে তবে কেন্দ্র বন্ধ করতে বাধ্য হবে। না হয় আপনারা সবাই নিরাপদে ভোট দিতে পারবেন। সকাল বেলায় সব ভোট একবারে তো হয়ে যেতে পারে না। আর তখন এই প্রমান আমরা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারবো সকলের কাছে। তাছাড়া একেক এলাকায় দুই/চারটা সেন্টার দখল করে কোনভাবেই জয় পাওয়া সম্ভব না। তাই বিচলিত হবেন না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। আল্লাহর রহমতে শেষ হাসিটা আমরাই হাসবো-আমীন”
২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত সোয়া ৩টায় এই বার্তাটি আমার মোবাইলে আসার কিছুক্ষণ আগে একই নেতার মোবাইল থেকে আরেকটি বার্তা আসে। এতে উল্লেখ করা হয়-“সকলকে বিনীত অনুরোধ জানানো যাচ্ছে যে, আপনারা ইলেকশন নিয়ে কোন প্রকার ভীতিকর খবর কারো সাথে শেয়ার করবেন না। সাধারণ জনগণ নেতিবাচক নিউজ দেখে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। কাজেই ইলেকশন শেষ হবার আগ পর্যন্ত আমরা সকলেই ভোট কেন্দ্রে যাবার আহ্বান জানিয়ে ম্যাসেজ শেয়ার করবো।”
এই পুরাতন ম্যাসেজ দু’টি এখানে উল্লেখ করলাম বিশেষ একটি কারণে। ভোটের আগে পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়ে ধানের শীষের প্রার্থীর সমর্থকদের পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করার পরও আশায় ছিলেন। প্রকৃত অবস্থান দেখতে ভোটের রেজাল্ট পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন নেতারা। তাদের প্রচারণায় ছিল ড. কামাল হোসেন সিগন্যাল পেয়ে মাঠে নেমেছেন। বিদেশীরা সব করে দিবে। বিদেশীদের চাপে শেখ হাসিনা ভোট নিয়ে কোন রকমের জালিয়াতি করতে পারবে না। এমনটাই ছিল নেতাদের প্রচারণায়।
অথচ ভোটের আগে বাংলাদেশ সময় রাত ১২টার পর থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর পাচ্ছিলাম কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশ মিলে ব্যালটে সীল মারতেছে। নেতার অনুরোধ ম্যাসেজ পাওয়ার পর আমি নিজেও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই কোন কিছুই আর ওই রাতে আপলোড দেইনি। যত খবর পেয়েছি সবই নীরবে হজম করেছিলাম রেজাল্ট পর্যন্ত অপেক্ষার জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে রেজাল্টেই প্রমান হয়েছে ড. কামাল হোসেনের সিগন্যাল ফেইল করেছে। বিরোধী নেতাদের তথ্য অনুযায়ী বিদেশীদের চাপও কোন কাজে আসছে না।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি’র কর্মসূচিতে আক্রমণও কিন্তু ২০১৮ সালের মতই দেখতে। যদিও ১৬ আগস্ট (২০২২) বাংলাদেশের গণমাধ্যম গুলোতে একটি খবর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। খবরটিতে বলা হয়েছিল-গণভবনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন- বিরোধী দলের আন্দোলনে কোন বাঁধা দেওয়া হবে না। বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “চলমান পরিস্থিতিতে আমাদের বিরোধী দল একটু সুযোগ পাচ্ছে। তারা আন্দোলন করবে করুক। তাই আমি আজকেও নির্দেশ দিয়েছি, খবরদার, যারা আন্দোলন করছেন তাদের কাউকে যেন গ্রেফতার বা ডিস্টার্ব না করা হয়।”
গত ১৬ আগস্ট শেষ হাসিনার এই বক্তব্য প্রচারের পর অনেকে সিগন্যাল দেখতে পেয়েছিলেন। বলাবলি হচ্ছিল অদৃশ্য শক্তির চাপে শেখ হাসিনা কাবু হয়ে গেছেন। তাই নরম স্বরে কথা বলছেন। বিরোধী দলকে আন্দোলনের সুযোগ দিতে নিজেই বলে দিচ্ছেন। বিরোধী নেতারা আরো বলাবলি করতে শুনেছি ওই অদৃশ্য শুক্তি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে ঘাড়ে ধরে বিদায় করাটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই বিরোধী দলের আন্দোলনের প্রতি সদয় হয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ১ সেপ্টেম্বর তাঁর নিজের জার্সিতেই ফিরেছেন মাঠে। আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে বিএনপিকে পিটিয়ে ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিরোধী কর্মীদের খুন করছে আওয়ামী পুলিশ। খুনের পর উল্টা মামলা দিচ্ছে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে। বিএনপি মহাসচিব ৪ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন গত এক সপ্তাহে ২০ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। এই হামলা-মামলার পর শেখ হাসিনা দিল্লী গেছেন প্রভুর দরবারে। যদি দেড় বছর পর শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচন হয়, তাহলে এই মামলা গুলো তখন সচল হবে। ওয়ারেন্টের আসামী গ্রেফতারের নামে অভিযান চলবে বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
এদিকে একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয়। ডিবির ইউনিফর্মে প্রকাশ্যে গুলি করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। আওয়ামী গুণ্ডাদের অস্ত্র নিয়ে মহড়ার দৃশ্য প্রচার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তারপরও তথাকথিত সুশীলরা নীরব। তারা তো নীরব থাকবেই। আওয়ামী জয়গান গাওয়ার জন্যই জন্ম তাদের।
এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, গুণ্ডামি, জুলুম-খুনের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতিকদের সার্বজনীন প্রতিবাদও দেখা যাচ্ছে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দল গুলোকে রীতিমত নীরবই দেখা যাচ্ছে। বিএনপি মার খাচ্ছে খাইতে থাকুক-ভাবখানা এমনই দেখা যাচ্ছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ছাত্র শিবির ও জামায়াতে ইসলামীকে একই কায়দায় পুলিশ-আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনীর যৌথ আক্রমণের শিকার হতে দেখা গিয়েছিল। তখনো সবাই নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন। অকার্যকর ২০ দলীয় জোট তো নামে থাকলেও জাতীয় স্বার্থে মাঠে দেখা যায়নি গত ১৪ বছরে। শেখ হাসিনা ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দিল, বন্দর ব্যবহারের জন্য অগ্রাধিকার দিল, জাতীয় নিরাপত্তা ভারতের হাতে সমর্পণ করল। অথচ, ২০ দলীয় জোট জাতীয় স্বার্থে এই বিষয় গুলোতে একটি কর্মসূচি দিতেও দেখা যায়নি। তারা যেন নীরব সাক্ষী হয়ে ভারতের কাছে সার্বভৌমত্ব সমর্পণের বিষয়টি কবুল করেই নিয়েছেন।
যোগপৎ আন্দোলনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে বেশ কয়েকমাস থেকে। কিন্তু সেই যোগপৎ আন্দোলন এখনো রাজপথে গড়ায়নি। কবে সেটা রাজপথে গড়াবে তারও কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। তাহলে একে একে বিরোধী দল কি পৃথকভাবে মার খেতেই থাকবে রাজপথে?
লেখক: সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন