মাসুম খলিলী
মিশরকে একসময় আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কায়রোই ছিল প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই অঞ্চল সফরের প্রথম বন্দর। সৌদি আরবের সাথে মার্কিন সম্পর্ক মিশরীয় জলসীমায় ১৯৪৫ সালে শুরু হয়েছিল যখন ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট সুয়েজ খালে আমেরিকান ক্রুজার, ইউএসএস কুইন্সিতে সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
নিক্সন, কার্টার এবং ওবামা সবাই কায়রোতে তাদের সফরকে আরব বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য ব্যবহার করেছিলেন।
সেই মিশর আজ এমন একটি দেশে পরিণত যার হাত স্থায়ীভাবে ভিক্ষার বাটি নিয়ে প্রসারিত। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স যখন কায়রো সফরে আসছিলেন, তখন দুই দেশের মধ্যে তিক্ত বাক্য বিনিময় হয়।
প্রশাসনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা মিশরীয় সাংবাদিক, ইমাদ আল-দিন আদিব এই বিষয়ে সতর্কঘন্টাটি বাজিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে মিশরীয় বাজেটে জ্বালানি, খাদ্যশস্য, ফসল এবং মৌলিক খাদ্য পণ্যের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্বের বৃহত্তম গম আমদানিকারক হিসাবে বছরে মিশর ১২ মিলিয়ন টন আমদানি করে। প্রতি টন গমের দাম ৮০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ইমাদ বলেন যে, মিশর যদি আগামী বছরের প্রথম দিকে এই অতিরিক্ত ২৫ বিলিয়ন ডলার না পায় তবে ২০১১ সালের আরব বসন্তের চেয়েও খারাপ নাগরিক অস্থিরতার মুখোমুখি হতে পারে দেশটি।
আর সেটি যদি হয় তাহলে, "লিবিয়া, ফিলিস্তিন এবং সুদানের সাথে সীমান্ত জুড়ে মহা শরণার্থি প্রবাহ শুরু হবে। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে এবং লোহিত সাগর পেরিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলিতে লক্ষ লক্ষ লোকের অভিবাসনের দুঃস্বপ্নের বন্যা শুরু হবে।"
আদিবের ভাই ও সুপরিচিত টিভি উপস্থাপক, একই বার্তাটি পুনরায় সম্প্রচার করেন। এতে স্পষ্ট হয় যে, লোহিত সাগর এবং ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে লক্ষ লক্ষ মিশরীয়দের প্রবাহ শুরু করার হুমকির বিষয়টি সরকারিভাবে অনুমোদন করা হয়েছে।
মিশরের অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ মায়েত আরও স্পষ্ট কথা বলেন। তিনি প্রকাশ করেন যে, ইউক্রেনীয় সংকটের প্রাদুর্ভাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কঠোর আর্থিক নীতি অনুসরণ শুরু হওয়ার পর সাম্প্রতিক মাসগুলিতে দেশীয় ঋণের উপকরণগুলিতে বিদেশী বিনিয়োগের ৯০ শতাংশেরও বেশি মিশর থেকে বেরিয়ে গেছে।
মায়েত আরো বলেন যে, সুদের হার প্রতি এক শতাংশ বৃদ্ধি মিশরের উপর ১৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ যুক্ত করে। তিনি সতর্ক করে দেন যে, যদি বর্তমান সঙ্কট চলতে থাকে তবে দেশটিতে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহে অক্ষমতার ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। তিনি সংশ্লিষ্ট দেশগুলির প্রতি খুব দেরি হওয়ার আগে বর্তমান পরিস্থিতি সমাধানে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মোহাম্মদ মুরসির সরকারের অধীনে দায়িত্ব পালনকারী মিশরের প্রাক্তন বিনিয়োগ মন্ত্রী ইয়াহিয়া হামেদ যখন তিন বছর আগে ফরেন পলিসি সাময়িকীর এক নিবন্ধে সতর্ক করেছিলেন যে মিশরের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, তখন মিশরীয় প্রশাসন ক্রোধের সাথে এর প্রতিক্রিয়া জানায়।
আর এখন প্রশাসনের সবাই সেই একই কথা বলছে।
মিশরের পরিস্থিতি সম্পর্কে এই হুমকির বিষয়ে সৌদিরা শীতল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। দেশটির সেক্যুলার লেখক, তুর্কি আল-হামাদ, টুইট করে বলেছেন: "এই লেখককে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল: কেন তার দেশ (মিশর) অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্তে তার দীর্ঘস্থায়ী সংকটগুলি নিজেই সমাধান করতে পারে না? এটি একটি সত্য বিষয় যে মিশর যখন নিজে নিজের পৃষ্ঠপোষক হওয়ার পরিবর্তে উপসাগরীয়, ইরানী বা তুর্কি "স্পন্সর" অনুসন্ধান করছে তখন তিনি মিশরকে অপমান করেছেন। কিন্তু তুরস্ক, ইরান এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে যা আছে অতীতে তার অভাব মিশরেও ছিল না।"
আরেকটি টুইটে তিনি মিশরকে "ভাঙা" দেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সিসির অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা
হামাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে। সিসির নিজের ভাষায়, মিশর উপসাগরীয় অর্থের ৫০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করেছে আর আবার তার কথায় দেশটি এখন এক"গণদুর্ভিক্ষের সম্মুখীন"। প্রশ্ন হলো সৌদিরা কেন আক্ষরিক অর্থে মিশরীয় সেনাবাহিনীর পকেটে অর্থ ঢালবে অথবা সুয়েজ খাল প্রশস্ত করা বা মিশরের জন্য একটি নতুন রাজধানী স্থাপনের মতো সিসির নিজস্ব ভ্যানিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেবে।
আর কেন সত্যি সত্যিই সৌদি আরবকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতে হবে, যখন একই ব্যক্তি যিনি ব্যাপক দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে সতর্ক করছিলেন সেই তিনিই ক্যাম্পেইন এগেইন্সট আর্মস ট্রেড (সিএএট) এর তথ্য অনুসারে ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইইউ দেশগুলি থেকে অস্ত্র কেনার জন্য ১২.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন।
মিশর এই সময়ের মধ্যে ফরাসি অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক হয়ে ওঠে, ২৪টি রাফালে জঙ্গি বিমান, একটি নৌ ফ্রিগেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। গত বছর, মিশর ফরাসি সরকার এবং ফরাসী ব্যাঙ্কগুলির ঋণ অর্থায়নে আরও ৩০টি জঙ্গি বিমানের জন্য চুক্তি করেছে৷
খাদ্যের দাম বৃদ্ধিও মিশরের সামনে অস্ত্র কিনতে বাধা হয়নি। মিশর ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ২৪টি টাইফুন জঙ্গি বিমানের জন্য ইতালিকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার অগ্রিম দিতে চলেছে।
আসলেই কেন মিশর এখন এমন একটি দেশে পরিণত হলো যে নিজের লোকদের খাওয়াতে পারছে না? অথচ খাদ্য সংকট মোকাবিলায় ইইউ মিশরকে ১০৬ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। এতে প্রতিজন মিশরীয়’র জন্য এক ইউরো করে পড়েছে।
যদি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন মিশরের অর্থায়নকে সংকটেও ফেলে থাকে তবে তার মূল কারণ হল অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এক ভয়ঙ্কর মাত্রার দুর্নীতি।
মিশরকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে সিসি।
সিসি মনে করেন যে তিনি উপসাগরীয় দেশ থেকে যে অর্থ পাচ্ছেন সেটি পাওয়া তার অধিকার। "তাদের কাছে চালের মতো টাকা আছে"। তিনি একবার তার চিফ অফ স্টাফ আব্বাস কামেলকে ফাঁস হওয়া টেপে একথা বলেছিলেন, যা পরে সত্য বলে প্রত্যায়িত হয়েছিল।
এক নির্ভরযোগ্য উপসাগরীয় সূত্র বলেছে, "এখন সিসির জন্য আগের সেই দিন নেই," । মিশরীয়দের অর্থ এবং উপসাগর থেকে সমর্থন পাওয়ার এক অবাস্তব ধারণা রয়েছে যে, এই অর্থকে তাদের অধিকার বলে মনে করে তারা।"আমিরাতীরা এখন সিসিতে খুশি নয়, সৌদিরাও আর আগ্রহী নয়। "
অর্থনৈতিক সংকট ২০১১ সালে আরব বসন্তে নামে যে আঞ্চলিক বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছিল তার দশ বছর পর, মিশরীয়দের দুর্দশা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। মিসরীয়রা এখন অনেক বেশি মুরসির কথা স্মরণ করছে।
---------------------------------------------
ডেভিড হার্স্ট এর লেখা অবলম্বনে মাসুম খলিলী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন