অলিউল্লাহ নোমান
ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন সমঝোতার মাধ্যমে। ১/১১-খ্যাত জরুরী আইনের অসাংবিধানিক সরকারের সাথে মূল সমঝোতাটি করেছিল ভারত। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তখন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মৃত্যুর আগে প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনী বের হয়েছে। বইটির নাম “দ্যা কোয়ালিশন ইয়ারস”। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনতে ১/১১-এর জরুরী আইনের অবৈধ সরকারের সাথে সমঝোতার বিষয়টি উঠে এসেছে এই বইয়ে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতির নানা ঘটনা বইটিতে বর্ণনা করেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি। ১/১১-এর জরুরী আইনের সরকারের আমলে শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়েছিলেন। শেখ হাসিনাকে কারামুক্ত করে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে মধ্যস্থতা করেছিলেন ভারতীয় এই রাজনীতিক। তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমদের সাথে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সমঝোতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য।
বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ভারত সফরে যান। তখন প্রণব মুখার্জির সাথে একটি বৈঠক হয়েছিল মইন ইউ আহমেদের। 'দ্যা কোয়ালিশন ইয়ারস' বইয়ে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ওই বৈঠকে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান তার কাছে চাকুরির নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, দু'জনের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক একটি আলোচনায় কারাগারে বন্দী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেবার জন্য মইন ইউ আহমেদকে বলেছিলেন প্রণব মুখার্জি। এক পর্যায়ে মঈন ইউ আহমেদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হবে। কিন্তু মঈন ইউ আহমদের চাকুরীর নিশ্চয়তাসহ দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। বইটিতে উল্লেখ করা হয়, প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধানকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তাঁর কোন সমস্যা হবে না।
মঈন ইউ আহমদ এখনো বেঁচে আছেন। প্রণব মুখার্জির বই বের হওয়ার পর তিনি এনিয়ে কোন রকমের প্রতিবাদ বা মন্তব্য করেননি। নীরবে কবুল করে নিয়েছেন এই সমঝোতার বিষয়টি। প্রণব মুখার্জি মারা যাওয়ার পর শেখ হাসিনা যে শোকবার্তা দিয়েছিলেন, তাতে তিনি প্রণব মুখার্জিকে 'অভিভাবক এবং পারিবারিক' বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শোক বার্তায় শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছিলেন, “যে কোন সংকটে তিনি সাহস জুগিয়েছেন।” প্রণব মুখার্জি তাঁর “দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস” বইয়েও শেখ হাসিনাকে ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেন।
মঈন ইউ আহমদের ভারত সফরের পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সমঝোতার নির্বাচনে কিভাবে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেটা বোঝার জন্য প্রণব মুখার্জির বইয়ের এই বার্তা গুলোই যথেষ্ট। ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। এই সফরে সময় প্রণব মুখার্জির অবদানের ঋন শোধ করেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে সমর্পণের মাধ্যমে। শেখ হাসিনার ভারত সফরে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। এই সমঝোতা স্মারকে মুচলেকা দিয়ে আসেন দেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে ভারতকে কি কি সুবিধা দেয়া হবে। এই সমঝোতা স্মারকের ফলোআপ হিসাবে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি গুলো শেখ হাসিনার সরকার প্রকাশ করেনি। যদিও সংবিধান অনুযায়ী চুক্তি জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের বিধান রয়েছে। অপ্রকাশিত এই চুক্তি গুলোর কপি আমার দেশ-এর হাতে রয়েছে। আমার দেশ ও সাউথ এশিয়ান পলিসি ইনিশিয়েটিভের যৌথ অনুসন্ধানে চুক্তি গুলো উদ্ধার করা হয়।
২০১৫ সালের ৬ জুন দুই দেশের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে ৬টি বিষয় উল্লেখ করা হয়। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও খুলনার সমুদ্রবন্দর ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হবে। এই দুই সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের এক পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে মালামাল পাঠানো হবে বাংলাদেশের রাস্তা ব্যবহার করে।
দ্বিতীয় বিষয়ে বলা হয়েছে, ভারতীয় একটি অঞ্চল থেকে আরেকটি অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার জন্য পণ্যবাহী কনটেইনার চট্টগ্রাম অথবা খুলনা সমুদ্রবন্দরে পৌছার পর বাংলাদেশের ভেতরে নৌপথ, রেলপথ, সড়ক পথ অথবা মাল্টি মডেল ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। মাল্টি মডেলের কোন সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। এতে স্পষ্ট ভারত যেভাবে চাইবে বা যে পথে চাইবে সেইভাবে তাদের পছন্দমত পথে যাতায়াত করবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। এতে বাংলাদেশের কোন রকমের কিছু করার থাকবে না। সার্বভৌমত্ব বিসর্জনের জন্য এই দুইটি বিষয়ই যথেষ্ট।
এ সমঝোতা স্মারকের আওতায় ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর দুই দেশের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষরিত চুক্তিটিকে সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়ার দলীল বলা যেতে পারে। এই চুক্তিতে মোট ১৪টি আর্টিকেল রয়েছে। এরমধ্যে ৪ নম্বর আর্টিকেলের উপধারা ১-এ বলা হয়েছে, ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দরে যেসব কনটেইনার আসবে সে গুলো রেগুলার ফিজিক্যাল ইন্সপেকশনের আওতামুক্ত থাকবে। অর্থাৎ বন্দরে কোন কনটেইনার পৌঁছানোর পর নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিধান রয়েছে। কিন্তু ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য আসা কনটেইনার বন্দরের নিয়ম ভঙ্গ করে বা নিয়মের ঊর্ধ্বে উঠে সুবিধা দিতে হবে। ভারতীয় কনটেইনার পরীক্ষা করা যাবে না। ভারতীয় পণ্যবাহী কনটেইনার গুলো থাকবে অস্পর্শ।
এই আর্টিকেলের ৩নং উপধারায় বলা হয়েছে, বন্দরে পৌছার পরিবহনে করে ভারতের অন্যপ্রান্তে যাওয়ার পথে কোন কর্তৃপক্ষের এটা পরীক্ষা করার এখতিয়ার থাকবে না। রাস্তায়ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতামুক্ত থাকবে।
একই আর্টিকেলের ৪ নম্বর উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ভারতের এক প্রান্ত থেকে বন্দরে পৌঁছানোর পর অন্য প্রান্তে যাওয়ার পথে ই-লক বা ই-সিল লাগিয়ে ট্র্যাকিং করা যাবে না।
আর্টিকেল-৮ এ বলা হয়েছে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য বন্দরে আসা কনটেইনারে থাকা পণ্য ডিউটি মুক্ত ও ট্যাক্সের আওতামুক্ত থাকবে।
আরো ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, ভারতের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য কনটেইনারবাহি জাহাজ বন্দরে পৌঁছালে এবং একই সময়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আমদানি করা পণ্যের জাহাজ পৌঁছালে, অগ্রাধিকার পাবে ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ। বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যবাহী জাহাজে যাই থাকুক এমন কি দ্রুত পচনশীল পণ্য থাকলেও ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ অগ্রাধিকার পাবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধার উপরে ভারতীয় সুযোগ সুবিধাকে স্থান দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে এধরনের অনেক চুক্তি করেছে। যেসব চুক্তির শর্ত গুলো সবই হচ্ছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী। দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী এমন চুক্তি গুলোর মধ্যে বন্দর ও রাস্তা ব্যবহারের সুযোগ সুবিধা নিয়ে গত ৭ আগস্ট আমার দেশ লাইভে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। একই দিনে লিড নিউজ করা হয়েছে আমার দেশ-এর অনলাইনে।
জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি নিয়ে আগামী রবিবার একই সময়ে আমার দেশ লাইভ অনুষ্ঠিত হবে। এই অনুষ্ঠানেও আমার দেশ সম্পাদক জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তির শর্ত গুলো নিয়ে কথা বলবেন। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে শেখ হাসিনা কিভাবে ভারতের ঋন শোধ করেছেন সেটা জানতে চোখ রাখুন আমার দেশ ইউকে ইউটিউব ও আমার দেশ ইউকে ফেইসবুক পেইজসহ আমার দেশ অনলাইনে।
উল্লেখ্য, ভারতকে ট্রানজিট দিলে দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে বলে এক সময় প্রচারণা চালিয়েছিল দালাল মিডিয়া হিসাবে খ্যাত প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার। তাদের সঙ্গে প্রচারণায় ছিল সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ)। সিপিডির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক প্রায়ই ভারতকে ট্রানজিটের পক্ষে ওকালতি করে বলতেন ট্রানজিট দিলে দেশ অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া হয়ে যাবে। ইন্ডিয়াপন্থি কথিত সুশীলরাও ট্রানজিটের পক্ষে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কিছুই বলতেন। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতে যারা এই প্রচারণায় নেমেছিলেন জনতার আদালতে তাদের বিচার দাবি করেই আজকের লেখা শেষ করছি।
লেখক, সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন