মিনার রশিদ
আপনাদের হয়তোবা স্মরণ আছে যে ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় এক ফেরি ডুবিতে কয়েক শ মানুষ প্রাণ হারায়। এই দুর্ঘটনার পেছনে অবহেলা জনিত কারণে সেখানকার আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহনের ডিজি লেবেলের কোনো কর্মকর্তাকে চাকরীচ্যুত করলেই যথেষ্ট হতো! আরেকটু বেশি করতে চাইলে দেশের শিপিং বা পরিবহন মন্ত্রীকে দায়ি করলেও করা যেতো। কিন্তু দেখা গেলো, সেই দুর্ঘটনার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে পদত্যাগ করলেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী!
আইনের শাসন ও বিবেকের কষাঘাত এদের জবাবদিহিতার রজ্জুটিকে ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে তুলেছে। বিপরীতদিকে জবাবদিহিতার সেই রজ্জুটি ক্রমান্বয়ে আমরা নিচের দিকে সরিয়ে দিচ্ছি! সমস্যার মূল জায়গায় হাতটি না দিয়ে আশে পাশে ঘুরে বেড়াই। কান ধরে জোরে না , আলগোছে টান দেই যাতে মাথাটি আবার প্রকাশ্যে এসে না পড়ে। এরকম আত্মপ্রবঞ্চনা বা বিভ্রান্তিতে ঘুরপাক খাচ্ছে সারা জাতি!
মূলত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করে আমরা এটিকে দস্যুরাণীর ঢেড়াতে রূপান্তর করে ফেলেছি। রাণীমাতার মনের খায়েশ মিটাতে এখন সারা বিশ্বে সবচেয়ে সম্মানিত মানুষটিকেও পদ্মা নদীতে চুবাতে পারবেন! আর আমরা এখন নয়নাভিরাম এই দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখব।
ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রথমেই দরকার একটি অন্ধ চেতনা! আর সেই চেতনার জন্যে দরকার আকাশে একজন দেবতা এবং মর্ত্যে তাঁর একজন প্রতিনিধি! আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে এবং চেতনার নামে জাতির মগজটাতে বিষাক্ত ভাইরাস ঢুকিয়ে সেই কাজটি করা হয়েছে।
চেতনা নামক ভাইরাসটি দিয়ে প্রথমেই আমাদের চিন্তার জগতটিকে আক্রমণ করা হয়! কোভিড -১৯ এর অনুকরণে এই ভাইরাসটির নাম রাখা যেতে পারে আম্লীগ-১৯! কোভিডের যেমন ভ্যারিয়েন্ট আছে-ডেল্টা, অমিক্রন। এই আম্লীগ-১৯ ও তাই!
মানুষের চিন্তার জগতকে কাবু করতে প্রথমে নেমেছে দুই কান কাটা ভাইরাসের সম্মুখ সারির দলটি। কোনো মানবিক যুক্তি বা সমালোচনা এদের বিদ্ধ করে না। মানবিক লাজ লজ্জার কোনো টিকাই এদের উপর কাজ করে না। গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে এই ভাইরাসদের এক সঙ্গে দেখা যায়। এদের দিয়ে বলানো হয়, বিশ্বের তিন নম্বর সৎ প্রধানমন্ত্রী! ম্যাজিক লেডি, আপনার হাতে কি ম্যাজিক আছে? এছাড়া রয়েছে কওমি জননী, মাদার অব হিউম্যানিটি! মাকাল ফল তুল্য সাংস্কৃতিক ও বিনোদন জগতের নায়ক- নায়িকা, গায়ক-গায়িকা এবং হালের ক্রেজ কিছু ক্রিকেটার এই ভাইরাস গ্রুপে যুক্ত হয়েছে। উন্নয়ন, উন্নয়ন রব তুলে এরা সারা দেশ উতাল পাতাল করে ফেলেছে। রাস্তায় চললে জনগণের পেটের ভাত মুহূর্তে হজম হয়ে যায়। কিন্তু এই ভাইরাসেরা দেখে ইউরোপের রাস্তা!
এর পরের স্তরে বিন্যস্ত চেতনার সেকেন্ড ভাইরাস সমূহ। বোঝানোর সুবিধার্থে এদেরকে আম্লীগ-১৯ এর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বলে ডাকা যেতে পারে। প্রথম ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিরোধক হয়ে পড়লে পরবর্তী এই ভ্যারিয়েন্ট নামানো হয়। প্রথম ভ্যারিয়েন্টের মত এরা ঘিলুবিহীন মাকালফল নহে। এদের মাথায় একটু নয়, খানেকটা বেশি ঘিলু রয়েছে!
ইনারা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অধ:পতনে ব্যথিত হন, কষ্ট পান। সেই কষ্টের কথা সাহস করে প্রকাশও করেন। এগুলি নিয়ে নানা ফোরামে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন, উত্তরণের উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনাও করেন!
এরা সমাজের সকল শয়তানদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করেন কিন্তু এসব দায় থেকে অদ্ভুত কায়দায় ‘শয়তানে-বুজুর্গ’ কে আলগোছে আগলে রাখেন। সকল ডাকাতদের গালি গালাজ করেন কিন্তু ডাকাতদের সর্দারনীকে পুত:পবিত্র জ্ঞান করেন! শত শত পিকে হালদারদের কে সৃষ্টি করলেন সেই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু হঠাৎ এক পি কে হালদার ধরা পড়লে এটা আবার সেই বুজুর্গের মহানুভবতা ও সততার নমুনা হিসাবে তুলে ধরেন। এই পিকে হালদারের কয়েকটি লোম ছেড়ার আগেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টদের চিৎকারে কিংবা মিডিয়ার কমলা সুন্দরীদের কল কাকলিতে দেশবাসীর ঘুম হারাম হয়ে যায়।
এটা সত্য যে এদেশে দুর্নীতি ও অনিয়ম হঠাৎ করে উদয় হয় নাই। দুর্নীতি ও অপশাসন অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু আগে দেশ ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে এটা বলা হয় নাই যে, তোমরা যা ইচ্ছা করতে পারো শুধুমাত্র সরকারের বিরোধিতা করিও না। আপনারা ঘুষ খান, তবে একটু রয়ে সয়ে। ঘুষ হলো স্পিড মানি। সরকারে থাকলে নেতা কর্মীদের আয় রোজগার একটু বাড়বেই। আপনারা যে টাকা কামিয়েছেন সামনে সরকারে আসতে না পারলে সেগুলি নিয়ে পালাতে হবে।
সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির এই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশ্রয়ের জন্যেই অতিরিক্ত এই দুর্নীতি এবং অপশাসন জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে। আগের পুকুর চুরি এখন সাগর লুটে পরিবর্তিত হয়েছে। এগুলির সব কৃতিত্ব এককভাবে একজনের। ফলে এর দায়টুকু সরাসরি সর্দারনীর উপর বর্তায়।
প্রথম ও দ্বিতীয় স্তর বা সারির ভাইরাস দিয়ে উপরের এই বাস্তবতা থেকে যখন জনগণের চোখ বন্ধ করতে পারে না তখন আবির্ভাব হয় চেতনার ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট! এর কোড নাম হতে পারে আম্লীগ-১৯, অমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। চারিত্রিকভাবে এরা বাম ঘরানার, কেউ কেউ প্রাক্তন আওয়ামীলীগার! সরকার বিরোধী সেন্টিমেন্টটি কীভাবে সরকারের পক্ষে নেয়া যায় এই কাজটিই এরা নীরবে করে যায়।
কৌশলের অংশ হিসাবেই এরা সরকারের কঠোর সমালোচক। ক্ষোভের মাত্রা বোঝাতে ভয়ংকর গালাগালিও করেন। সব শেষে নিজেরাই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে, যেহেতু আমাদের সম্মুখে আর কোনো বিকল্প নেই কাজেই যে আছে সেই (ভয়ংকর একটা গালি দিয়ে) থাকুক! জনগণের ক্ষমতা এরা জনগণের হাতে দিতে চায় না। এরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে কিন্তু জনগণকে তাদের নিজেদের শাসক চুজ করার ক্ষমতাটি দিতে চায় না!
অর্থাৎ ইনারা এই ফ্যাসিবাদকে এক ধরণের Status Quo এর ব্যবস্থা করে দেন! এরা আসলে মিথ্যা সমানকরন (False equalizer) বা নিরপেক্ষ লীগের সদস্য। যখন আওয়ামী লীগের বদনাম না বলে আর উপায় থাকে না তখন এরা আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপিকে একই রশিতে বেঁধে ফেলে। এই তৃতীয় স্তরের ভাইরাসদের অনেকেই নিজেও জানেন না যে তিনি চেতনার ভাইরাসের থার্ড ভ্যারিয়েন্ট।
ফ্যাসিবাদের কবল থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হলে আম্লীগ-১৯ ভাইরাসের এই তিনটি ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে। এর অন্য কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: বিশিষ্ট কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন