মিনার রশিদ
সুপ্রিয় স্যার,
১৯৮২-১৯৮৪ সালে ঢাকা কলেজে আপনার ছাত্র ছিলাম! তজ্জন্যে আলাদা একটা গর্ব সব সময় অনুভব করেছি। প্রিয় স্যার, আপনার জন্মদিন উপলক্ষে প্রাক্তন ছাত্রদের অনেকেই উচ্ছাসভরে অনেক প্রশংসা করেছেন। সেই সব প্রশংসার অনেক কিছুই আপনার যথাযথ প্রাপ্য, খুব বেশি অতিরঞ্জিত নয়!
ছোটবেলায় যে হেমিলনের গল্প পড়েছি ঢাকা কলেজে এসে সেই হেমিলনের বাঁশিওয়ালার যাদুকরী বাঁশিটি আপনার হাতেই দেখেছি। অন্যান্য বাংলা শিক্ষকের ক্লাসে যেখানে প্রথম সারির দু তিনটি বেঞ্চ ভরাই কষ্টকর হয়ে পড়ত সেখানে আপনার ক্লাসে কলেজের গ্যালারিগুলি উপচে পড়ত। আপনার যাদুকরী কথা (বাঁশীর সুর) শুনতে অন্যান্য সেকশনের ছাত্ররাও নিজেদের ক্লাস রেখে চলে আসত। ঢাকা কলেজে তখনও কোনো ছাত্রী ভর্তি করা হত না! যে কোনো ব্যাচের ছাত্রদের ক্লাসেই আপনার সম্পর্কে এই কথাটি শোনা যায়!
কথা বলা একটি বড় আর্ট বা শিল্পI আর সেই শিল্পের সেরা শিল্পী নিঃসন্দেহে আপনি! আলোকিত মানুষ গড়ার কথা শুনিয়েছেন! বলেছেন, মানুষ তার স্বপ্নের মত বড়।
এত সবের পরে আজ মধ্য পঞ্চাশে পৌঁছে কোথাও যেন একটা বড় ফাঁক দেখতে পাই। সেই ফাঁকটি উপলব্ধি করলেও ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন! আপনার নিজের প্রডাকশন সহ আজ বড় বড় কথা বলার মানুষের অভাব নেই। অভাব সেই কথা অনুযায়ী কাজ করার মানুষের!
এদেশের প্রশাসন, প্রকৌশল, কৃষি, মেডিসিন সকল জায়গায় যে কর্তারা বসে আছেন- আমার বিশ্বাস, এদের কমপক্ষে অর্ধেক আপনার সরাসরি ছাত্র Iবাকিরাও আপনারই ভাবশিষ্য- এরা কেউ অন্ধকারের মানুষ না, সবাই আলোকিত মানুষ। এরাই বিভিন্ন পাঁচ তারকা আয়োজন সমৃদ্ধ অনুষ্ঠানে গুণমুগ্ধ ছাত্র হিসাবে অনুষ্ঠানের শোভা বর্ধন করে! আপনার প্রতিটি বাক্য শুনে সেই কলেজের ছাত্রদের মতই হেসে গড়াগড়ি খায়!
কিন্তু স্যার,আপনার এই আলোকিত মানুষদেরই কেউ কেউ এদেশে প্রতি কিলোমিটার রাস্তা বাবদ খরচ পৃথিবীর সর্বোচ্চ বানিয়েছে! এক কেজি লোহার নাট বল্টুর দাম এক কোটি টাকা বানিয়েছে!
‘মানুষ তার স্বপ্নের মত বড়’রাই তো এক পর্দার দাম ২৭ লাখ টাকা এবং বালিশের দাম ৬ হাজার টাকা বানিয়েছে, ১৬ গুণ অতিরিক্ত দামে মেডিকেলের বই কিনেছে । যেগুলির দাম ১৬গুণ, ২০গুণ, ৫০ গুণ বেশি হয়েছে, সেগুলি জনগণের গোচরে এসেছে । দু-চার-পাঁচগুণ হলে তা জনগণের গতরে লাগতো না। বর্তমান ট্রেন্ড থেকে মোটামুটি ধরা যায় যে ৬লাখ কোটি টাকা বাজেটের আকার, এর মধ্যে সম্মিলিত লুটপাটেই চলে যাচ্ছে ৪ লাখ কোটি টাকা!
আপনার সেই সব তুখোড় ছাত্রদের বড় অংশই তো ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। সচিবালয়ের বর্তমান হর্তাকর্তাদের একটা বড় অংশও সম্ভবত এই ঢাকা কলেজে আপনার ছাত্র ছিলেন ! নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এরা শতভাগ আপনার ভক্ত। এরা সবাই আপনার দ্বারা অনুপ্রাণিত! সরকারী কেনা টাকায় আজ যে হরিলুট সেই হরিদের অধিকাংশই স্যার আপনার এই স্বপ্নের মত বড় মানুষগুলো! মূল মাফিয়া রাজনৈতিক ঘরানার হলেও এদের সহযোগিতা করে প্রশাসন থেকে এই হরিরা! হল ভর্তি আলো ঝলমলে পরিবেশে আপনার কথা শুনে যারা তুমুল হাততালি দেন, এদের মধ্যে ইনারাও রয়েছেন। কে জানে সামনের চেয়ারগুলোর অধিকাংশই হয়তোবা এই আলোকিতদের (?) জন্যেই বরাদ্দ থাকে!
কেউ কেউ সুন্দর সুন্দর কথা বলে আপনার সমকক্ষ হয়েছেন কিংবা আপনাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। এদের মধ্যে একজন প্রকাশ্য দিবালোকে বর্তমান সরকারের প্রশ্রয়ে ভোট ডাকাতি করে মেয়রও হয়েছিলেন! কুইক রেন্টালে লোহালক্কড় ভাড়া দিয়ে সরকারের কাছ থেকে বিরাট অংকের টাকা নেয়ার অভিযোগও শোনা গেছে। টিভি অনুষ্ঠানে তার চেয়ে সুন্দর ও রোমান্টিক কথা আর কারও মুখ থেকে শুনি নাই। এরকম গ্ল্যামারাস মাফিয়ারাও আপনার স্নেহের পরশ থেকে বঞ্চিত হয় নাই কিংবা আলোকিত মানুষের তালিকা থেকে নাম কাটা পড়ে নাই!
এরা আপনার কথার খোঁচা তেমনভাবে খেয়েছে বলে মনে হয় না। তবে যাদের ঘাম,পরিশ্রম ও সেক্রিফাইসের কারণে মহালুটপাটের পরেও এদেশের অর্থনীতি টিকে রয়েছে সেই ‘আনকুথ’ আনস্মার্ট প্রবাসী শ্রমিকেরা আপনার কথার খোঁচা ঠিকই খেয়েছে! আনকুথ প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করে শহুরে বাবু পরিবেষ্টিত হয়ে তাদের বিনোদিত করেছেন!
আমরা জানতাম, আপনি কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন না। দেশের পরিস্থিতি যতই সঙ্গিন হোক না কেন, রাজনীতিতে যতই প্রলয় লাগুক না কেন-আপনি এ বিষয়ে আপনার ঋষিবত মৌনতা বজায় রাখেন।
কিন্তু ইদানীং একটি অনুষ্ঠানে প্রয়াত এক নেতার গুণকীর্তন করে অনেকের ভ্রু কপালে তুলে দিয়েছেন! ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে একজন দেবতার দরকার! রাজনীতি বিমুখ আমাদের প্রিয় স্যার সেই কাজটিতে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। জানি না ইনি এই কাজটি বুঝে করছেন নাকি না বুঝে ?
আলোচিত সাগর রুনির হত্যাকাণ্ড, আবরার হত্যাকাণ্ড, বর্তমান সরকারের গুণ্ডা বাহিনী কর্তৃক হাজার হাজার খুন -গুমের ব্যাপারে বিশ্বের সকল মানবাধিকার সংস্থাগুলি সরব হলেও আপনি বরাবরই নিরব থেকে গেছেন। আপনার সেলেব্রিটি স্ট্যাটাস নিয়ে এই সব অনিয়ম অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেখাতে পারেন নি। দেশের গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে দু-দুটি প্রহসনের নির্বাচনকেও অপরাপর সুশীল সমাজের মত ই আপনি তা সহজভাবেই গ্রহণ করেছেন! কথার যাদুকর হওয়া সত্ত্বেও কৌশল করেও বলতে পারেন নি যে নির্বাচনে নিজের ভোটটিও দিতে পারেন নাই।
হতভাগা এই জাতির বিবেক হওয়ার সমস্ত বৈশিষ্ট্য আপনার মধ্যে ছিল, স্যার। যে জিনিসটির অভাব, সেটি হলো–সাহস!
প্রিয় স্যার, এই অধম ছাত্রটির বেয়াদবি নিজ গুণে মাফ করবেন। একজন সুখী মানুষের সুখের নিদ্রা আপনার প্রাপ্য। তারপরেও কোনো আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, তবে এই কয়েকটি বিষয় নিয়ে ভাবার অনুরোধ জানাচ্ছি, স্যার।
জন্মের পর সমাজটিতে যতটুকু আলো ছিল, যতটুকু মানবিকতা ছিল, যতটুকু নৈতিকতা ছিল-মৃত্যুর পূর্বে সেই মানে রেখে যেতে পারছেন কি?
একজন আলোর ফেরিওয়ালার কাছে মেকি বা কৃত্রিম আলোর চ্ছটায় আসল আলোটিই অধরা রয়ে গেলো না তো, স্যার?
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন