মিনার রশিদ
সকল হত্যাকাণ্ডের হত্যাকারী এর বেনিফিশিয়ারি হলেও সকল বেনিফিশিয়ারি হত্যাকারী নয়। অনেকে বেনিফিশিয়ারি হন বংশলতিকার অনেক পেছন থেকে। অনেককেই আসতে হয় দেশ ও জাতির স্বার্থে শূন্যস্থান পূরণ করার নিমিত্তে। বেনিফিশিয়ারি মাত্রই হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারী এই ধরনের সহজ ফর্মুলা শুধু ভয়ংকরভাবে ত্রুটিপূর্ণই নয়- নির্মম ও নিষ্ঠুরও বটে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ায় বেনিফিশিয়ারিদের মধ্যে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা অন্যতম। এই কথাটি নির্মম শোনালেও অতি সত্য কথা।
পৃথিবীতে সিংহাসন লাভের নিমিত্তে ভাই ভাইকে খুন করেছে, সন্তান তার পিতাকে খুন করেছে- এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি রয়েছে। সিরাজউদ্দৌলাকে তার মায়ের আপন বোন সহ নিকটাত্মীয়রাই ষড়যন্ত্র করে সিংহাসনচ্যুত ও হত্যা করেছিলেন। নেপালের এক রাজপুত্র এই সেদিন নিজের বাবা মা সহ আরো অনেককে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন। নিজের সন্তানকে চক্রান্ত করে হত্যার জন্যে কেউ কেউ ইন্দিরা গান্ধীকে ও সন্দেহ করেন। এমনকি নিজের মাকে হত্যা করার জন্যে এর বেনিফিশিয়ারি হিসাবে রাজীব গান্ধীকেও সন্দেহের আওতার বাইরে রাখা হয় নি।
এত সব উদাহরণ এবং যুক্তি থাকার পরেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার ব্যাপারে সন্দেহ করা যায় না। এই ধরনের চিন্তা ভাবনাকেও অনেকেই ক্রেজি ও নির্মম নিষ্ঠুর বলে গণ্য করবেন। তবে একটি কম্পিউটার বা রোবটকে এই অনুসন্ধানে নিয়োজিত করলে কিন্তু সেটাই বলবে।
কারণ শেখ মুজিব ও তাঁর তিন ছেলে বেঁচে থাকলে আর যাই হোক শেখ হাসিনা এবং তাঁর রক্তের ধারা জয় পুতুল কখনই ক্ষমতার লাইন বরাবর আসতে পারতেন না। বরং শেখ কামাল অথবা শেখ জামালের রক্তের ধারা এই লাইনে চলে আসতো। তখন সরকার প্রধান হিসাবে জুনিয়র শেখ কামাল সংসদে বা জন সমাবেশে দাঁড়িয়ে নিকটাত্মীয়দের যে তালিকা পেশ করতেন তাতে জয় পুতুলের স্থান হতো না। কয়েক বছর আগে শেখ হাসিনা তাঁর নিকটাত্মীয়ের লিস্ট ঘোষণা করায় শেখ সেলিম ও শেখ হেলাল প্রমুখ শেখগণ অপ্রস্তুত হয়েছিলেন বা মনের কোণায় ব্যথা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিব তাঁর তিন-পুত্রসহ নিহত না হলে সেই একই ব্যথা জয় আর পুতুল পেতেন।
মধ্যবিত্ত বাঙালী মুসলমানের মানসিকতা সম্পন্ন শেখ মুজিব তাঁর মেয়েকে কখনই রাজনৈতিক জগতে আনতে চান নি। সামান্য লেখাপড়া করিয়ে সুপাত্রে পাত্রস্থ করেছেন। দেশ চালানোর জন্যে তিনি নিজ হাতে যে তরুণদের রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তৈরি করেছিলেন তাদের অনেকেই বিয়ের উপযুক্ত থাকলেও এই রত্নদের কারো হাতে নিজের মেয়েকে সোপর্দ করতে সাহস করেন নি। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন বেছে বেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সেরা ছাত্রের কাছে। আজকে দেশটির করুণ অবস্থার কারন সম্ভবত আমাদের এই অদ্ভুত মানসিকতা। যে আমু বা মামুদের হাতে দেশকে ছেড়ে দেই তাদের হাতে নিজের মেয়েকে ছেড়ে দিতে ভয় পাই!
যাই হোক, এত সব ইতিহাস উদ্ধৃত করার পেছনে উদ্দেশ্য একটাই- মুজিব হত্যার বেনিফিশিয়ারি মাত্রই যে হত্যাকারী নয় সেই কথাটি আবারো স্মরণ করিয়ে দেয়া।
মুজিবকন্যা প্রায়শই বলেন, জিয়া মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। তা না হলে তাকেও মুজিব হত্যায় আসামী করতেন। মুজিব হত্যার বেনিফিশিয়ারি শেখ হাসিনাকে এই সন্দেহের আওতার বাইরে রাখলেও অন্য এক বেনিফিশিয়ারি জিয়ার ক্ষেত্রে এই বোধ ও যুক্তিটি আমাদের কারো কারো ভেতর কাজ করে না।
অথচ ইতিহাস বলে যে ক্ষমতা তিনি (শহীদ জিয়া) দখল করেন নি। ক্ষমতা তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল। নান্দনিক ভাব ও ভাবনায় বলা যায় যে তিনি ক্ষমতার প্রেমে পড়েন নি, সেই প্রেম তাঁর উপর পড়েছিল। ১৫ই আগস্টের সেই ঘটনার সময়ে তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড বা সেনা বাহিনীর উপ-প্রধান। তখনকার সেনা প্রধান যিনি তার কমান্ডার-ইন-চীফ নিজের বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে নিজে এগিয়ে না গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসার পরামর্শ রেখেছিলেন। এই সেনাপ্রধান মোশতাক ডাকিবামাত্র অন্য দুই বাহিনী প্রধান সহ বঙ্গভবনে গিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। রক্ষী বাহিনীর রাজনৈতিক প্রধান তোফায়েল আহমেদ সহ অন্যরাও নিজেদেরকে রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই রক্ষীবাহিনী নৈতিকভাবে এত দুর্বল হয়ে পড়ে যে প্রয়োজনের মুহূর্তে একটা গুলিও ছুড়তে পারে নি।
চতুর মোশতাক বুঝেছিলেন চরম অস্থিতিশীল মুহূর্তে কোন বখতিয়ার খিলজি এগিয়ে আসলে এই অথর্ব ও অদক্ষ সেনা প্রধান তাকেও লক্ষণ সেনের মত পেছনের দরজা দিয়ে বের হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। এই ধরনের বিবেচনা বা গণনা থেকে তাকে বাদ দিলে সেকেন্ড ইন কম্যান্ড হিসাবে জিয়া সেনা প্রধান হয়ে পড়েন। তাঁকে (জিয়াকে) বিশেষ বিবেচনায় কাউকে ডিঙ্গিয়ে নিচ থেকে উপরে তুলে আনা হয় নি।
সেই সময়ের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের প্রতি বিশেষ দরদ পোষণ করা গান্ধীবাদী লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর একটি লেখায় অত্যন্ত চমৎকার ভাবে ১৫ই আগস্টের পরের দিন বঙ্গভবনের দৃশ্য বর্ণনা করে গেছেন। মাত্র ৪/৫ জন বাদে শেখ মুজিবের মন্ত্রী সভার সকল সদস্যরাই খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রী সভার সদস্য হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন। মোশতাকের মন্ত্রী সভার সদস্যদের যিনি শপথ পাঠ করিয়েছিলেন সেই এইচ টি ইমাম মুজিবকন্যার গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীও মোশতাকের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী মোশতাককে অভিনন্দন জানিয়ে তার বার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং মোশতাকের সরকারের জন্যে আল্লাহ্ র রহমত কামনা করেছিলেন। বর্তমান সরকারের জোটসঙ্গী এবং আগের টার্মে মন্ত্রী হয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ সামরিক বাহিনীর ট্যাংকের উপর ওঠে নেচেছিলেন। লন্ডন শহরটি ফারুক- রশীদের বন্দুকের নলের আওতার অনেক বাইরে ছিল। সেখানে বসে সংসদের স্পিকার মালেক উকিল বলে এসেছিলেন যে ফেরাউনের রাজত্বের পতন হয়েছে। অর্থাৎ মালেক উকিল কথিত 'ফেরাউন' এর রাজত্বের পতন হলেও আওয়ামী রাজত্বের তখনও পতন হয় নি। আগের সংসদটিও বহাল ছিল।
যারা সরাসরি এই হত্যায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেকের ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল। তাদের সবার চেহারা ও পরিচিতি স্পষ্ট। তবে পেছনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আওয়ামী লীগের ভেতরের বড় একটা অংশ জড়িত ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। ১৫ ই আগস্টের হত্যার পরের দিন ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রদূত সমর সেন খোন্দকার মোশতাকের সাথে দেখা করেন। মুজিব হত্যার মাত্র কয়েক দিন পর মোশতাকের সঙ্গে হাস্যবদনরত সেই ছবি দেখলে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। এসবের মাঝে কোথাও আমরা জিয়াকে খুঁজে পাই নি।
উপরে যে সব ব্যক্তির উল্লেখ রয়েছে (এইচ টি ইমাম, মালেক উকিল বা এমএজি ওসমানী) তাদের সমপরিমাণ সম্পৃক্ততা বা দোষেও জিয়াকে অভিযুক্ত করা সম্ভব নয়।
যে সামরিক শাসনের ব্যাপারে তাকে অভিযুক্ত করা হয় সেই সামরিক শাসন জারি করেছিলেন আওয়ামীলীগের নেতা খোন্দকার মোশতাক। এজন্যে জিয়াকে দোষারোপ করা যায় না। খুব বেশি হলে বলা যায় জিয়া আমাদের ইতিহাসের এমন এক বরপুত্র যার জন্যে সব সময় সব কিছু যেন প্রস্তুত হয়েছিল। তিনি শুধু সঠিক সময়ে সঠিক ভূমিকাটি রেখে গেছেন।
তিনি (জিয়া) দেখলেন অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশটি দেশী বিদেশী চক্রান্তে লন্ড ভন্ড হয়ে পড়ছে। জাহাজের তখনকার নেভিগেটরদের (সবাই আওয়ামী নেতা) পারস্পরিক কোন্দলে দেশরূপী জাহাজটি ক্রমান্বয়ে ডুবে যাচ্ছে। তিনি দেখলেন যে এই অবস্থায় জাহাজের হাল না ধরলে জাহাজটি পাইরেটদের দখলেও চলে যেতে পারে। এমতাবস্থায় এই জাহাজটি উদ্ধারের দায়িত্ব সিপাহী জনতা যখন তার উপর অর্পণ করেন তখন তিনি পিছিয়ে থাকেন নি। অপরাধ হলে এটিই তাঁর একমাত্র অপরাধ।
তিনি যদি তখন পিছিয়ে থাকতেন বা দায়িত্ব নিতে গড়িমসি করতেন তাহলে এই দেশরূপী জাহাজটি তখন সত্যিই ডুবে যেত। অথবা তখনই অন্য একটি দেশের করদ রাজ্যে পরিণত হয়ে পড়ত।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ জিয়ার ঘোষণা না এলে পাকিস্তানের হাত থেকে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন যেমন কঠিন হয়ে পড়তো তেমনি ১৯৭৫ এর নভেম্বর থেকে জিয়ার এই ভূমিকা না থাকলে অন্য একটি দেশের লোলুপ দৃষ্টি থেকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়তো।
কাজেই কোন বিবেচনাতে জিয়া ষড়যন্ত্রকারী নন, তিনি উদ্ধারকারী। তাঁর এই কাজের প্রকৃত বেনিফিশিয়ারি এই দেশ ও দেশবাসী।
শাহজালাল,শাহ মখদুম,শাহ পরান সহ শত শত পীর দরবেশদের পদধূলিতে পূণ্যময় হয়ে ওঠা এই ভূখণ্ডটির প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত রয়েছে এসব ঘটনা তাই প্রমাণ করে। আমাদের কিছু পাপ এবং ভুল ত্রুটির জন্যে আল্লাহতায়ালা মাঝে মাঝে কিছু শাস্তি দিবেন কিন্তু এই দেশ ও জাতিটিকে কখনই ধ্বংস করে দিবেন না।
কাজেই এখন যে আঁধার দেখা যাচ্ছে তাও অচিরেই কেটে যাবে বলেই মনে হচ্ছে।
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন