মিনার রশিদ
এরকম একটি বাক্য ২০০৬ বা ২০০৭ সালে শফিক রেহমানের যায় যায় দিনে লিখেছিলাম। লগি-বৈঠা দিয়ে রাস্তায় সাপের মত পিটিয়ে শিবিরের জনৈক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। তারপর বাপ্পা বসু নামক এক ছাত্র নেতা সেই লাশের উপর উঠে নৃত্য করেছিল। হত্যার পর সেই লাশের উপর নৃত্য করা দেখে এই কলামটি লিখেছিলাম! ছাত্রলীগ নেত্রী তিলোত্তমা শিকদারের মাথায় হেলমেট এবং হাতে লাঠি সহ ভাইরাল হওয়া ছবিটি দেখে সেই কথাটি আবারও মনে পড়ল। হাইকোর্টের আইনজীবীদের উদ্দেশে স্বহস্তে অপু ওকিলের ইট নিক্ষেপ দেখেও একই ভাব মনের মধ্যে উদয় হয়েছিল।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও কারও এই অতিরিক্ত আগ্রহ, উদ্দীপনা বা হিংস্রতা মনে ও মগজে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে! এগুলি যেন কইতেও পারি না, আবার সইতেও পারি না। বিএনপি-জামায়াত বিশেষ করে শিবিরকে পেটানোর যে গ্রুপগুলো এগিয়ে আসে সেখানে সংখ্যালঘুদের অনুপাত কেন যেন মারাত্মকভাবে বেশি থাকে ! সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে একটি একাডেমিক গবেষণা পরিচালনা করতে পারেন !
এই ‘মাইর দেনেওয়ালাদের’ মধ্যে যতজন সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের মানব অথবা মানবী দেখতে পাবেন তারা যদি সামনের পালাবদলে ‘মাইর খানেওলাদের’ মধ্যে পড়ে যান তবে তখন তারা আর ছাত্রলীগ থাকবেন না। তারা তখন হয়ে পড়বেন সংখ্যা লঘু। রাজনৈতিক এই বেকায়দায় শুধু বিএনপি নহে, বলতে গেলে পুরো দেশটিই পড়ে গেছে।
এখানে মুশকিলের বিষয়টি হলে নিজেকে কথিত সাম্প্রদায়িকতার অপবাদ থেকে বাঁচিয়ে এই ফ্যানোমেনার যথাযথ বিশ্লেষণ সম্ভব না। এখানে ট্র্যাপটি এমনভাবে পাতা হয়েছে যাতে ( ট্রাবল এড়িয়ে চলা ) সহজ সরল নিরীহ মানুষ এখানে কোনোরূপ নাক গলাতে না আসেন। মনের কষ্টে কখনও বার্ষ্ট করলে আপনাকে এই সাম্প্রদায়িকতার খেতাবটি যারা পড়াবেন তারা নিজেরাই চরম সাম্প্রদায়িক!
আমার কথা হলো, আমি আপনাকে পাল্টা চিমটি দেবো না। কিন্তু আপনি যে চিমটি কেটেছেন তা টের পেয়ে গেছি। এটুকুই জানাতে চাচ্ছি। নিজের সম্প্রদায়কে এই চিমটির হাত থেকে বাঁচানো সাম্প্রদায়িকতা নয়। প্লিজ, বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করুন। আমরাও আপনাদের মত একই মগজ ও মন নিয়ে হিউম্যান-সাব হিউম্যান নই !
আমার এই শতভাগ নির্দোষ পর্যবেক্ষণটিকে কেউ কেউ তখন তখন সাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনা বলে চিহ্নিত করে। আমার এই সমালোচকগণ ছিলেন মূলত: নিরপেক্ষ লীগের সদস্য। মৌলানা-মৌলবী গোছের মানুষ নই। শফিক রেহমানের যায় যায় দিনও ইসলামী ঘরানার পত্রিকা ছিল না। ফলে প্রতি শুক্রবারে আমার উপ-সম্পাদকীয় এই নিরপেক্ষ লীগের গাত্রদাহের কারণ হয়ে পড়ে। সমালোচকদের সবার নাম মনে নেই। তবে তখনকার বিশিষ্ট টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আব্দুন নুর তুষার পুরো একটি উপসম্পাদকীয় আমার বিরুদ্ধে লিখেন। এই বিশিষ্টজনের তখন মনে হয়েছিল যে আমার লেখাগুলি আধুনিক গেটাপ ও মননের যায় যায় দিনের জন্যে উপযুক্ত নহে। বরং দৈনিক সংগ্রামে ছাপালেই ভালো হয়! প্রতিপক্ষের কথাকে দুর্বল বা গুরুত্বহীন করার নিমিত্তে এটা এদেশের কথিত সুশীলদের একটা ট্রিক্স বা অপকৌশল!
শফিক রেহমান তাদের মতলব অনেক আগেই ধরে ধরতে পেরেছিলেন। কাজেই আমার কলাম বন্ধ করতে তাদের সেই মনস্কামনা পূর্ণ করেন নাই। আমার লেখা যথারীতি ছাপা হতে থাকে! সত্য যার পক্ষেই যাক, আমি লিখে ফেলি এবং আমাকে অবাক করে যায় যায় দিন বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করেই তা ছাপিয়ে দেয়! আবার যায় যায় দিনের পাঠকের প্রয়োজন ও প্রত্যাশার সাথে সংহতি রেখে একটু নোনতা স্বাদও যোগ করে দেই। কলামটির নাম ছিল নোনা জলের কালি! কলামিষ্ট হিসাবে নতুন হলেও প্রতি শুক্রবারে যায় যায় দিনের বিক্রি বেড়ে যেত যেটা এই নিরপেক্ষ লীগদের জন্যে আরো মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল।
নিরপেক্ষতার বাজার দর তখন তুঙ্গে! যায় যায় দিনের সীমিত প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আসল লীগের সাথে এই নিরপেক্ষ লীগের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। এই নিরপেক্ষতার ভেল্কি দেখিয়ে আলো-স্টার-চ্যানেল আই তখন এদেশের পুরো বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। মাওলানা মান্নান মারা যাওয়ার পর দৈনিক ইনকিলাবও তখন পল্টি মেরেছে! মূলত: এগুলোই ছিল দা ইকোনোমিস্ট বর্ণিত ইন্ডিয়ান ব্যাগস অব এডভাইস এন্ড ক্যাশের খেলা। সেই খেলায় হেরে গিয়ে আমরা দৈনিক যায় যায় দিন খুওয়ালাম!
এর কিছুদিন পর অনেকটা উল্কার বেগে আবির্ভূত হলেন জনাব মাহমুদুর রহমান! জাতির জন্যে দুর্ভাগ্য যে শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমান পাশাপাশি থেকে তখন এই দুটি পত্রিকা প্রকাশ করতে পারলে আমাদের আজকের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো!
মিডিয়া জগতকে এই মতলববাজরা ব্রাহ্মণ ও নমশুদ্র-এই দুই গ্রুপ হিসাবে ভাগ করে ফেলে। এদের এই প্রচারণা এতই শক্তিসালী হয়ে পড়ে যে অনেক জামাতপন্থী দৈনিক সংগ্রাম কিংবা অনেক বিএনপি মনা লোক দৈনিক দিনকাল হাতে নিতে ইতস্ততঃ করে। কিন্তু শফিক রেহমানের যায় যায় দিন কিংবা মাহমুদুর রহমানের দৈনিক আমার দেশকে একই নমশুদ্রের দলে ঠেলে দেওয়া এদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়ে!
কাজেই নানা কারসাজি করে শফিক রেহমানের হাত থেকে তার ব্রেইন চাইল্ড দৈনিক যায় যায় দিনকে কেড়ে নেওয়া হয়। এগুলি করা হয়েছে একে একে মিডিয়া জগত থেকে শক্তিসালী প্রতিপক্ষগুলি সরিয়ে দিতে। দৈনিক আমার দেশের দায়িত্ব যখন জনাব মাহমুদুর রহমান গ্রহন করেন তখন তাকে বিচ্ছিন্ন নেকড়ের মত একা একা সংগ্রাম করতে হয়েছে।
আসলে নিরপেক্ষ লীগের সদস্যরা বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আউটলেট থেকে এই ধরণের কিছু সুবিধা আওয়ামীলীগের জন্যে তৈরি করে দিয়েছে। এগুলিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার জন্যে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বা সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন ।
বর্তমান সোশাল মিডিয়া এই দানবকে যেভাবে মোকাবিলা করছে সেটাও স্থায়ী কোনো সমাধান নহে। অফ লাইনে হোক কিংবা অনলাইনে হোক-একটা প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব না থাকলে সেই প্রচেষ্টা সফল হবে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এরকম বেশ কিছু উদ্যোগ ইতোমধ্যে হোঁচট খেয়েছে, অনেক ভুল মানুষ সামনে এগিয়ে এসেছে। যদিও কোনো কোনো ব্যক্তিও প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়তে পারেন। সে রকম ব্যক্তির সংখ্যাও খুব একটা বেশি নেই। ব্যক্তির বেলায় অনেক রসায়ন কাজ করে !
আজকে দেখুন, একই বাক্য যখন আমি দৈনিক যায় যায় দিন থেকে বলেছিলাম তখন সেটি যতটুকু ভরবেগ নিয়ে সেই ভন্ডামিকে আঘাত করেছিল, আজ সোশাল মাধ্যমে হয়তোবা সেই ভরবেগ পাচ্ছে না ।
এটাও সত্য যে, আমার দেশ অনলাইন সেই অরিজিনাল ‘ আমার দেশ’ এর বিকল্প হতে পারবে না। তারপরেও সবার প্রতি অনুরোধ, যে অবয়বেই নতুন ভাবে শুরু করেছে সেই উদ্যোগটিকে নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখুন!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিিনয়ার, কলামিষ্ট-বুদ্ধিজীবী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন