মাহমুদুর রহমান
ভারতে শেখ হাসিনার অসংখ্য প্রভু। এখানে আমি তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর কথা বলছি না। মানুষরূপী দেবতাদের উদ্দেশ্যে করেই আমার এই মন্তব্য। এমনই এক দেবতা, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জয়শংকর রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় পদধূলি দিয়েছেন। প্রভুর আগমনের জন্য হাসিনা এবং তার দাসানুদাস মন্ত্রী আবদুল মোমেন কদিন ধরে খুবই উতলা হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। আবদুল মোমেনের যে লাজলজ্জা বলতে কিছু নেই সেটা আমরা এই মাসেই তার ওয়াশিংটন সফরের সময়েই দেখেছি। তিনি মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট ব্লিংকেনের কাছে ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে যেভাবে প্রায় তার পদযুগল ধরে ফেলেছিলেন সেটা নিশ্চয়ই ব্লিংকেন দীর্ঘদিন স্মরণে রাখবেন। র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া এবং বিএনপিকে আগামী পাতানো নির্বাচনে এনে দেওয়ার জন্য অনেক কাকুতি মিনতি করেও মোমেনকে অনেকটা নিরাশ হয়েই মার্কিন রাজধানী থেকে ফিরতে হয়েছিল। সেই শোক কাটিয়ে না উঠতেই বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক বক্তব্য হাসিনাকে বেশ বিচলিত করেছে বলেই মনে হচ্ছে। ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে রাষ্ট্রদূত হাস পরিষ্কার করে দুটো জিনিস বলেছেন। এক, গুমখুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত র্যাবের স্যাংকশন উঠবে না। আর দুই, ২০২৩ সালে কোন একতরফা পাতানো নির্বাচন ওয়াশিংটন মানবে না। এই মার্কিন অবস্থান অপরিবর্তীত থাকলে হাসিনার সমূহ বিপদ।
উপায়ন্তর না দেখে হাসিনা প্রশাসন শেষ ভরসা হিসেবে দিল্লির প্রভুদের শরণাপন্ন হয়েছে। জয়শংকর আসার দুই দিন আগে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন যে, র্যাবের নিষেধাজ্ঞা তোলার জন্য ভারতই প্রধান ভরসা। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, মার্কিন মুলুকে যে শক্তিশালী ভারতীয় লবি রয়েছে তারা নিশ্চয়ই বাইডেন প্রশাসনকে র্যাবের খুনখারাবির প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হবেন। নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে ইসলামপন্থীদের নির্মূল করতে গেলে গুমখুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং শাপলা চত্ত্বরের মত গণহত্যা যে অত্যাবশ্যকীয় সেটা প্রবল প্রভাবশালী হিন্দুত্ববাদি লবি ছাড়া পশ্চিমাদের আর কে বোঝাবে? তেরো বছর ধরে সকল প্রকার জুলুমে উৎসাহ জোগানোর পর এখন ওয়াশিংটনের উল্টো গীত গাওয়া কী উচিৎ কাজ হচ্ছে? জয়শংকর সব সময় বলে এসেছেন, বাংলাদেশে ভারত কেবল আওয়ামী লীগকেই বন্ধু মনে করে। আদতে তারা শেখ পরিবার এবং সংখ্যালঘু ছাড়া বাংলাদেশের অবশিষ্ট জনগণকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। হিন্দুত্ববাদি দর্শনে মুসলমানরা তো উঁইপোকার মত। এই বক্তব্য ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও বিজেপির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি স্বয়ং অমিত শাহ’র। মুসলমান নামের এই উঁইপোকাদের পিষে ফেলতে শেখ হাসিনার মত মানসিক বিকারগ্রস্ত, ইসলামোফোবিক স্বৈরশাসকদেরকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় দিল্লির প্রয়োজন।
এই প্রসঙ্গে ২০১৪ সালের একদলীয় নির্বাচনের দিনগুলোর কথা মনে করা আবশ্যক। সেই সময় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যান মোজেনা। সেই ভদ্রলোকের খানিকটা বিবেকবোধ ছিল। তিনি হাসিনার একদলীয় নির্বাচন রুখবার শেষ চেষ্টা হিসেবে দিল্লিতেও দৌড়ে গেছিলেন। বেচারাকে সেখানে খুবই অপদস্থ হতে হয়েছিল। ভারতের সাউথ ব্লক একেবারে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল যে, মোজেনার উপস্থিতিতে তারা খুবই বিরক্ত। ইংরেজি পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল, ‘MOZENA IS NOT WELCOME IN DELHI’. মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অপমান এখানেই শেষ হয় নাই। দিল্লি থেকে ড্যান মোজেনা ব্যর্থ হয়ে ঢাকায় ফিরলে হাসিনার সাঙ্গপাঙ্গরা চরম অকুটনৈতিক ভাষায় তাকে নানারকম ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছিল। আওয়ামী লীগের তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নতুন নামকরণ করেছিলেন, কাজের বেটি মর্জিনা। শেখ হাসিনা তার উপর এতই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশে দায়িত্ব শেষ করে চলে যাওয়ার আগে ড্যান মোজেনাকে আনুষ্ঠানিক বিদায় সাক্ষাৎ দিতেও তিনি সম্মত হন নাই। সেই সময় ভারতে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় ছিল। ওয়াশিংটনে তখনকার ওবামা প্রশাসনের সাথে দিল্লির ছিল দারুণ মাখামাখি। হাসিনার সাথেও কংগ্রেসের অতি পুরনো সম্পর্ক। সেই জোরে হাসিনাও ড্যান মোজেনাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পেরেছিলেন। একদলীয় নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর মার্কিনীরা কিছুদিন মানঅভিমান নাটক দেখিয়ে একসময় হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন মেনে নিয়েছিল। হাসিনার পক্ষে দূতিয়ালি করার জন্য ভারতের তৎকালিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী সালমান খুরশিদ এবং পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে কয়েকবার অবশ্য ওয়াশিংটনে যেতে হয়েছিল। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শেখ হাসিনা আশা করছেন যে, এবারও দিল্লি তার ওয়াশিংটনের সাথে সমস্যা মিটিয়ে দিতে সক্ষম হবে।
তবে গত আট বছরে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দিল্লিতে কংগ্রেস-শাসনের অবসান হয়ে চরম সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদি বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। অপরদিকে ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন যে, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারই হচ্ছে তার পররাষ্ট্র নীতির মূল কাঠামো। দীর্ঘদিন পর গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রসঙ্গ আবার আলোচিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, জুনিয়র বুশের ইসলামের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ এখন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকারে নেই। আফগানিস্তান থেকে দখলদার সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে ওয়াশিংটন মুসলমানদের বিরুদ্ধে একতরফা, আগ্রাসী যুদ্ধের আপাতত: সমাপ্তি টেনেছে। তার পরিবর্তে চীন এবং রাশিয়ার উত্থানকে প্রতিহত করাই এখন পশ্চিমা জোটের অগ্রাধিকার। চতুর্থত এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই অঞ্চল ভারতকে ইজারা দেওয়ার যে নীতি বর্তমান শতাব্দীর প্রারম্ভে ওয়াশিংটন নিয়েছিল তার দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেছে। গত দুই দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ভারত একচেটিয়াভাবে উপমহাদেশে তার আধিপত্যবাদ চালিয়েছে। দিল্লি যখন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওয়াশিংটন অনেকটা অনুগামীর মত তাকে অনুসরণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত এবং চীনের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকটাই কমেছে। প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ভারতের প্রভাব কমিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের সবচাইতে বৃহৎ অঞ্চলটিতে পূর্বের মত প্রধান ভূমিকায় ফিরতে ইচ্ছুক। নতুন নীতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পশ্চিমা জোটের কৌশলগত মিত্রের বিশেষ অবস্থানের অবশ্য কোন পরিবর্তন হবে না। তবে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত নেবে ওয়াশিংটন, কেবল সেগুলো বাস্তবায়নে সহায়কের ভূমিকা থাকবে দিল্লির। অতএব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা প্রকৃতই দেখতে চায় তাহলে দিল্লির পক্ষে ২০১৪ সালের মত হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের পক্ষে দূতিয়ালি করা সম্ভব হবে না বলেই আমি মনে করি। গত বছর গণতন্ত্রের সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে বাইডেন প্রশাসন মোদি এবং হাসিনাকে এ বিষয়ে আগাম সতর্ক করেছে। ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জনগণের ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেই সুযোগ গ্রহণ করবার যোগ্যতা ও সাহস দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বের রয়েছে কিনা সেই প্রশ্নের জবাব আমরা হয়ত বর্তমান বছরের মধ্যেই পেয়ে যাব।
সম্পাদক, আমার দেশ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন