মিনার রশিদ
আগে অনেক যৌথ পরিবারে কিছু চাচা-মামার দেখা মিলতো যারা ছোটদের উপর মাত্রাতিরিক্ত খবরদারি করতেন! ছোটরাও এদের খবরদারিতে ত্যক্ত বিরক্ত থাকত। ফলে যে সমীহ সম্মান ‘এই গায়ে মানে না আপনে মোড়লরা' প্রত্যাশা করতেন সঙ্গতকারণেই তা ছোটরা দেখাতে পারতো না! পরিবারের ছোটদের মৃদু প্রতিবাদ বা টিকা-টিপ্পনীর প্রতিশোধ ইনারা অন্য কৌশলে নিতেন।
ছোটদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়ার কাজটি ইনারা অত্যন্ত আগ্রহভরে পালন করতেন। লেখাপড়ার দোহাই দিয়ে শাসন করলে বা কান মলে দিলে বাচ্চার বাবা-মা বা অন্য মুরব্বিরা আপত্তি করতেন না। ফলে এই সুযোগটি এই চাচা-মামারা গ্রহণ করতেন! যদিও এই কিসিমের চাচা- মামারা প্রায়শই ফেলটুস বা টেনেটুনে পাশ করা ছাত্র ছিলেন। যৌথ পরিবারের সেই সব চাচা-মামার মত এই জাতিরও কিছু আঙ্কেল আন্টি রয়েছেন যারা ধর্মের উপর নিজেদের মনের ক্ষোভ মেটাতে বিজ্ঞান শিক্ষাকে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করান। ‘বিজ্ঞান-বিজ্ঞান’ বলতে অজ্ঞান এই সব আঙ্কেল আন্টিদের অধিকাংশই বিজ্ঞানের ছাত্র বা ছাত্রী ছিলেন না! বিশেষ ঘরানার বাংলা, ইতিহাস কিংবা সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রীরাই এদেশে এই কথিত বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ মুজাহিদ হয়ে দাঁড়ান।
এদের মধ্যে আবার যারা কিছু বিজ্ঞান পড়েছেন তাদের গরমে টিকা বড় দায়। এমনই একজন আন্টি দিপু মনি। তিনি বলেছেন, এখন আধুনিক যুগ, রোবটিক যুগ, এখন নারীদের পোশাকের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করার সময় নয়।
দেখুন, এই আন্টি কেমন বুদ্ধিমত্তার সাথে জাতির বোধ-বিশ্বাসের (ছোটদের) কানটি মলে দিলেন! সামনে খাঁড়া করলেন রোবট বা বিজ্ঞানকে। এখন আপনি এই আন্টির হিপোক্রেসির প্রতিবাদ করলে আপনি বিজ্ঞানের শত্রু বলে গণ্য হয়ে পড়বেন। আন্টিদের ঘরানার সকল বুদ্ধিবৃত্তিক পাহলোয়ানরা আপনার দিকে চোখ রাঙাতে থাকবে।
এই আন্টিদের আবার সুয়োরানীর মত হাড় কড়মড়ে রোগ আছে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধ-বিশ্বাসের গলা ছিড়ে রক্ত দিয়ে গোছল সারতে না পারলে সেই রোগ ভালো হয় না।
ভাবসাব দেখে মনে হয় এই আঙ্কেল আন্টিরা রোবটনুন (মজনুন) হয়ে সিলিকন বৃন্দাবনে চলে যান। মগজ ইনাদের এমনভাবে রোবটাইজ হয়ে পড়ে যে দুনিয়ার কোনো বিষয়ের দিকে তাদের হুঁশ জ্ঞান থাকে না- পোশাকের দৈর্ঘ্য নিয়ে ভাবার অবকাশ থাকে না।
এই আন্টিদের কাছে একটি প্রশ্ন, যারা রান্না করেন তারা কি সাজেন না? যারা রোবট বানান তারা কি পোশাক পরেন না? আর পোশাক পরলে তো এর দৈর্ঘ্য নিয়ে ভাবতেই হবে। সমাজের বিভিন্ন নিয়ামক প্রতিষ্ঠানগুলি নিজ নিজ ভাব নামত এই পোশাকের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে। যেমন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এই দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে কতটুকু ‘লুকিং গুড' এই ভাবনা থেকে। অন্যদিকে মরাল ব্রিগেইড (ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা) এই দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে নিজ নিজ নৈতিক স্কেল থেকে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গুলো দিপু মনিদের পোশাকের একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যে খুশী হয়ে যায়! ধর্মকে খুশী করতে আরেকটু দৈর্ঘ্যের প্রয়োজন হয়। দিপু মনি আন্টিদের আপত্তিটা এই জায়গায়। সরাসরি না বলে একটু বিজ্ঞানকে টেনে এনে মনের ঝালটি মেটান! জনগণ যে আন্টিদের এই মনোভাবটি ধরে ফেলেছে সেই কথাটি এই আন্টিরা এখনও বুঝেন নাই কিংবা তা না বোঝার ভাণ করে আছেন।
'লুকিং গুড এবং ফিলিং গুড' এর জন্যে প্রয়োজন পড়লে জন্মদিনের পোশাক পরতেও কোনো আপত্তি নেই। দিপু মনি আন্টিরা এটাকেই মনে করেন রোবটের যুগ! রোবটের এই যুগে আন্টির যুবতী মেয়ে যদি 'লুকিং গুড, ফিলিং গুডের' জন্যে বিকিনি-ব্রা পরে ঢাকার রাস্তায় বের হতে চান তবে কি তিনি পোশাকের দৈর্ঘ্য নিয়ে কোনো কথা বলবেন না?
যারা রোবট আবিষ্কার করেছেন তারা নিজেদের কৃষ্টি-কালচার, বোধ-বিশ্বাসকে ছেড়ে এটা করেন নাই। কিন্তু সেই রবোটিক সাইন্স সামান্য শিখেই বা তা সামান্য ব্যবহার করেই এই দিপু মনিরা মহা রোবট বিজ্ঞানী সেজে গেছেন। এদেশের আরেক নামকরা ড্রোন বিজ্ঞানীর মত! এটাকেই বলে সূর্যের চেয়ে বালুকণার উত্তাপ বেশি।
যতদিন মানুষের মাঝে মানবিক আবেগ অনুভূতি ক্রিয়াশীল থাকবে, ততদিন নারীর এই পোশাকের দৈর্ঘ্য নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি জারি থাকবে। নারীর পোশাকের দৈর্ঘ্য নির্ধারণের এই কাজটি ফ্যাশন জগতও করবে, ধর্মীয় জগতও করবে। যতদিন মানব সভ্যতা টিকে থাকবে ততদিন এই টাগ অব ওয়ারও চলতে থাকবে।
আসলে দিপু মনি আন্টিরা জাতির প্রচুর ক্ষতি করে ফেলেছেন। একটা প্রজন্মকে পুরো নষ্ট করে ফেলেছেন। প্রতিটা সমাজের নিজস্ব কিছু প্রতিরক্ষা ব্যূহ থাকে। আমাদের এই সামাজিক প্রতিরক্ষা ব্যূহটি ছিল পারিবারিক বন্ধন এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ (সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য)। এই আন্টিরা এই জায়গাটিতেই আঘাত করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন।
নীতি নৈতিকতা কোণঠাসা করে যুব সমাজের মাঝে পর্নোগ্রাফি ও মাদক-ড্রাগকে সর্বগ্রাসী করে তুলেছেন। এরই প্রতিক্রিয়ায় আজ প্রতিটি ঘর বা প্রতিটি সংসার জাহান্নামের আজব যন্ত্রণা ভোগ করছে। এটি দাবানলের মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। পারিবারিক এমন কিছু অপরাধ বা মানসিক বিকৃতির কথা শোনা যায় যেসব আমরা আগে কল্পনাও করতে পারতাম না।
এই দিপু মনি আন্টিরা ধর্মের গোঁড়া কেটে আগায় পানি দেন। একদিকে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে ধর্মের গলা চেপে ধরেন, অক্সিজেন বন্ধ করে দেন। অন্য দিকে আবার প্রতি রাতে ৭০/৮০ রাকাআত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার গল্প বলে বেড়ান। একদিকে দাঁড়ি টুপি ওয়ালাদের গণহারে জেলে পুড়েন অন্য দিকে মদিনার সনদ অনুযায়ী দেশ চালানোর ঘোষণা দেন।
জানি না, আন্টিদের হাড় কড়মড়ে এই রোগ থেকে জাতি কখন নিস্তার পাবে!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন