মিনার রশিদ
‘আমি প্রথম আলোতে লেখি কেন?’ এরকম আত্মপক্ষ সমর্থনে গতকাল একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন আসিফ নজরুল যা হয়তোবা অনেকের নজরে এসেছে ! কমেন্টস সেকশনে উনার পাঠকগণও প্রিয় লেখককে সম্ভবত কিছু ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন! জানি না, সেই ম্যাসেজের কতটুকু তিনি নিজের উপলব্ধিতে টানতে পেরেছেন! পাঠকদের মন্তব্য থেকেও সম্ভবত তাদের সচেতনতার উত্তাপ অনুভব করতে পারেন! জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সাধারণ পাঠকদের সক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই মনে হয়েছে।
প্রথম আলোতে লেখার যুক্তি হিসাবে তিনি প্রশ্ন করেছেন, সরকারের ‘অন্ধ বিরোধী’ পত্রিকাগুলোতে লিখে লাভ কি? ‘তেমন চলে না’ এমন পত্রিকায় লিখলে তাঁর লেখাগুলি এত অধিক সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাত না! অন্ধ হয়ে নয়, চোখ খোলা রেখে যারা সরকারের বিরোধিতা করে সেসব পত্রিকায় লিখেছেন বলেই তাঁর লেখাগুলি এত অধিক সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছেছে এবং তিনি আজকের আসিফ নজরুল হতে পেরেছেন! এটা অবশ্যি তিনি ঠিক বলেছেন যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি প্রথম আলোর প্রতি তাঁর যুক্তিসঙ্গত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ‘মধ্যপন্থী, দেশপ্রেমিক ও যুক্তিপ্রবণ’ একটা জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন বলে!
কাজেই স্ট্যাটাসটি গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করলাম। প্রথম আলোর বদৌলতে উনি যে ‘মধ্যপন্থী , দেশপ্রেমিক ও যুক্তিপ্রবণ’ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে গেছেন তাদেরকে সেই স্ট্যাটাসের কমেন্টস সেকশনে খুঁজতে শুরু করলাম! একে একে সবগুলি কমেন্ট পড়লাম। এসব মন্তব্যের অনেকগুলিই চিত্তাকর্ষক বা মাইন্ড ব্লোয়িং!
উনার রাজনৈতিক বিষয়ক লেখালেখির স্বাভাবিক বা এভারেজ লাইক এবং কমেন্টের চেয়ে এই স্ট্যাটাসটিতে কমপক্ষে তিন ভাগের একভাগ লাইক বা মন্তব্য পড়েছে! অর্থাৎ উনার পেইজে কারা লাইক দেন কিংবা উনার ভক্তদের বিরাট সংখ্যককে উনি ঠিকভাবে চিনতে পেরেছেন বলে মনে হয় না ! উনি যখন সরকারের বিরুদ্ধে একটি সাহসী, সত্য কথা বলেন তখন উনার লাইক , কমেন্টস এর সংখ্যা অনেক অনেক বেড়ে যায়। আরেকটু খোলাসা করে বললে বলা যায় , উনি যখন বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া কিংবা ইসলামপন্থীদের পক্ষে একটু কথা বলেন তখন তা আকাশচুম্বী জনপ্রিয় হয়ে পড়ে ! এরা কিন্তু প্রথম আলোর তোহফা হিসাবে উনার কাছে আসা কথিত ‘মধ্যপন্থী, দেশপ্রেমিক ও যুক্তিপ্রবণ’ অংশ নহে! তাঁর কিছু স্ট্যাটাস এবং পাঠকদের মতামত নিয়ে গবেষণা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে পড়ে!
আজকের আলোচিত স্ট্যাটাসটিতে শতকরা আশি ভাগ মন্তব্যকারী লেখকের মন্তব্যের সাথে একমত হতে পারেন নাই! তাদের ক্ষোভের মূল কারণ তাদের প্রিয় লেখকের প্রথম আলোর পক্ষে সাফাই গাওয়া। অর্থাৎ পাঠকদের শতকরা আশি ভাগ যারা আসিফ নজরুলের লেখা পছন্দ করেন তারা প্রথম আলোকে পছন্দ করেন না!
দুদিন আগে ইলিয়াস আলীর গুম নিয়ে নেত্র নিউজের প্রতিবেদনটি নিয়ে একটা টু শব্দ উচ্চারণ না করাতে তিনি দেশের সকল মিডিয়া- এমনকি বিবিসি বাংলার কঠোর সমালোচনা করেছেন। আসিফ নজরুল কি মনে করেন, আজ আওয়ামী লীগের জায়গায় বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে প্রথম আলো সহ দেশের সকল মিডিয়া এই সংযমটি পালন করতো? কাজেই দুদিন আগে ইনডাইরেক্টলি প্রথম আলোর সমালোচনা করে হঠাৎ সেই প্রথম আলোর পক্ষে এই সাফাই গাওয়া আপনার যুক্তিপ্রবণ পাঠকদের পক্ষে মনে নেওয়া কতটুকু সহজ হবে?
“প্রথম আলো অপশাসন বিরোধী, যে কোনো সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশী ও সবচেয়ে তীব্রভাবে এই অপশাসনের বিরুদ্ধে তারা দাঁড়িয়েছে।” প্রিয় আসিফ নজরুল, আপনার এই দাবিটি কতটুকু সঠিক? বিএনপি আমলে প্রথম আলোর এই তীব্রতা যতটুকু দেখা গেছে, এই আমলে সেই রৌশনীর শতভাগের এক ভাগ কি দেখতে পাচ্ছেন? আপনার যে কোনো ‘মধ্যপন্থী, দেশপ্রেমিক ও যুক্তিপ্রবণ’ পাঠক এক দমে কমপক্ষে দশটি ঘটনা তুলে ধরতে পারবেন। দৈনিক আমার দেশ ও তার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের উপর যখন ‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’ অপারেশন চালানো হয়, তখন আপনার পরিবার মানে এই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বাক স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে তীব্র নহে যদি স্রেফ একটা মোলায়েম প্রতিবাদ করা হতো, তবে আজ হতভাগা দেশটি এমনভাবে ফ্যাসিবাদের পেটে ঢুকতে পারতো না।
এক-এগারোকে কারা নিজেদের ব্রেইন চাইল্ড বলে ঘোষণা করেছিল? বর্তমান ফ্যাসিবাদ তো সেই এক-এগারোরই এক্সটেনশন মাত্র! ২০০৮ এর নির্বাচনের ফাইন মর্নিং এ আরাফাত রহমান কোকোর কথিত মানি লন্ডারিং এর নিউজটিকে হেড লাইন করেছিল এই প্রথম আলো! বাঘ (ব্যর্থ রাষ্ট্র) আসার আগেই যারা দিবানিশি বাঘ বাঘ বলে আর্ত চিৎকার করেছে- তারা এখন উঠোনে বাঘ দেখেও পুরো নীরব হয়ে পড়েছে!
আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক এম এ জলীল এবং হু. মু. এরশাদ সেই নির্বাচনে ডিজিএফআইয়ের ভূমিকা জানিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনাও মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন, ‘আমরা ইচ্ছা করলেই সেই নির্বাচনে এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা বানাতে পারতাম! বিশ্বাস করুন, এটা করতে পারতাম।’
সুদূর লন্ডন থেকে দা ইকোনোমিস্ট জেনে গেছে যে ইন্ডিয়ান ব্যাগস অব ক্যাশ এন্ড এডভাইস কীভাবে ২০০৮ এর নির্বাচনটিকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু প্রথম আলো পরিবারের দৃষ্টিতে এটি একটি সহীহ নির্বাচন! এই হলো আসিফ নজরুলদের প্রথম আলো পরিবার! আসিফ নজরুল এখনও ২০০৮ এর নির্বাচনকে ৯১,৯৬ ও ২০০১ এর নির্বাচনের সাথে একই কাতারে রাখেন!
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর পর বিএনপি নেতৃত্বে যখন তীব্র আন্দোলন সৃষ্টি হয় তখন সেই আন্দোলনকে পেট্রোল বোমার নাশকতা হিসাবে কে তুলে ধরেছিল? তীব্র আন্দোলন করলে নাম দেয় নাশকতা , অন্যদিক ভদ্রগোছের কিছু করলে টিপ্পনী কাটে, হ্যাডমের অভাব- বিরোধীদলগুলিকে এরকম বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বেকায়দায় কে বা কারা ফেলেছিল ? কাজেই শুধু ফ্যাসিবাদের জন্ম প্রক্রিয়াতেই নয়, পরবর্তীতে এর লালন-পালনেও প্রথম আলো গ্রুপের ভূমিকাটি স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
এখন বাণিজ্যিক কারণে বা নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই কিছু সত্য কথা বলছে । আসিফ নজরুলরা এখন সেই প্রথম আলোর পক্ষে যতই ওকালতি করুন না কেন – সেই প্রথম আলো দিয়ে এদেশের জনগণের কিংবা গণতন্ত্রের কতটুকু উপকার হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন!
লেখকঃ বিশিষ্ট কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন