মিনার রশিদ
বহুল আলোচিত পুলিশ দম্পতির আদরের কন্যা ঐশী, নিজ হাতে বাবা মায়ের কল্লা কেটেছিল! এটাকে প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি উর্ধ্বতন জগত থেকে মানুষকে এলার্ট করার কোনো সিগনাল ছিল, জানি না! ঘুষের সাথে পুলিশ বাহিনীর সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। কিন্তু অমানবিক নিষ্ঠুরতার শুরুটি সম্ভবত ২০০৯ থেকে, যখন জনগণের একটা অংশকে টেরোরাইজ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ফলে বর্বরতা ও জুলুমের সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়। শিবির ও ছাত্রদলের অনেক ছেলেকে নির্যাতন করে এমন করেছে যে ওরা আর জীবনে বিয়ে সাদি করতে পারবে না। এরকম অনেক বর্বরতম কান্ড ঘটিয়েছে ক্ষমতার মদে মত্ত এদেশেরই কিছু সংখ্যক মানুষ!
এখন প্রশ্ন, পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য এদেশের মানুষের উপর যে জুলুম নির্যাতন করেছে সেটা কী শুধু ঐশীর বাবা মায়ের উপর দিয়ে গিয়েছে? অনেকগুলি লেসন কি এখানে প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক একসাথে শিখিয়ে গেছে? এখানে কোথাও কি লাগাম টেনে ধরতে চেয়েছে?
এগুলি নিয়ে দেখেন, আমরা এখন কোনো আলোচনা টানি না! জীবন নামক বইয়ের এই পৃষ্ঠাগুলি কেমন যেন খুব তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাই! ক্ষণেকের তরেও এখানে থামতে চাই না, মনের মধ্যে এই ধাক্কাটি লাগাতে চাই না। কারণ একটু থামলে যদি উর্ধ্বতন জগতের সেই সিগনালটি ধরে ফেলি!
এক ঐশী এসে সে সবের যেন একটা জবাব রেখে গেছে। পুলিশ অফিসার বাবা এবং তার মাকে কফির মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। তারপর নিজ হাতে ছুঁড়ি নিয়ে বাবা মায়ের কল্লা কেটেছে। প্রচণ্ড শক্তিশালী পুলিশ অফিসার বাবা এবং মা নাকি জেগেছিল নিদানকালের এই দৃশ্যটি দেখার জন্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় দেখেছে তাদের আদরের ঐশী কীভাবে তাদের গলাটি কাটছে। কিন্তু মেয়েকে বাঁধা দেওয়ার শক্তিটি তাদের গাঁয়ে ছিল না! আল্লাহ তা’আলা সম্ভবত চোখটি খুলে দিয়েছিল যাতে নিজেদের কর্মের এই ফলটি ভালোভাবে দেখে যেতে পারেন!
ঐশীর পর এবার জানা গেল এক জিতুর কথা। এই জিতুও নতুন রেকর্ড করেছে। সে ঐশীর মত নিজের বাবা মাকে নয়, নিজের শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, একই ক্ষোভে একই আক্রোশে! ইচ্ছে মত ভোগের পথে এরা বাঁধার সৃষ্টি করেছিল!
আমরা যদি সন্তান কর্তৃক বাবা মায়ের এই কল্লা কাটা কিংবা ছাত্র কর্তৃক শিক্ষককে পিটিয়ে মারাকে এক্সিডেন্ট হিসাবে ধরি তবে মোটামুটি ধরা যায় এরকম একটি মৃত্যুর পেছনে ১০টি মারাত্মক আঘাত, ৩০টি হাল্কা আঘাত, ৬০০টি ফসকে যাওয়ার ঘটনা ঘটে চলছে! শুধু মৃত্যু হলেই আমাদের গোচরে আসে। বাকিগুলো সব অগোচরে থেকে যায়!
একটি ইন্ডাস্ট্রিতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে ‘রুট-কজ এনালাইসিস' করা হয়। তেমনিভাবে সমাজ বা রাষ্ট্ররূপ এই ইন্ডাস্ট্রিতেও একই ভাবে এসব ব্যর্থতা বা দুর্ঘটনার পেছনের রুট কজ গুলি বের করা উচিত। আমরা এখানেই ধরা খেয়ে গেছি। এমন কিছু সমাজবিজ্ঞানী বা বিবেক বানিয়েছি যাদের জ্ঞানের পরিধি একটা দুধের শিশুর চেয়ে বেশি নেই! স্বাধীন ও মুক্তভাবে গবেষণা করার কোনো ক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি এদের নেই। যাদের খুদ কুড়া খেয়ে এরা বেঁচে থাকে তাদের খুশী করতেই সদা ব্যস্ত থাকে! এরাই আজ সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সেজে বসেছে। একদিন যারা বলতো There is no God তারাই এখন দেখছে There is no one to oppose them. এরাই ঠিক করে দেয়, আমার আপনার ছেলেমেয়েরা কী পড়বে, আর কী পড়বে না!
ছোটবেলায় আমরা পড়েছি যে চারটি R এর মধ্যে একটি না হলে শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ হয় না। সেই চারটি R হলো, (R)EADING, W(R)ITING, A(R)ITHMETIC এবং শেষেরটি হলো (R)ELIGION. মানুষের জীবনে নৈতিকতা ও পারিবারিক মূল্যবোধের অংশটুকু ধর্ম থেকেই এসেছে! একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বোধটিই জাতীয় শিক্ষা নীতিতে প্রতিফলিত হয়। এটাই সারা পৃথিবীতে অলিখিত নিয়ম ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান দেশে খ্রিস্টধর্ম থেকে, হিন্দুপ্রধান দেশে হিন্দুধর্ম থেকে এবং মুসলিম প্রধান দেশে ইসলাম থেকে নৈতিকতার এই শিক্ষাটি গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। সঙ্গীত, সাহিত্য বা অন্যান্য শিল্পকলাও মানুষের নৈতিক ভিত গঠনে সহায়তা করে!
একবার শফিক রেহমানকে ঘরোয়া আড্ডায় প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা শফিক ভাই আমাদের দেশে ধর্ম না থাকলে কী সমস্যা হবে? উনি জবাব দিয়েছিলেন, ধর্ম না থাকলে যত সংখ্যক পুলিশ লাগবে তা একটি রাষ্ট্র প্রোভাইড করতে পারবে না!
সমাজ ও রাষ্ট্রের সবকিছু উলট পালট হয়ে গেছে। মদিনার সনদ অনুযায়ী যে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবি করা হয় সেই দেশের পাঠ্য পুস্তক থেকে ইসলামী ইতিহাস ও নৈতিক শিক্ষার অংশগুলি বাদ দেওয়া হচ্ছে! এখন এদেশের মানুষ একদিকে দিনের বেলায় তাহাজ্জুদ পড়ার গল্প শুনেন, অন্যদিকে রাতের বেলায় ভোট করার উৎসব দেখেন। আবার এই তাহাজ্জুদি সরকার প্রধান ছাড়া দেশের তাবৎ ইসলাম বিদ্বেষী মহল দুই চোখে অন্ধকার দেখেন! সকল মারেফতি দেখেও এক শ্রেণীর আলেম সমাজ তাঁকে কওমী জননী উপাধি দেন এবং মারা যাওয়ার পরপরই নিজের বেহেশত কনফার্ম গণ্য করেন।
রাষ্ট্রের এই ফ্যানোম্যানাগুলি পারিবারিক বা সামাজিক আবহে ব্যাখ্যা করলেই আমরা ঐশীদের, জিতুদের স্পষ্ট উপস্থিতি দেখতে পাই। রাষ্ট্রীয় ফ্রেমে যেখানে বেনজির, শহীদুল, আজিজ- পারিবারিক ফ্রেমে সেখানেই ঐশী, সেখানেই জিতু! ফলে পুরো সমাজটাই আজ এরকম ঐশী বা জিতু তৈরির কারখানা হয়ে পড়েছে! সামনে আরও হবে!
ঐশীকে যে হাত খরচ দেওয়া হত সেটা তার বাবার বেতনের কয়েকগুণ ছিল। এই কথাটি বলতে আমরা ভয় পাই। কারণ তাতে সমস্যার মূল বা রুট কজটি বেরিয়ে আসবে! ছেলে-মেয়ের মাসিক হাত খরচের টাকা বাবার বেতনের কয়েকগুণ- এই ধরণের ভাগ্যবান বা হতভাগা ঐশীদের সংখ্যা সমাজে অসংখ্য।
ঐশীদের এই বাবারা আঠার কোটি মানুষের হক মেরে এরকম একেকটা ঐশী বা জিতু তৈরি করছে। যাদের ‘খাও-দাও–ফুর্তি-কর' লাইফ স্টাইল বাধাগ্রস্ত হলে নিজের বাবা মায়ের গলায় ছুরি দিতে কিংবা বাধা দানকারী শিক্ষককে পিটিয়ে মারতে একটুও পিছু পা হবে না।
কাজেই অনেক ঐশী বা অনেক জিতু তৈরি হয়ে গেছে। এখন কার নিদানের সময় কখন উপস্থিত হয়, সেটাই দেখার বিষয়!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন