মিনার রশিদ
যতগুলি আওয়ামী বয়ান ‘নিরপেক্ষ’ প্লাটফর্মে ঘোরাঘুরি করছে- তন্মধ্যে শিরোনামের এই আক্ষেপটি অন্যতম।
এই প্রশ্নটি প্রায়ই শুনতে হয়। অন লাইনে তো আছেই, অফলাইনে দেখা হলেও কেউ কেউ এই একই প্রশ্ন করেন। কোনো কোনো সুহৃদ আবার একটু লোভও দেখান, সবার কাছে গ্রহনযোগ্য করে লিখলে আপনার/তোমার গ্রহনযোগ্যতা অনেক বেড়ে যেত!
আগের এক মুখী যোগাযোগ ব্যবস্থার (One Way Communication) পরিবর্তে টেকনোলজির কল্যাণে এখন দ্বি-মুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা (Two Way Communication) শুরু হয়েছে। এখন লেখক বা বক্তাগণ তাদের লেখার বা কথার ফিডব্যাক পাঠক বা শ্রোতাদের পক্ষ থেকে সরাসরি পেয়ে যান। এরকম সামাজিক ডায়লগ বা বিতর্ক অন্যান্য পাঠকগণও পড়তে পারেন বা উপভোগ করতে পারেন। একটি জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় এই দ্বি-মুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। নিজের শত ব্যস্ততার মাঝেও সেজন্যে চেষ্টা করি, পাঠকদের মনে উথ্থাপিত যৌক্তিক প্রশ্নগুলির জবাব দিতে।
জনৈকা স্ত্রী একবার তার স্বামীর গলায় এবং আরেকবার আরো মারাত্মক জায়গায় ছুরি চালিয়েছিল! একবার বিষ খাইয়েও মারতে চেয়েছিল। কিন্তু রান্নার হাত ভালো, সাজুগুজুও করে ভালো, চেহারা সুরতও ভালো। এমতাবস্থায় স্বামী বেচারা স্ত্রীর শেষোক্ত কয়েকটি গুণের প্রশংসা করবে নাকি প্রথমোক্ত সমস্যা নিয়ে কথা বলবে বা এগুলি থেকে স্ত্রীকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে বা নিজের পরিত্রাণের চেষ্টা করবে?
দুদিন আগে এক বড় ভাইয়ের উপরোক্ত প্রশ্নের জবাবে এই উদাহরণটি দিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, এমন ভয়ংকর Wrong headed স্ত্রীকে প্রশংসা করে (হাতের নাগালে থাকলে ভিন্ন কথা) নিজের জীবন খোয়ানো কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
শেখ হাসিনা এদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরো ধ্বংস করেছে, বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। এরপর কিছু কসমেটিক উন্নয়নের নামে করেছে মহালুটপাট। দেশ থেকে পাচার হচ্ছে বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। কুইক রেন্টালে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে স্রেফ লোহালক্করের ভাড়াবাবদ গচ্চা দিয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। এমন একজন মাথা খারাপ ক্যান্সার রোগীর ঠোঁট সুন্দর, চোখ সুন্দর এসব অঙ্গের প্রশংসা করা কতটুকু নিরাপদ হবে বা বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
উন্নয়ন উন্নয়ন বলে এতদিন কান ফাঁটিয়ে ফেলেছে, শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে। এখন লাগাতার লোড শেডিং কে জাষ্টিফাই করার জন্যে বলছে অষ্ট্রেলিয়ায় ১৫/১৬ ঘন্টা লোডশেডিং হচ্ছে (বয়ানে হাছান মাহমুদ), সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের জন্যে জনগণকে প্রস্তুত করতে শোনাচ্ছে যে উন্নত বিশ্বে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে (বয়ানে শেখ হাসিনা)।
শেখ হাসিনার এই কসমেটিক উন্নয়নকে বোঝাতে এই সত্য ঘটনাটি একটু সহায়ক হতে পারে। আমি তখন বাংলাদেশী একটি শিপিং কোম্পানীতে সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে সেইল করছি। জাহাজটি ছিল খুবই পুরোনো, এর মেইন ইঞ্জিন অতিমাত্রায় লুব ওয়েল খেয়ে ফেলত (Lub oil consumption was very high). একারণে আগের চীফ ইঞ্জিনিয়ারের উপর জাহাজের মালিক পক্ষ খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। মেইন ইঞ্জিনের তেল খাওয়া কমাতে উনি যে রিপেয়ার প্ল্যান দিয়েছিলেন তা মালিকপক্ষের পছন্দ হয় নাই। কারণ এতে প্রচুর টাকা খরচ করতে হবে। কাজেই খাজনার চেয়ে বাজনা কমাতে চীফ ইঞ্জিনিয়ার পাল্টে দিলেন। পরের চীফ ইঞ্জিনিয়ার যোগদান করলেন। কিছুদিন পর দেখা গেলো রাক্ষসের মত লুবওয়েল খাওয়া কমে গেছে। শুধু তাই না, এখন তেলের লেবেল একটু একটু বাড়ছে! চেক করে দেখি লুব ওয়েলের সঙ্গে নোনা পানি (Sea water) মিশে গেছে অর্থাৎ মেইন ইঞ্জিনের সাম্পে নোনা পানি ঢুকে পড়েছে! লুবওয়েল অনেকটা সাদা (Emulsified) হয়ে গেছে! বিষয়টি চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে জানালাম। উনি বললেন, এব্যাপারে কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। মনটি খারাপ হলেও মুখ দিয়ে কিছু বললাম না! কারণ মেরিন একাডেমির সেই গ্যারিসনি ট্রাডিশন!
এখন সংগত কারণেই মেইন ইঞ্জিনে নতুন করে লুবওয়েল নেওয়ার দরকার পড়ে না। এতে চীফ ইঞ্জিনিয়ার সাবের প্রতি মালিকপক্ষ মহা খুশি। যদিও তেলের সাথে নোনা পানি মিশে যে ক্ষতি হওয়ার তা নীরবে ঘটিয়ে গেছে। মালিক পক্ষ সাময়িক খুশি হলেও পরবর্তি ড্রাই ডকের সময় যখন ইঞ্জিন খোলা হয়েছে, তখন ইঞ্জিনের ক্র্যাংকশাফটে বড় বড় গর্ত এবং করোসনের কারণে অনেক দামী রিপেয়ার করতে হয়েছে!
এটারই নাম সিকোয়েন্সিয়াল কনসিকোয়েন্স। এটা যেমন একটি যন্ত্রের বেলায় প্রযোজ্য তেমনি রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের বেলাতেও প্রযোজ্য। লুব ওয়েলের মধ্যে নোনা পানি ঢুকে উক্ত ধূর্ত (স্মার্ট) চীফ ইঞ্জিনিয়ারের জন্যে যে সুযোগ সৃষ্টি করেছিল হুবহু শেখ হাসিনার জন্যে একই সুযোগ সৃষ্টি করেছে বিশ্বরাজনীতিতে কথিত সন্ত্রাশবিরোধী যুদ্ধটি! মুসলিম জাহানের পুড়েছে (মেইন ইঞ্জিন) ঘর, হাসিনা তাতে শুকিয়েছে তার ভেজা কাপড়! আমার চীফ সাহেবের হাতে যে ম্যাজিক ছিল শেখ হাসিনার হাতে সেই একই ম্যাজিক! উপরের মালিকপক্ষ সাময়িক লাভ দেখেই বিভ্রান্ত হয়েছিল। নিজেদের কতটুকু সর্বনাশ হয়েছিল তা তলিয়ে দেখে নাই। একই ভাবে দেশটির বোকা মালিকপক্ষ বা অংশবিশেষ যেন শুধু কসমেটিক উন্নয়ন দেখেই বিমুগ্ধ! কসমেটিক উন্নয়নের চমকটুকু দেখলেও এর পরিণামটুকু এরা দেখতে পারে না।
এরা সম্ভবত কখনোই তা দেখতে পারবে না! কারণ এদের চোখে ও কানে আজব মোহর মারা রয়েছে।
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন