আমিনুল ইসলাম
আমার ঠিক জানা নেই বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আসলে কতো। তবে আমি নিশ্চিত- সংখ্যাটা অনেক বিশাল হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনার্স-মাস্টার্স পাস করে চাকরি পাচ্ছে না এমন ছেলে-মেয়ের সংখ্যাও কম নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কেন এরা বেকার? বেশির ভাগ বেকার ছেলে-মেয়ে বলবে, দেশের চাকরির বাজার কম। যাও আছে, সেখানে স্বজনপ্রীতি, মামা-চাচার দৌড়, রাজনীতি কিংবা ঘুষের রাজত্ব। আমি এই পুরো বিষয়টা মেনে নিয়েছি। এর সবগুলোই বাংলাদেশের মতো সমাজে প্রযোজ্য। আবার আপনি যদি যারা চাকরি দেয়, তাদের গিয়ে প্রশ্ন করেন, তারা বলবেÑ আমরা তো চাকরি দেওয়ার জন্য বসে আছি। কিন্তু যোগ্য মানুষ খুঁজেই পাই না। আমরাও মাঝে মাঝে মনে হয়- আমরা কি আসলেই যোগ্য? বিশেষ করে ১৮ বছর আগে যখন সুইডেনে পড়তে এসছিলাম। তখন রাস্তায় ভায়োলিন বাজিয়ে ভিক্ষা করা মানুষটাকে দেখে নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি- ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে পড়াশোনা শেখা ছাড়া আমি কি আর কিছু জানি? আমার তো এই দেশে ভিক্ষা করারও যোগ্যতা নেই। কারণ এরা ভিক্ষা করতে গেলেও ভায়োলিন কিংবা বাঁশি বাজিয়ে ভিক্ষা করে।
আরও পরে আবিষ্কার করেছি- এখানকার ছেলে-মেয়েরা যখনই একটু ছুটি পায়, চেষ্টা করে লেখাপড়ার বাইরে কিছু না কিছু শিখতে। আমাদের এখানে সামারে প্রায় দুই-আড়াই মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সেবার এক সামারে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, দেখি কম বয়সী দুই ছেলে-মেয়ে একসাথে গীটার বাজিয়ে ভিক্ষা করছে। সামনে গিয়ে ওদের গীটার বাজানো শুনছিলাম। ইচ্ছা হলো একটুু কথা বলি। বাহ! তোমরা তো চমৎকার গীটার বাজাও। আমিও বাজাতে পারি। দেবে আমাকে বাজাতে? এরপর আমিও ওদের সাথে মিনিট ১৫ ভিক্ষা করেছি। তখনই জানতে পেরেছি, ওরা ক্লাস টেনে পড়াশোনা করছে। এর আগের সামারে ওরা গীটার বাজানো শিখেছে। এই সামারে ভিক্ষা করছে, কারণ উইন্টারে একটা বিজ্ঞান বিষয়ক অলিম্পিয়াডে ওরা আমেরিকা যেতে চায়। তাই ভিক্ষা করে নিজেদের টাকা নিজেরাই যোগাড় করছে। আমি নিজেও গত ১০ বছরে প্রতি সামার কিংবা উইন্টার ব্রেকে কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করেছি। কখনো গীটার বাজানো, কখনো নতুন একটা ভাষা, কখনো প্রোগ্রামিং কিংবা সালসা ড্যান্স।
অর্থাৎ চেষ্টা করেছি নতুন কিছু না কিছু শিখতে। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি এইসব দেশে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি আপনি যদি কোনো কিছুর বাস্তব জ্ঞান না রাখেন, তাহলে কেউ আপনাকে দুই পয়সারও মূল্য দেবে না। আপনি যদি গিয়ে বলেন, আমি অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি করে এসছি। কিংবা আমার বিশাল বড় একটা ডিগ্রি আছে। কেউ বাংলাদেশের মতো বলবে না- ওরে বাবা, বিশাল কিছু। তারা বরং আপনাকে যাচাই করবে- আপনি কি পারেন। আপনি যদি ইন্টারমিডিয়েট পাস হন, আর আপনার যদি কাজ করার সক্ষমতা থাকে, বিশ্বাস করেন, ওরা আপনাকেই নেবে। অক্সফোর্ড থেকে পাস করাকে নেবে না। যেমন ধরুন আপনি আপনার বাসায় একজন কাজের মানুষ রাখতে চাইছেন। এখন সেই কাজের মানুষ এসে যদি বলে- আমি সব পারি, কিন্তু ঘর ঝাড়ু দিতে জানি না। কিংবা হাড়ি-পাতিল ধুতে জানি না। আপনি কি তাকে কাজে নেবেন? এখন প্রশ্ন হচ্ছে- অনার্স-মাস্টার্স পাসের বাইরে আপনি আসলে আর কী কী পারেন? জীবনের এই ২৫ টা বছর আপনি কী কী শিখেছেন?
ভালো করে নিজের ভাষাটা কি শিখেছেন? শুদ্ধ ভাষায় বাংলাটা কি বলতে পারেন? ইংরেজি ভাষাটা কি জানেন ঠিকমতো? দুটো প্রোগ্রামিং কিংবা অন্য আর কিছু? নাকি পুরো সময়টা আড্ডা দিয়ে আর কোনোভাবে বন্ধুর নোট পড়ে পাস করে গিয়েছেন? তাহলে কেন মানুষজন আপনাকে চাকরি দেবে?
সরকারের একজন উপদেষ্টা আজ বলেছেনে, ‘ছেলেমেয়েরা অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে পড়াশোনা করে বলেই চাকরি পায় না।’ এখন আমরা প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে আপনারা প্রতি বছর এতো এতো ইউনিভার্সিটি কেন চালু করছেন? কেন এতো এতো বেকার হতাশাগ্রস্ত যুবক তৈরি করছেন? কেন আপনার কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দিচ্ছেন না? আমার অবশ্য একটা নিজস্ব মতামত আছে। আমার ধারণা বেকারত্ব বিষয়টা আপেক্ষিক। অনেকেই আছে চাকরি পায় কিংবা পাচ্ছে, কিন্তু মনের মতো হচ্ছে না কিংবা নিজের স্ট্যাটাসের সাথে যাচ্ছে না, এজন্য ওই চাকরি করে না। বিষয়টা বুঝিয়ে বলার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমি এবং আমার ইমিডিয়েট বড় বোন একই সাথে এসএসি পাস করেছি। তো, পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে।
আমি বেশ ভালো রেজাল্ট করেই পাস করেছি। এরপরও মনের দুঃখে বাসায় ফিরে আমি কাঁদছিলাম এই ভেবে- আরেকটু যদি ভালো করতে পারতাম। আমার মামাত ভাই আমাদের বাসায় এসে এই দৃশ্য দেখে আমার মাকে প্রশ্ন করেছে, টুটুল (আমার ডাক নাম) ভাই কি ফেইল করেছে? অথচ ভীষণ ভালো রেজাল্টই করেছিলাম। তো এই অবস্থায় দেখি আমার বড় বোন স্কুল থেকে রীতিমতো হাসতে হাসতে দাঁত বের করে ফিরেছে। আমি ওই অবস্থায় ভাবছি, ও কী তাহলে বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছে? অথচ ও সাধারণ ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে পাস করেই মহা আনন্দে দাঁত বের করে হাসছিলো। কারণ ওর কাছে ওটাই ছিল ভালো রেজাল্ট। আর আমি ওর চাইতে অনেক ভালো রেজল্ট করেও কান্নাকাটি করছিলাম। কারণ আমার মনে হচ্ছিলো, আরেকটু ভালো করলেই পারতাম। এই উদাহরণটা এই জন্য দিলাম- আপনি কীসে সন্তুষ্ট হবেন, সেটা যেমন আপনার ব্যাপার। ঠিক তেমনি আপনার চাকরি পাওয়া-না পাওয়াও আসলে নির্ভর করছে আপনার উপরই। হ্যাঁ, বাংলাদেশে অনেক সমস্যা আছে। দুর্নীতি আছে।
এইসব মেনেই এই কথা বলছি। কারণ আমি-আপনি চাইলেও দুর্নীতি দূর করতে পারবো না। স্বজনপ্রীতি দূর করতে পারব না। তাহলে আমরা কোনটা পারব? নিজেদের উন্নত করতে। যেটা সম্পূর্ণ আমাদের নিজেদের উপর নির্ভর করছে। আজকাল কিছু শিখতে এমনকি কোথাও যেতেও হয় না। ঘরে বসে ইউটিউবেই শিখে ফেলা যায়। অন্তত আমি তো অনেক কিছু এভাবে শিখেছি। নিজেকে উন্নত করুন। ডিগ্রি নিয়েই শুধু নিজেকে উন্নত করা যায় না। সাথে আরও অনেক কিছু অর্জন করতে হয়। মনে রাখেবেন- উন্নত মানুষ বসে থাকে না। সে তার নিজের রাস্তা নিজেই তৈরি করে। আমাদের এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের খুব সাদামাটা কিন্তু ভয়ানক বাস্তব একটা শিক্ষা একদম শুরু থেকে দেওয়া হয়। সেটা হচ্ছে- তোমার ভবিষ্যৎ অবস্থানের জন্য অন্য কেউ নয়,তুমি নিজেই দায়ী। তাই অন্য কাউকে দোষ দেওয়ার আগে সবার প্রথম আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখবে। ফেসবুক থেকে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন