মাহমুদুর রহমান
পরিস্থিতি প্রতিকূলে গেলেই শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে ধোকা দেওয়ার জন্য সাময়িকভাবে খানিকটা সুর পরিবর্তন করে থাকেন। বিপদ উত্তীর্ণ হওয়া মাত্র ফ্যাসিস্ট শাসক তার ভয়ংকর স্বরূপে ফেরেন। মাত্র কিছুদিন আগে পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপার্সন, বেগম খালেদা জিয়াকে সেতু থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। সেই একই রক্তপিপাসু ব্যক্তি এখন বিএনপির নেতাদের গণভবনে চা পানের লোভ দেখাচ্ছেন। ২০১৮ সালে এই নেতাদেরই গণভবনে কমলার রস খাইয়ে নির্বাচনে তাদের কি হাল করেছিলেন সেটা বিএনপির নেতারা ভুলতে চাইলেও দেশের জনগণ সম্ভবত: এখনও ভোলেন নাই। সেই সময় ভারত ও আমেরিকাকে খুশি করার জন্য বিএনপি ড: কামাল হোসেনকে ভাড়া করে এনে নেতা বানিয়েছিল। অরেঞ্জ জ্যুসের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সেদিন কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপির নেতারা শেখ হাসিনার সাথে খোশগল্প করে যার যার বাড়িতে ফিরে সুখনিদ্রায় মগ্ন হয়েছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী ৬০ আসনের মধ্যে কার কার ভাগ্যে শিঁকে ছিড়বে সেই হিসেব কসতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আড়ালে চলে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ ভুয়া মামলায় বেগম জিয়াকে কারাগারে রেখেই বিএনপি সোৎসাহে হাসিনার পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এখন পর্যন্ত দলটির গুটি কয়েক জোকার সংসদে উপস্থিত থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে এক প্রকার বৈধতা দিয়ে চলেছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করতে মাঝেমধ্যে সেই খোয়াড়ে তারা যে সমস্ত গরম বক্তৃতা দিয়ে থাকেন সে সবের আগাম অনুমতি স্বয়ং শেখ হাসিনার কাছ থেকে নিয়ে আসেন কিনা সেটা তারাই ভাল জানেন।
শেখ হাসিনার চা খাওয়া সংক্রান্ত মশকরার প্রতিক্রিয়া বিএনপির দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার কাছ থেকে দুই রকম এসেছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর শর্তসাপেক্ষে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেনে নিলে চা পানে আপত্তি নাই। এর আগে ২০১৮ সালে ড: কামালের নেতৃত্বে তিনিও গণভবনের দাওয়াতে উপস্থিত ছিলেন। ধারনা করছি, এবার গণভবনে গেলে মির্জা ফখরুলই দলের নেতৃত্ব দেবেন। যে ব্যক্তি এত গুমখুন করেছেন, দলীয় প্রধানের উপর অমানবিক জুলুম চালিয়েছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব বিলিয়ে দিয়েছেন, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন, তার দেয়া চায়ের কাপে সকলের পক্ষে চুমুক দেয়া সম্ভব নয় বলেই আমার ধারনা। অপরদিকে, রুহুল কবির রিজভী জানতে চেয়েছেন চায়ের সঙ্গে ধুতুরার বিষ মেশানো থাকবে কিনা। তিনি অবশ্য ২০১৮ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও স্মরণ করেছেন। এদের প্রতিক্রিয়া থেকে আমার মনে হয়েছে দলটি এখনও করণীয় নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগছে। নেতাদের মধ্যেও ঐক্যের অভাব রয়েছে।
ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির তৃণমূল আন্দোলনে উৎসাহী হলেও, শীর্ষ নেতৃত্ব ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করেছে বলেই এখন পর্যন্ত প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা হয়ত মনে করছে যে, যেহেতু কোন দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন ধরে রাখা সম্ভব নয়, তাই আগামী বছরের শেষার্ধে স্বল্প সময়ের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলাই বাস্তবসম্মত হবে। প্রসংগক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়া অন্যায়ভাবে গ্রেফতার হওয়ার পরও একই প্রকার ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করার ফলেই প্রায় পাঁচ বছরেও তাকে মুক্ত করা সম্ভব হয় নাই। গ্রেফতারের দুই দিন আগে বিএনপির সর্বশেষ নির্বাহী কমিটির বৈঠকে বেগম জিয়াকে দিয়ে কেন বলানো হয়েছিল যে, তিনি গ্রেফতার হলেও যেন কোন কার্যকর আন্দোলন করা না হয়, তার উত্তর আজ পর্যন্ত মেলে নাই। বিএনপির নেতৃত্বের কাছে কেন বেগম জিয়ার মুক্তির চেয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে হাসিনার পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছিল তার জবাবও আমাদের জানা নাই। এ সব প্রশ্নের উত্তর দলের পক্ষ থেকে জানানো না হলেও, অন্যায়ভাবে বেগম জিয়াকে জেলে নেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন না করার সিদ্ধান্তের দায় বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বহন করে যেতে হবে।
দল নিষ্ক্রিয় থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়েই বেগম জিয়ার আত্মীয়স্বজন শেখ হাসিনাকে অনুনয়-বিনয় করে গুরুতর অসুস্থ সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বন্দী অবস্থাতেই জেল থেকে নিজ গৃহে স্থানান্তর করাতে সমর্থ হয়েছেন। তার ফলে গৃহবন্দী বেগম খালেদা জিয়া দেশের চিকিৎসাটুকু অন্তত পাচ্ছেন। জেলখানায় চিকিৎসার নামে কী জোটে সেটা প্রায় পাঁচ বছরের কারাবাসকালে নিজে দেখেছি। দূর্ভাগ্যবশত: বিনা চিকিৎসায় বিএনপি এবং জামাতের কতজন নেতাকে আওয়ামী সরকার গত চৌদ্দ বছরে হত্যা করেছে সে সম্পর্কে কোথাও কোন আলোচনাও শুনতে পাই না। কাশিমপুর কারাগারে বন্দী আমার বুয়েটের বন্ধু, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রহিমকেও শেখ হাসিনা চিকিৎসা না দিয়ে সম্প্রতি হত্যা করেছেন। আমরা তো বুড়ো হয়ে গেছি। আশা করি, জাতি একদিন এই সকল হত্যার হিসেব কড়ায় গন্ডায় গ্রহণ করবে।
অনেকটা আকস্মিকভাবেই শেখ হাসিনার সিংহাসন টলতে শুরু করেছে। তিনি আশা করেছিলেন ক্রমবর্ধমান রপ্তানী আয়, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা, কৃষকদের পরিশ্রম এবং জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া করের বোঝার উপর নির্ভর করে তার জীবদ্দশা পর্যন্ত লুটপাট অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যেতে পারবেন। অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক মেগাপ্রকল্প লুটপাট ও প্রচারণার জন্য সহায়ক হলেও এ সবের দায় কত দ্রুত একটি দেশকে দেউলিয়া বানাতে পারে সে সম্পর্কে শেখ হাসিনার উপদেষ্টারা সম্ভবত: অজ্ঞ ছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, চৌদ্দ বছরের অব্যবস্থাপনা ও সীমাহীন দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকেই প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। সরকারের দালাল অর্থনীতিবিদরাও আজকাল বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, ২০২৪ সাল থেকে তথাকথিত মেগা প্রকল্পসমূহের দায় পরিশোধ শুরু হলে দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে।
এতদিন ভুয়া উন্নয়নের দোহাই দিয়ে জনগণের উপর জুলুম করার যে আন্তর্জাতিক বৈধতা শেখ হাসিনা উপভোগ করছিলেন তার অবসানের উপক্রম হয়েছে। সেই সাথে ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে “ইসলামী জঙ্গী কার্ড” অকেজো হয়ে গেছে। মার্কিন স্যাংকশন সেই পরিবর্তনেরই আলামত। এদিকে ২০১৮ সালের তামাশার নির্বাচনের মেয়াদও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কাজেই, রক্তলোলুপ পিশাচীনির আসল রূপ পাল্টে ১৯৯৬ সালের তাহাজ্জুতি হিজাবীর নকল চেহারা নেয়ার সময় এসেছে। এখন বিএনপির নেতৃত্বকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা পিশাচীনির টলটলায়মান সিংহাসন সাহস করে সম্মিলিতভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে তাকে চূড়ান্ত বিচারের জন্য জনগণের হাতে সমর্পণ করবে নাকি ২০১৮ সালের মত আবারও মায়াজালে বিভ্রান্ত হয়ে দেশ ও দলের সর্বনাশ ডেকে আনবে।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন