মিনার রশিদ
সাংবাদিক সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতরামি কিংবা তাদের নতজানু ও সুবিধাবাদী ভূমিকায় যখন সবাই হতাশ তখন হাতে গোনা দুয়েকটি নাম আমাদেরকে এখনও স্বস্তি ও পরিতৃপ্তি দেয়। এদেরই একজন স্কাইপি কেলেঙ্কারি খ্যাত অলিউল্লাহ নোমান ভাই। তাঁর গত সপ্তাহের কলাম “পদ্মা সেতুর দুর্নীতি: ঘটনা সত্য আসামী নির্দোষ" শিরোনামের লেখাটি অনেকের মনোযোগ কেড়েছে! পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে তাঁর এই লেখাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থাকবে!
এক জন লেখক বা সাংবাদিক কিছু লেখার আগে যদি ভয় পান যে যে এই লেখার পর তিনি অমুকপন্থী হিসাবে চিহ্নিত হবেন, তাহলে তার পক্ষে সত্য কথা বলা কখনোই সম্ভব হবে না! এই ভাবনা জাতি হিসাবে আমাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সম্পূর্ণ পঙ্গু বানিয়ে ফেলেছে! আজব একটা মনস্তাত্ত্বিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক ফাঁদ জাতীয় মানস বা সাইকিতে প্রবেশ করানো হয়েছে। দেখা যায়, আপনি যদি মোটামুটি সত্য বলেন এবং দেশের পক্ষে বলেন তবে সেটা বিএনপির পক্ষে চলে যায়। আবার আপনি যদি আরেকটু বেশি সত্য বলে ফেলেন তবে তা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে চলে যায়। একারণেই মাহমুদুর রহমান তো বটেই শতভাগ সেক্যুলার ভাবনার শফিক রেহমানকেও জামায়াতপন্থী ট্যাগ লাগাতে কসুর করে নাই।
অলিউল্লাহ নোমান ভাইদের লেখা ভালো লাগার কারণ হলো যে এই ভয়কে তারা জয় করতে পেরেছেন। এ কারণেই চিত্ত যেথায় ভয় শূন্য উচ্চ তথায় শির। নিজের লেখাকে চালাক-চাতুরীর মাধ্যমে পাঠকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করাতে চান না। প্রথমেই নিজের নিরপেক্ষতার পক্ষে সাফাইমূলক কিছু লেখেন না। কাজেই পাঠকগণ এই গুণীজনদের কাছ থেকে তাদের প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের আসল নির্যাসটুকু পেয়ে যান! অলিউল্লাহ নোমানদের মত বিএনপি-জামায়াত বলয়ে যে কয়জন সাংবাদিককে পেয়েছি একই ভাবে যদি আওয়ামী বলয়ে এমন কয়েকজনকে পাওয়া যেত, তবে এদেশে সাংবাদিকতা কিংবা রাজনীতির ইতিহাস অন্যরকম হয়ে পড়ত!
তাদের লেখার মধ্যেই যথেষ্ট তথ্য থাকে, সাপোর্টিং ডকুমেন্ট থাকে৷ সেখান থেকেই একজন পাঠক নিজের বিবেচনাবোধ কাজে লাগিয়ে এর সত্যাসত্য যাচাই করতে পারে! এঁরা ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ কারও মুখ থেকে কিছু তুলে ধরে নিজের বক্তব্যকে পোক্ত করতে চান না। এঁরা কোনোরূপ সাপোর্টিং ডকুমেন্ট ছাড়া মরা মানুষকে সাক্ষী মানেন না। কোনো আওয়ামী নেতা ইনাদের কাছে তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন না! রাজনৈতিক জীব হিসাবে নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকেও কখনই ঢেকে রাখেন না।
ইনারা জ্ঞানতই বিশ্বাস করেন যে নিরপেক্ষতা আজকের নৈতিক সংকটের সমাধান নয়, সমাধান হলো বস্তুনিষ্ঠতা। নিজ নিজ রাজনৈতিক বিশ্বাসের মাঝেই এই বস্তুনিষ্ঠতার চর্চা করতে হবে। মাহমুদুর রহমান এবং অলিউল্লাহ নোমানদের এই বস্তুনিষ্ঠতাকে উচ্চ আদালতও হজম করতে পারে নাই। তাদের কারণেই আদালতকে বলতে হয়েছিল, ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স!
কিন্তু অলিউল্লাহ নোমানদের জন্যে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো তাদেরকে সাংবাদিকতা করতে হয়েছে একধরণের ধূর্ত ও সুবিধাবাদী প্রতিপক্ষকে পাশে রেখে! মুশকিলটি দেখেন, একদিকে রয়েছে প্রকৃত দলকানা, দলান্ধ যারা কোনো যুক্তি বা বাস্তবতা মানে না, নিজেদের দাবির পক্ষে কোনো সাপোর্টিং ডকুমেন্টসের ধার ধারে না। সেই দলকানাদের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে এঁরাও চিহ্নিত হয়েছেন বিপরীত ঘরানার একই বিশেষণে। বুদ্ধি বৃত্তিক চতুরতার এই কাজটি (একদিকের দলান্ধতার সাথে অন্য দিকের বস্তুনিষ্ঠতার কাটাকাটি) যারা করে তারাও একই গোয়ালের গরু তবে নিজেদেরকে একটু নিরপেক্ষ অবস্থানে বসিয়ে নেয়।
কথিত নিরপেক্ষতা থেকে যদি বস্তুনিষ্ঠতা দূরে সরে যায় তবে তা মতলববাজি ছাড়া কিছু নয়। একটি নলেজ বেইজড সোসাইটি বা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ কখনোই একটি ডিপলিটিসাইজড সোসাইটি হবে না। সমাজটিকে কারা এই ডিপলিটিসাইজেশনের দিকে নিয়ে গেছে এবং কেন, তা আজ স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। এই নিরপেক্ষতার মূলা ঝুলিয়ে জাতিকে বিরাজনীতিকরণের সর্বনাশা পথে ঠেলে দিয়েছে! ডিপলিটিসাইজড একটা জাতি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ধারণা বা মূল চেতনাটি হারিয়ে ফেলে।
তখন ধাপ্পাবাজ বা বাজিকররা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বসে! এমন একটা ধাপ্পাবাজি হলো পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে কানাডার আদালতের রায়। কানাডার আদালত কি আসলেই পদ্মা সেতুর দুর্নীতির মামলায় আওয়ামী সরকারকে নিষ্পাপ ঘোষণা করেছিল? সেই মামলা নিয়ে আসলেই কী ঘটনাটি ঘটেছিল?
এ যেন হুবহু সেই গ্রামবাংলার গল্প! এক গ্রামে একজন প্রকৃত শিক্ষিত ও ভদ্রলোক ছিলেন। তার বিপরীতে ছিল অর্ধশিক্ষিত ও চতুর প্রকৃতির এক লোক! চতুর লোকটি তার চামচা চামুণ্ডাদের মাধ্যমে ছড়ায় সেই বেশি জানলেওয়ালা লোক। সেটি প্রমাণের জন্যে একদিন বাহাসের আয়োজন করে। চতুর লোকটি প্রস্তাব করে, প্রথমে আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করব, আপনি জবাব দিবেন। এর পরে আপনি প্রশ্ন করবেন, আমি তার জবাব দেব। যে জবাব দিতে পারবে না, সেই পরাজিত বলে গণ্য হবে।
শিক্ষিত ভদ্রলোকটি প্রতিপক্ষের প্রস্তাবটি মেনে নেয়। চতুর লোকটি প্রশ্ন করে, বলুন তো দেখি, আই ডোন্ট নো- এই কথাটির মানে কি? শিক্ষিত লোকটি যথার্থই বলেন, আমি জানি না।
এটুকু বলতেই চতুর লোকটি গগনবিদারী চিৎকার দেয়, দেখলেন তো ভাই সকল, আমি যে প্রশ্ন করেছি তার জবাব সে জানে না! সাথে সাথেই চতুর লোকটির সঙ্গী সাথীরা শ্লোগান দিয়ে মঞ্চ ফাটিয়ে ফেলে। সাথে যোগ দেয় অশিক্ষিত গ্রামবাসী! শিক্ষিত ভদ্রলোকটি আসল কথাটি আর গ্রামবাসীকে বোঝাতে পারলেন না!
একটি গল্প এবং অন্যটি বাস্তব হলেও এদের মধ্যকার মিলটি অদ্ভুত! চতুর লোকটির সহযোগী যারা ভদ্রলোকের কথাটি জনগণকে শুনতে বা বুঝতে দেয় নাই তারা হলো এদেশের মিডিয়া! এরাও পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে আসল ঘটনাটি জনগণকে জানতে দেয় নাই!
বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতে একটি মামলা করে কানাডার একটি কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পদ্মাসেতুর পরামর্শক হিসাবে কাজ পাইয়ে দেবার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার চুক্তি করে। প্রমাণ হিসাবে ডায়েরির পাতা এবং একটি কথোপকথন উপস্থাপন করে! কিন্তু পরে ব্যাংক জানতে পারে যে কানাডায় এই ধরনের গোপনে কারও কথোপকথন রেকর্ড করতে পারে শুধুমাত্র পুলিশ। এর বাইরে অন্য কারও রেকর্ডকৃত কথোপকথন আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে না! একারণেই বিশ্বব্যাংক সেই মামলা চালিয়ে নেওয়া অপ্রয়োজনীয় মনে করে। ফলে আদালত এভেইলেবল ইনফরমেশনের উপর ভিত্তি করে রায় দেয়! এটাকে ধূর্ত আওয়ামী লীগ তাদের নিষ্কলুষ চরিত্রের সনদ হিসাবে তুলে ধরে! অথচ ঘটনা ঘটেছে ভিন্ন রকম। আসল ঘটনাটি দেশবাসীকে জানানোর দরকার ছিল এদেশের মিডিয়ার। সেটি না করে এরাও উপরের 'আই-ডোন্ট-নো' গল্পের মতই আসল ঘটনাটি জনগণের অগোচরে রেখে দিয়েছে।
এখন দেখুন, এর ফলাফল কী হয়েছে? এতে সরকার আরও বেপরোয়া হয়ে পড়ে। নাহিদের পরামর্শ মত একটু রয়ে সয়ে নয়- দয়ামায়াহীন ভাবে লুটপাট শুরু করে! তখন গণমাধ্যম যদি তাদের কর্তব্যটি ঠিকভাবে পালন করত এবং আসল ঘটনাটি জনগণের কাছে তুলে ধরত, তবে আর যাই হোক- দশ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু ত্রিশহাজার কোটি টাকা (এখনও রেলের কাজ কমপ্লিট হয় নাই) হয়ে পড়ত না।
কাজেই আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই এই অলিউল্লাহ নোমানদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন