মিনার রশিদ
এদেশের ইনভেষ্টিগেটিং জার্নালিজমের পরম আবিষ্কার (নাকি কলঙ্ক?) ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলায় জজমিয়া নাটক। অর্ধ সত্য এই আবিষ্কারটি দিয়ে আলো-স্টারের মতি-মাহফুজরা অনেক বড় বড় সত্য ও মারাত্মক কিছু প্রশ্নকে আড়াল করে দিয়েছে!
চলুন, আঠার কোটি মানবাত্মা এবং তাদের আগত প্রজন্মের নিরাপত্তার কথা ভেবেই সেই প্রশ্নগুলি নিয়ে সামান্য সময় ব্যয় করি।
এক.
বেগম জিয়া একবার বলেছিলেন, শেখ হাসিনা একবার মুখ খুললেই আওয়ামীলীগের কয়েক লাখ ভোট কমে যায়। গণতান্ত্রিক ঐ সময়টিতে যে কোনো বিচারে জীবিত হাসিনা মৃত হাসিনার চেয়ে বিএনপির জন্যে বেশি লাভজনক ছিলেন। এমন একটি রাজনৈতিক এসেটকে বিএনপি কেন শেষ করে ফেলতে চাইবে?
দুই.
শেখ হাসিনাই যদি টার্গেট হতেন তবে তাঁকে হত্যার জন্যে আরো অনেক নিরাপদ রাস্তা বাদ দিয়ে এরকম প্রকাশ্য জনাকীর্ণ সভাস্থলকে বেছে নেওয়া হলো কেন? এরকম আততায়ীরা শিকারকে লক্ষ্যভেদী করার জন্যে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বা অন্যকোনো নিরিবিলি জায়গা বেছে নেয়!
তিন.
সেদিন গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনা নিহত হলে চার দলীয় জোট সরকারের সাথে সাথেই পতন হত তাতে এক বিন্দু সন্দেহ নাই। সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অত্যন্ত কমফোর্টেবল অবস্থায় থাকা একটি সরকার এমন বোকামি কেন করতে যাবে? উপরের এই তিনটি প্রশ্ন মাথায় নিয়ে নিচের প্রশ্নগুলোর উপর একটু চোখ বুলান এবং নিজের মনে একটা উত্তর পেতে চেষ্টা করুন।
চার.
মুক্তাঙ্গন থেকে সমাবেশের স্থান কয়েক ঘন্টা আগে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সরানো হলো কেন?
পাঁচ.
মুক্তাঙ্গনে অনুষ্ঠানের জন্যে সিটি করপোরেশন এবং মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছ থেকে কয়েকদিন আগে থেকেই অনুমোদন নেয়া হয়েছিল যা সাপোর্টিং ডকুমেন্ট হিসাবে মজুদ রয়েছে, সেই একই অনুমোদন কি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের জন্যে নেয়া হয়েছিল?
ছয় .
সেদিন দশ বারোটি গ্রেনেড ছুঁড়া হলেও সেই সব গ্রেনেডের একটিও কথিত মূল টার্গেটের মঞ্চে পড়লো না কেন?
সাত.
শেখ হাসিনা সেদিন বক্তৃতা করেছিলেন পঁচিশ থেকে সাতাইশ মিনিট। তিনিই যদি মূল টার্গেট হতেন তাহলে ঘাতক এতটুকু সময় ধৈর্য্য ধরে বক্তৃতা শেষ হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করলো কেন?
আট.
শেখ হাসিনার বক্তৃতা শেষ হওয়ার ২ থেকে ৩ মিনিট পরে গ্রেনেড ছুঁড়া শুরু হয়েছে। জনৈক সাংবাদিকের অনুরোধে ছবির জন্যে পোঁজ দেওয়ার জন্যে না দাঁড়ালে এই সময়ে উনি উনার গাড়িতে চড়ে বসতেন। মাঝখানের এই সময়টুকু দেওয়া হলো কেন?
নয়.
অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা সবাই ট্রাকের উপরে থাকলেও কর্মীবান্ধব আইভি রহমান বাইরে বসেছিলেন। সেদিন শেখ হাসিনা আইভি রহমানকে বার বার ট্রাকে উঠার জন্যে আহ্বান জানিয়েছিলেন কেন?
দশ.
সেদিন আঘাতে একমাত্র আইভি রহমান ব্যতীত আর কোনও কেন্দ্রীয় নেতা- নেত্রী আহত/নিহত হন নাই। ঘাতকের মূল টার্গেটও কি তাহলে সাধারণ বনি আদমরাই ছিল?
এগার.
নেত্রীর মার্সিডিজ গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি এবং চাকা পাংচার হওয়া নিয়ে আওয়ামীলীগ যা দাবি করেছিল, তার উত্তরে মার্সিডিজ কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন, এটা অসম্ভব। এই ব্যাপারে আওয়ামীলীগ পরবর্তীতে আর কোনো উচ্চবাচ্য করে নাই কেন?
বার.
ঘটনার পর পরই তদানীন্তন চারদলীয় জোট সরকার এফবিআই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এর মত প্রফেশনাল ও আন্তর্জাতিক সংস্থা দিয়ে অনুসন্ধান করার প্রস্তাব দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেটা গ্রহণ করে নাই কেন?
তের.
বিচারপতি জয়নাল আবেদিনকে প্রধান করে যে একটা বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই রিপোর্ট পরবর্তী জরুরী বা আওয়ামী সরকার আওয়ামী সরকার প্রকাশ করে নাই কেন?
চৌদ্দ.
২১ আগস্ট হামলা মামলায় 'জজ মিয়া'র বিচার কার্যক্রম দূরে থাক যেখানে তার ব্যাপারে পুলিশ চার্জশিটও হয়নি। 'জজ মিয়া'র ঘটনা তৎকালীন বিএনপি সরকার বিশ্বাস করেনি। ফলে সিআইডির তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা 'জজ মিয়া'র বক্তব্যকে ভিত্তি করে আদালতে কোনো চার্জশিটও দাখিল করেনি। জজ মিয়া নাটকটি সম্মুখে এনে উপরের ঐ সব মারাত্মক প্রশ্নগুলি চাপা দিয়ে ফেলা হয়েছে। জজ মিয়া নাটকটি কি তাহলে আরেকটি মহানাটকের অংশ?
পনের.
ভূমিমন্ত্রী বলেছেন, পুলিশকে সবসময় লুকিয়ে এবং পরোক্ষভাবে আওয়ামীলীগকে সহযোগিতা করতে দেখেছি। তাহলে কি তখনকার পুলিশের ভেতর থেকেই কেউ কেউ এই জজ মিয়া নাটক সৃষ্টি করে ২১শে আগস্টের মূল নটরাজকে সহযোগিতা করেছেন?
ষোল.
স্পর্শকাতর মামলা হিসাবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে সভাপতি করে একটা মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছিল। স্বনামধন্য এডভোকেট খাঁন সাইফুর রহমান ছিলেন এর লিগ্যাল এডভাইজর। সিআইডি সেই জজমিয়া মামলার চার্জশিট দুইবার মনিটরিং সেলে দাখিল করলেও মনিটরিং সেল তা দুইবারই রিজেক্ট করেছিল? জজমিয়া নাটকটি আমাদের আলো- স্টাররা মহা উত্সাহে প্রচার করলেও এমন গুরুত্বপূর্ণ এই ইনফরমেশনটি প্রচার পায় নাই কেন?
সতের.
বিএনপি যদি জজমিয়ার কাহিনী বিশ্বাস করত কিংবা তা দেশের জনগণকে বিশ্বাস করাতে চাইত তাহলে এক নম্বর আসামী হিসাবে মুফতি হান্নানকে তারা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়েই কেন গ্রেফতার করেছিল?
তথ্য প্রমাণে দেখা যায়, ২১ আগস্ট ঘটনার দায় স্বীকার করে ২০০৫ সালের ২৯ জুন দেয়া 'জজ মিয়া'র জবানবন্দীতে মুফতি হান্নানের নাম উল্লেখ ছিলোনা। তারপরও ২১ আগস্ট মামলার তদন্ত চলাকালেই ২০০৫ সালের পহেলা অক্টোবর মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করা হয়। মুফতি হান্নানের গ্রেফতারে প্রমাণিত হয় 'জজ মিয়া'র গ্রেফতার এবং জবানবন্দীর কারণে ২১ আগস্ট হামলা মামলার তদন্ত থেমে যায়নি। সরকারের কাছে 'জজ মিয়া'র জবানবন্দি 'যৌক্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য' মনে হয়নি। বিএনপি সরকারের কাছে 'জজ মিয়া'র জবানবন্দি বিশ্বাসযোগ্য মনে হলে 'জজ মিয়ার জবানবন্দি'র মাস তিনেক পর মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার হতে হতোনা। বিভিন্ন সরকারের সময় বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিকবার ২১ আগস্ট হামলা মামলার তদন্ত হয়েছে। প্রত্যেক তদন্তে মুফতি হান্নান ২১ আগস্ট হামলা মামলার এক নম্বর আসামি ছিল। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার আগে পর্যন্ত সময়কালে ২১ আগস্ট হামলা মামলার তদন্ত অব্যাহত রাখলেও সময়ের অভাবে তদন্ত শেষ করে যেতে পারেনি। তবে তদন্ত শেষ না করতে না পারলেও ২১ আগস্ট হামলা মামলার প্রধান আসামি অর্থাৎ এক নম্বর আসামি মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করতে পারা অবশ্যই ২১ আগস্ট হামলা মামলা তদন্তের অগ্রগতিতে বিএনপি সরকারের একটি বড়ো সাফল্য।
এখানে বর্ণনার কোন অংশটি অসত্য বলে মনে করেন?
আঠার.
অনেকেই বিশ্বাস করেন, শুধুমাত্র সম্পর্কে মাওলানা তাজউদ্দীনের সহোদর হওয়ার কারণে আব্দুল সালাম পিন্টুকে ২১ আগস্ট হামলা মামলায় জড়ানো হয়েছে। আব্দুস সালাম পিন্টুকে জড়ানোর মাধ্যমে ২১ আগস্ট হামলা মামলার সঙ্গে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিএনপির সম্পর্ক দেখানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে।
মাওলানা তাজউদ্দীনের ভাই হওয়ার কারণে যদি আব্দুস সালাম পিন্টুকে জড়ানো হয়, তাহলে দেশের সকল জঙ্গি সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজমকে জড়ানো হচ্ছে না কেন? সেই সুবাদে আওয়ামীলীগকে জঙ্গীবাদের মদদ দাতা বলা হচ্ছে না কেন? কারণ শায়েখ আব্দুর রহমান ছিলেন মির্জা আযমের আপন ভগ্নীপতি।
উনিশ.
২০২১ সালের ২০ আগস্ট শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে '২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ‘স্মৃতির পাতা থেকে জানা-অজানা দুই একটি কথা’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। সাঈদ খোকন সভায় অন রেকর্ড বলেছেন, '২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার দুই দিন আগে এই ধরনের হামলার আশঙ্কার কথা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছিল'। সাঈদ খোকন আরো বলেছেন, তার বাবা ঢাকার সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের নির্দেশে সাঈদ খোকন নিজেই সুদা সদনে গিয়ে শেখ হাসিনাকে এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। সাঈদ খোকন বলেছেন, '২০০৪ সালে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে হামলার কথা তারা দুই দিন আগেই জানতে পেরেছিলেন।'
এই সব জানার পরেও একজন বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসাবে (যিনি একজন পূর্ণ মন্ত্রীর প্রটোকল পান) সরকারকে এটা জানান নি কেন?
বিশ.
২০০৪ সালে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলার ঘটনার বিচার হয়েছে। ওই সমাবেশে হামলাকারীদের কয়েকজনের জবানবন্দির আলোকে ২০১৮ সালের ২১ আগস্ট 'যারা যেভাবে পরিকল্পনা ও হামলা করেছিল' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক প্রথম আলো। বিস্তারিত রিপোর্টের একটি লাইন, 'হামলার আগের দিন ২০ আগস্ট কাজল ও আবু জান্দাল 'বঙ্গবন্ধু এভিন্যু' গিয়ে এলাকা পর্যবেক্ষণ (রেকি) করে আসেন'। [উল্লেখ্য, পুলিশের কাছে দেয়া তথ্যমতে, আবু জান্দাল এবং কাজলই সমাবেশে প্রথম গ্রেনেড ছুড়ে মারে]
এখন প্রশ্ন হলো, ২১ আগস্ট সমাবেশ ছিল 'মুক্তাঙ্গনে'। সমাবেশের দিন দুপুরে সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করে নেয়া হয় 'বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে'। হামলাকারী জঙ্গিরা কিভাবে জানলো, আওয়ামী লীগের সমাবেশ পল্টনের 'মুক্তাঙ্গনে' পরিবর্তে 'বঙ্গবন্ধু এভিনিউ' হবে? জঙ্গিরা 'মুক্তাঙ্গন' রেখে গ্রেনেড হামলা চালাতে 'বঙ্গবন্ধু এভিন্যু' রেকি করলো কেন? কে জঙ্গিদেরকে ভেন্যু পরিবর্তনের তথ্য দিয়েছে?
একুশ.
জরুরি সরকারের সময় যে চার্জশিট দাখিল করা হয় সেখানে আসামি হিসাবে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের নাম ছিল না! চাকুরি থেকে অবসরে গিয়ে রাজনীতি শুরু করা আব্দুল কাহহার চৌধুরীকে আবার চাকুরীতে ফিরিয়ে এনে এই মামলার দায়িত্ব দেয়া হয়। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে ২১ আগস্ট হামলা মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান জড়িত বলে ২০১১ সালের ০৭ এপ্রিল মুফতি হান্নানের কাছ থেকে জবানবন্দি আদায় করেন। তবে আব্দুল কাহহার আকন্দের রিমান্ডের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর মুফতি হান্নান জানান, তিনি কখনোই বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেনি, দেখা করেননি। ২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতকে মুফতি হান্নান লিখিতভাবে জানান, 'অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে ২১ আগস্ট হামলা মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান জড়িত মর্মে আব্দুল কাহহার আকন্দ তার কাছ থেকে জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায় করেছে।'
এগুলি দেখে আপনি যদি বিবেকের তাড়নায় একটু উসখুস করেন, তবে কি আপনি বিএনপি বনে যাবেন?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন