অলিউল্লাহ নোমান
দীর্ঘ ২৩ বছর পর রাজনৈতিক জোটের সম্পর্ক বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। নিজেদের দলীয় ফোরামে এই বিচ্ছেদের বিষয়টি জানিয়ে দেন দলের আমীর স্বয়ং। এরপরই বিষয়টি প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে। ২০ দলীয় জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরীক ছিল জামায়াত। রবিবার (২৮ আগস্ট ২০২২) দলটি’র আমীর ডা. শফিকুর রহমানের একটি বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। জোট থেকে বিচ্ছেদের কথা বললেও রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনের প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করা হয়েছে আমীরের বক্তব্যে। আরো বেশি ত্যাগ স্বীকারের অঙ্গিকারও করেছেন তিনি।
প্রায় ২৩ বছর বিএনপি-জামায়াত বলতে গেলে এক রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য ছিল। দুই দলেরই নিজস্ব কর্মসূচি, লক্ষ্য এবং আদর্শ রয়েছে। নিজ-নিজ লক্ষ্য, আদর্শ ও কর্মসূচির উর্ধ্বে উঠে জোটবদ্ধ হয়েছিল ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রয়োজনে। এক সময় জোটবদ্ধ না হয়েও বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী পাশাপাশি হেঁটেছে। যেমন, ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন হয়েছিল নিরপেক্ষ, অবাধ ও দেশ-বিদেশে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য। এ নির্বাচনে কোন দলই সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। যদিও বিএনপি ১৪০ আসন পেয়ে সবার উপরে ছিল। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ নির্বাচনের পর পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, কোন দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কার কাছে আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করব। তাঁর এই প্রশ্ন রাখার পরের দিনই ১৮টি দলে বিজয়ী জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় গ্রুপ রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের সাথে দেখা করেছিলেন। বঙ্গভবনে গিয়ে জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিকে নি:শর্ত সমর্থনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে নিজেদের অভিমত জানিয়েছিলেন। এরপরই সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নটি আর থাকেনি। রাষ্ট্রপতি বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের সরকারের সময়ই জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপি’র রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। যার খেসারত হিসাবে ১৯৯৪ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের সাথে যোগপৎ আন্দোলন করে বিএনপি সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। যোগপৎ আন্দোলনের দাবী অনুযায়ী নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বিএনপি বাধ্য হয়েছিল তখন। প্রথম বারের মত জামায়াতে ইসলামী ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রায় সকল আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে ১১৬ সীটে বিজয়ী হলেও জামায়াতে ইসলামী তখন মাত্র ৩টি সীট পেয়েছিল। ১৮ আসন থেকে একলাফে ৩ আসনে নেমে আসে জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি-জামায়াতের বিরোধের খেসারত দুই দলকেই দিতে হয়েছিল ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের ফ্যাসিবাদী চরিত্রে ফিরে আসে। আন্দোলনের সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে কোণঠাসা করতে আওয়ামী লীগের সরকার নির্যাতন নিপীড়ন চালাতে থাকে। তখন ঐতিহাসিক এক প্রয়োজনে আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের অপরাজনীতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করতেই জোট গঠন করার আলোচনা শুরু হয়। আওয়ামী নির্যাতন ও নিপীড়নে বিএনপি-জামায়াতের দূরত্ব কমিয়ে দিতে সহায়তা করে তখন।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে যখন জোট গঠন করা হয়, তখন আমি দৈনিক ইনকিলাবে জুনিয়র রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত ছিলাম। সেই সুবাদে কাছে থেকে জোট গঠনের তৎপরতা দেখার সুযোগ হয়েছিল। জোট গঠনের আগে রিহার্সাল হিসাবে ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর একটি অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়া, হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অধ্যাপক গোলাম আযম এবং শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক এক মঞ্চে বসেছিলেন। জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার আগে এটাই ছিল এক মঞ্চে তখন বড় ৪ দলের শীর্ষ নেতাদের একসঙ্গে বসা। এ অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করছিলেন বর্তমানে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ইনকিলাব পাঠক ফোরামের তৎকালীন সভাপতি আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল মতিঝিলে হোটেল পূর্বানীর একটি হলরুমে।
এই অনুষ্ঠানের আরো কয়েক মাস পর চার দলীয় জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে ২৯ মিন্টু রোডের বিরোধী দলীয় নেতার বাসভবন থেকে। তখন বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা। বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল ২৯ মিন্টু রোডের লাল দালানের বাড়িটি। জাতীয় পার্টির তৎকালিন নেতা কাজী জাফর আহমদ, বিএনপি নেতা আনোয়ার জাহিদ ও জামায়াতে ইসলামীর কামারুজ্জামন জোট গঠনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন বলা চলে। জোটের চূড়ান্ত ঘোষণার দিন তারিখ টিক হয়েছিল ৫ জানুয়ারী ১৯৯৯ সাল। জোট ঘোষণার দিন মিন্টু রোডে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। মিন্টু রোডে বিরোধী দলীয় নেতার বাড়ির সামনের চত্ত্বরে ত্রিপল দিয়ে বানানো প্যান্ডেলের নিচে তৈরি করা মঞ্চে বসেছিলেন চারটি দলের মহাসচিব। বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূইয়া, জাতীয় পার্টি মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জু, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ মতিউর রহমান নিজামী ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি আমিনী ছিলেন মঞ্চে। আর শীর্ষ চার নেতা বেগম খালেদা জিয়া, হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অধ্যাপক গোলাম আযম এবং শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক মিন্টুরোডে বিরোধী দলীয় নেতার বাসভবনের ভেতরে বৈঠকে ছিলেন। চার মহাসচিব বৈঠক থেকে উঠে জোট গঠনের চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন প্যান্ডেলের নিচে তৈরি মঞ্চে বসে। জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলন হয়েছিল সেই রাতে। অনেক উৎসুক মানুষ জমায়েত হয়েছিল মিন্টু রোডের এই বাড়িটিকে ঘিরে। আওয়ামী লীগ বিরোধী জোট গঠন হচ্ছে। এ যেন ছিল এক সাজ সাজ রব। জোটের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুইয়া।
ট্রানজিটের নামে ইন্ডিয়াকে করিডোর এবং চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া আওয়াজ উঠেছিল তখনো। কিন্তু চার দলীয় জোটের শক্ত অবস্থানের ফলে আওয়ামী লীগ আর অগ্রসর হতে সাহস দেখায়নি।
ট্রানজিটের নামে ইন্ডিয়াকে করিডোর এবং চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া আওয়াজ উঠেছিল তখনো। কিন্তু চার দলীয় জোটের শক্ত অবস্থানের ফলে আওয়ামী লীগ আর অগ্রসর হতে সাহস দেখায়নি।
এই ঘোষণার পর প্রায় ২৩ বছর অতিক্রম করছে। রাজনীতিতে অনেক চড়াই-উৎরাই হয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছরে। বর্তমানে জোট থেকে বিচ্ছেদের তাগিদ যেমন রয়েছে, তখন তেমনি জোট গঠনের একটা বিরাট প্রয়োজনীয়তা ছিল। জোট গঠনের ঘোষণায় ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল রাজনীতিতে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে চার দলীয় জোট বিজয়ী হয়েছিল। জোটবদ্ধ এই নির্বাচনের পরের দিন অনেক সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল- ‘নীরব ভোট বিপ্লব’। মানুষ সুযোগ পেয়ে ভোটের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটিয়েছিল দেশে। এই ভোট বিপ্লবের সুফল কতটা ভোগ করতে পেরেছিল দেশের সাধারণ জনগণ, এনিয়ে পর্যালোচনার দাবী রাখে। তবে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর চার দলীয় জোটের বিদায়ের দিন লগি-বৈঠা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যার পর লাশের উপর নৃত্য করেছিল সেদিন আওয়ামী-বাম জোটের সন্ত্রাসীরা। আওয়ামী সন্ত্রাসে সারা দেশে সেদিন ১৫ জন বিএনপি-জামায়াতের কর্মী নিহত হয়েছিলেন। একটি জোটবদ্ধ সরকারের বিদায়ের দিনে এমন তাণ্ডব মোকাবিলায় জোটের রাজনীতি ছিল অনুপস্থিত। সেই দিন থেকেই জোটের ভেতরে পরস্পরে সন্দেহ এবং নীরব বিরোধ শুরু হয়। অভ্যন্তরীণ আস্থা ও বিশ্বাসের এই ঘাটতির সুযোগটি নেয় আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তি।
একটি জোটবদ্ধ সরকারের বিদায়ের দিনে এমন তাণ্ডব মোকাবিলায় জোটের রাজনীতি ছিল অনুপস্থিত।
একটি জোটবদ্ধ সরকারের বিদায়ের দিনে এমন তাণ্ডব মোকাবিলায় জোটের রাজনীতি ছিল অনুপস্থিত।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির ব্যাপকতা বেড়ে গিয়েছিল। জেলায় জেলায় তৈরি হয়েছিল আওয়ামী গডফাদার। আওয়ামী সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অত্যাচারে মানুষ অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ফেনীর জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরের আবু তাহের, ঢাকার হাজি মকবুল, নারায়নগঞ্জের শামিম ওসামনসহ প্রতিটি জেলায় সন্ত্রাসের গডফাদার তৈরি হয়েছিল তখন। এছাড়া ভারতকে ট্রানজিটসহ নানা সুবিধা দেওয়া নিয়ে আলোচনা চলছিল। ইনকিলাব তখন ট্রানজিটের বিরুদ্ধে অনেক গুলো সেমিনার করেছিল ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে। চার দলীয় জোটও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী সব রকমের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। ট্রানজিটের নামে ইন্ডিয়াকে করিডোর এবং চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া আওয়াজ উঠেছিল তখনো। কিন্তু চার দলীয় জোটের শক্ত অবস্থানের ফলে আওয়ামী লীগ আর অগ্রসর হতে সাহস দেখায়নি। অথচ, চার দলীয় জোট থেকে ২০ দলে সম্প্রসারিত হয়েছে এই জোট। তারপরও আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে ইন্ডিয়াকে করিডোর এবং বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে নির্বিঘ্নে। সুতরাং এই জোট যে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ ভূমিকা রাখতে হয়েছে এনিয়ে মনে সন্দেহ থাকার কথা নয়।
এছাড়া শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে জোটের কোন রাজনৈতিক তৎপরতা ২০১৪ সালের পর থেকেই অনুপস্থিত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর জোটের সাথে আলোচনা ছাড়াই রাজপথের আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিল প্রধান শরীক দল বিএনপি। তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে লাগাতর হরতাল এবং অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। এই আন্দোলন একটানা চলেছিল এপ্রিল পর্যন্ত। ২০১৫ সালের এপ্রিলের পর ২০ দলীয় জোট নামে থাকলেও রাজপথে ছিল না। এক পর্যায়ে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের গঠিত নির্বাচন কমিশন। এই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করলে জোটের অবস্থান তখন হারিয়ে যায় ঐক্যফ্রন্টে। যদিও ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্টের সভা-সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানের জয়গান গাইতেন। বিপরীতে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং জিয়াউর রহমান নিয়ে কোন কথা কখনো শোনা যায়নি তাঁর মুখে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় থেকেই ২০ দলীয় জোট চূড়ান্তভাবে পথ হারিয়ে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল।
১৯৯৯ সালে জোট গঠনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যেমন ভুমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তেমনি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন মোকাবিলা করে জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে এই জোট।
লেখক: সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন