মিনার রশিদ
এক ভাই প্রশ্ন করেছেন, এই যে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আব্দুর রহিম পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন, তিনি কি ‘শহীদ’ হিসাবে গণ্য হবেন? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দলের একজন নেতা দেশের বিপন্ন স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন, তাঁকে কি শহীদ হিসাবে সম্বোধন করতে আমরা কোনোরূপ সংকোচ বোধ করছি?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই ইন্টারেস্টিং এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন!
শহীদ বা শাহাদত একটি ইসলামিক পরিভাষা! সাধারণত ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে বা তা রক্ষা করতে যারা আত্মহুতি দেন তাদেরকে শহীদ হিসাবে গণ্য করা হয়। এদেশে আওয়ামী লীগকে নিয়ে জটিলতাটি হলো যে এরা জেহাদ শব্দটিকে খুবই অপছন্দ করে। বিরোধী দল ও মতের রাজনৈতিক কর্মীদের সকল ধর্মীয় বইকে জেহাদি বই হিসাবে লেবেলিং করে ইসলামোফোবিক বিশ্বের সহানুভূতি পাবার চেষ্টা করে! তবে জেহাদেরই একান্ত ফসল এই শহীদ শব্দটিকে যারপরনাই পছন্দ করে! এমনকি শব্দটিকে তারা একান্ত নিজেদের সম্পদ বলে গণ্য করে।
ইংরেজি ‘মারটায়ারড’ শব্দটিরও অনুবাদ করা হয়েছে এই একই শহীদ শব্দটি দিয়ে। ফলে শহীদ শব্দটির আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনার সাথে সাথে একটা সেক্যুলার বা বাহ্যিক অর্থ সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭১ সালে যারা দেশের স্বাধীনতার জন্যে আত্মহুতি দিয়েছেন, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে শহীদ হিসাবে গণ্য করা হয়। এখানে শহীদ শব্দটির ধর্মীয় অর্থ নহে বরং সেক্যুলার (Martyr) ভাবধারাটি নেয়া হয়েছে! ফলে অমুসলিমদের জন্যে এই শব্দটি ব্যবহারে অসুবিধা হয় না!
এখানে ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, অমুসলিমদের ক্ষেত্রে শহীদ শব্দ প্রয়োগের কারণে এদেশের ধর্মীয় ব্রিগেড কারো উপর হামলা করে নাই। কিন্তু চেতনা ব্রিগেইড এই কাজটি করে ফেলেছে!
কিছুদিন আগে সম চেতনা সম্পন্ন একটি গ্রুপ দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক জনাব আবুল আসাদকে দৈহিকভাবে নাজেহাল করে এবং পুলিশের হাতে তুলে দেয়। তাঁর এবং তাঁর পত্রিকার অপরাধ জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার নামের আগে ‘শহীদ' শব্দটি যোগ করা। দেশের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ সেই সম্পাদক অনেকদিন জেল খেটে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। সেদিন যে মরাল ব্রিগেইড এই ফ্যাসিবাদি গোষ্ঠীর স্বরূপ পুরাপুরি চিনতে পারেন নি তারা এবার হিরো আলম কেইসে কিছুটা চিনেছেন! এখন যারা হিরো আলমের নামের আগে হিরো শব্দ নিয়ে আপত্তি তুলেছেন সেই একই অন্ধগোষ্ঠী কাদের মোল্লার নামের আগে ‘শহীদ’ শব্দটি বসানো নিয়ে কড়া আপত্তি তুলেছিল। দেশের চিহ্নিত বুদ্ধিবৃত্তিক পাহলোয়ানরা এতে সমর্থন যোগায় এবং সঙ্গত কারণেই দেশের মরাল ব্রিগেড ঋষিবত নীরবতা পালন করে! বিএনপি নেতা সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীর নামের আগে শহীদ লেখায় ছাত্রলীগের প্রাক্তন এক সাধারণ সম্পাদকও তার কবরে ভাঙচুর করেছিলেন!
৭১-এ দেশটির মুক্তির জন্যে যারা জীবন দিয়েছিলেন তারা শহীদ হিসাবে গণ্য হলে সেই একই দেশের মুক্তির জন্যে এখন জীবন দিলে আব্দুর রহিম কেন শহীদ বলে গণ্য হবেন না? এটি আধ্যাত্মিক নয়- একটি সেক্যুলার প্রশ্ন!
নিজের দেশ ও ধর্ম রক্ষার জন্যে যারা নানা ভাবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবেন এঁরা উপরোক্ত দুটি অর্থেই সবাই শহীদ হিসাবে গণ্য হবেন! কাজেই গতকাল ফ্যাসিবাদি পুলিশের হাতে নিহত স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আব্দুর রহিম নি:সন্দেহে একজন শহীদ!
বর্তমান ফ্যাসিবাদ যেভাবে জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে সেখানে জানি না- এরকম আর কত আব্দুর রহিমের রক্ত ঝরাতে হবে? আমাদের জন্যে মারাত্মক অপরাধ হবে যদি আব্দুর রহিমদের এই আত্মোৎসর্গকে আমরা হাল্কা করে দেখি! আবরার থেকে আব্দুর রহিম -প্রত্যেকটি উৎসর্গ এখানে অনন্য। এরা প্রত্যেকেই শহীদ, প্রত্যেকেই দেশের জন্যে জীবন উৎসর্গকারী একেকজন মহাতারকা!
শহীদ আব্দুর রহিম তো সেই জালিম সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জীবন উৎসর্গ করেছেন যারা মদিনার সনদ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ঘোষণা দিলেও একে একে সকল আলেমদের জেলে ভরে ফেলেছে! ওয়াজ, খুতবা এসব এখন মসজিদ কমিটির সভাপতির মর্জি অনুযায়ী পরিচালনা করতে হয়! একটু উল্টা পাল্টা হলেই ইমাম সাবের চাকরি-নট হয়ে যায়! কওমী মাদ্রাসার সনদ দিয়েছে কিন্তু সেই সনদ দিয়ে সরকারী অফিসে একটি কেরানীর চাকুরিও জুটে নাই! আলেম ওলামারাও এতটুকু অসহায় হয়ে পড়েছেন যে মূর্তি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে মোনাজাত করতে ইতস্তত: করলেও বিবি বাচ্চার রুজিতে হাত পড়ে! আব্দুর রহিম তো সেই লুটেরা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শহীদ হয়েছেন যারা জনগণের সম্পদ লুট করে দেশটিকে ফতুর বানিয়ে দিয়েছে! শহীদ আব্দুর রহিম তো সেই জালিম সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছেন যে সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে গুম, হত্যা করেছে, নিরীহ মানুষকে জঙ্গি সাজিয়ে হত্যা করে ইসলামোফোবিক বিশ্বে পয়েন্ট কামিয়েছে!
শহীদ আব্দুর রহিম আল্লাহ পাকের দরবারে এরকম শত শত ফরিয়াদ উপস্থাপন করতে পারবেন!
আমরা সকলেই আল্লাহ তায়ালার কাছে তাঁর এই শাহাদত কবুলের জন্যে দোয়া করি! মানবিক সীমাবদ্ধতায় তাঁর সকল গোনাহ খাতা মাফ করে আল্লাহ শহীদ হিসাবে কবুল করুন। আমিন!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন