শিবলী সোহায়েল
আমার দেশ পত্রিকার ফেসবুকে পাঠকের নানা রকম মন্তব্যে চোখ বুলাচ্ছি। উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা ও প্রত্যাশার পাশাপাশি বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেখছি। এসময় হঠাৎ একটি মন্তব্যে চোখ আটকে গেল। বেশ কড়া উপদেশমূলক মন্তব্য। মন্তব্যকারী প্রথমেই আমার দেশকে রিপোর্টের বস্তুনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে সবক দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তিনি একজন সাংবাদিক। দেখে ভাল লাগল যে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এখনও অবজেক্টিভিটি বা বস্তুনিষ্ঠতার মত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যাবহার করে। যদিও আজকাল তাদের কাজে এর প্রতিফলন খুব একটা চোখে পড়েনা। কাজে প্রয়োগ করতে না শিখলেও একে অপরকে অন্তত ভাল বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছে তাও বা কম কি? বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। এই পরামর্শ দেবার চর্চাটা জারি থাকলে একদিন না একদিন সুফল তো আসবেই। কিন্তু হতাশ হতে হল সাংবাদিক মশায়ের মন্তব্যের শেষ দুটো লাইন পড়ে। এখানে এসে তার মুখোসটি টুপ করে খুলে পড়ল।
বিষয়টি অনেকটা বাংলাদেশে প্রচলিত একটি কৌতুকের মতই মনে হল। কৌতুকটি হল, এক লোক শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে খুব চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ লাইনে এসে ভর ভর করে মুখ দিয়ে তার আঞ্চলিক ভাষা বের হয়ে যায়। যেমন, “নদীর পারে গিয়েছিলুম, যেই না কাঁদায় পা দিয়েছি ওমনি ভ্যার ভ্যারাইয়া হান্দাইয়া গেলাম”। তো আমাদের এই সাংবাদিক মশায়েরও সেই অবস্থা। তিনি শেষ দুই লাইনে লিখেছেন – “…… দয়া করে দলীয় লিফলেট বানিয়েননা আমার দেশ পত্রিকা তো এসব কারনে ডুবেছে”।
আমার দেশকে দলীয় লিফলেট ট্যাগ দিয়েছিল এক আওয়ামী মন্ত্রী। আর এখানে দেখা যাচ্ছে, বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতার দাবীদার এই সাংবাদিক আওয়ামীলীগের বয়ানেরই প্রতিধ্বনি করছেন। আওয়ামীলীগ আমার দেশকে এধরণের ট্যাগ দিতেই পারে। যেমন ডোনান্ড ট্রাম্প সিএনএনেকে ফেক নিউজ বলে ডাকতো। আওয়ামীলীগের তো শুধু আমার দেশই নয়, তাদের ভয় – স্বাধীন সংবাদপত্র ও মানুষের বাক-স্বাধীনতায়। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরে এই আওয়ামীলীগই একের পর এক বন্ধ করে দিয়েছিলো – গণকন্ঠ, হক কথা, লাল পতাকা, মুখপত্র, বাংলার মুখ, স্পোকসম্যান সহ বিভিন্ন সংবাদপত্র। দুহাজার নয় সালে ক্ষমতায় এসে আবারও তারা গণমাধ্যমের উপর চড়াও হয়। একে একে বন্ধ করে দেয় চ্যানেল ওয়ান, ইসলামী টিভি, দিগন্ত টিভি ও আমার দেশ সহ অসংখ্য মিডিয়া এবং অনলাইন পত্রিকা। হামলে পড়ে দৈনিক সংগ্রাম অফিসে।
ট্রাম্প, মুজিব, কিম জং উন, মোদি, হাসিনা এদেরকে বলা হয়, “ডিলুশনাল ডেমাগগ”- যারা গলাবাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে মোহাচ্ছন্ন রেখে দেশের সম্পদ লুটপাট করতে চায়। এধরণের ডিলুশনাল ডেমাগগদের প্রধান শত্রু হচ্ছে গণমাধ্যম। সিএনএন অথবা আমার দেশ শুধু নয় ছোটবড় সংবাদপত্র এমনকি ফেসবুকের সামান্য পোস্টকেও তারা ভয় পায়। কিন্তু একজন সাংবাদিক যখন এই ডিলুশনাল ডেমাগগদের ভাষায় কথা বলে তখন অবাক না হয়ে পারা যায় না ।
সাংবাদিক মশায়ের শেষ লাইনটি তো আরও অবাক করা। তিনি বলছেন, আমার দেশ তো এসব কারণেই ডুবেছে।
ডুবেছে? !!!! ‘ডুবেছে’ শব্দটির ব্যাবহার কি এখানে সঠিক হয়েছে? আমরা তো বুঝি, কেউ যদি ভুল করে পা পিছলে পানিতে পড়ে ডুবে যায় অথবা নিজের দোষে পানিতে ডোবে সেক্ষেত্রে ‘ডুবেছে’ শব্দটি ব্যাবহার করা যায়। কিন্তু কাউকে যদি গায়ের জোরে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়, তাহলে কি তাকে ডুবেছে বলা যায়? নাকি বলা হয় ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে? এখন জোরজবরদস্তি পানিতে ডুবিয়ে হত্যার ঘটনাকে যখন কেউ ডুবেছে বলে তখন কি স্পষ্ট বোঝা যায় না যে সে হত্যাকারীকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই ভিক্টিম ব্লেমিং করছে? এই কাজ তো একমাত্র হত্যাকারীর সহযোগীর পক্ষেই সম্ভব।
যখন কোন অপরাধ বা অন্যায় কাজের শিকার ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে তার ক্ষতির জন্য দায়ী করা হয় তখন তাকে ইংরেজিতে ভিক্টিম ব্লেমিং বলা হয়। গত একযুগে আওয়ামীলীগ ও তার উচ্ছিষ্টভোগীদের হাতে অসংখ্য ভিক্টিম ব্লেমিং-এর উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। দুহাজার তের সালে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছয়টি বালুর ট্রাক দিয়ে খালেদা জিয়াকে তার বাসায় অবরুদ্ধ করে আওয়ামীলীগ। একইভাবে দুহাজার পনের সালের পাঁচই জানুয়ারি আবারও তেরোটি বালু, ইট ও রড ভর্তি ট্রাক দিয়ে খালেদা জিয়াকে তাঁর গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে যেন তিনি পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে না পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এটি ছিল অত্যন্ত লজ্জাকর একটি ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার পরপরই নিজেদের অপরাধ ঢাকতে আওয়ামীলীগ ও তার দালালেরা নেমে পড়ে ভিক্টিম ব্লেমিং-এ। তারা বলতে থাকে খালেদা জিয়াই নাকি সাজগোজ করতে করতে দেরি করে ফেলেছিল, এভাবে কি আর আন্দোলন হয়? এখানে শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করার কথা, রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে, কেন সে এমন ন্যক্কারজনক কাজ করল? কিন্তু তা না করে তারা ভিক্টিম ব্লেমিং-এর মাধ্যমে মানুষের আঙ্গুল অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করে।
আবার, যুদ্ধাপরাধী বিচারের নামে সাজানো আদালতের সীমাহীন অবিচার ও পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে মানুষ যখন প্রতীবাদে নামে তখন পুলিশ দিয়ে এই প্রতিবাদী নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালানো হয় । দুহাজার তের সালের একই দিনে একশ পঁচাত্তর জনেরও বেশি মানুষকে তারা হত্যা করে। আওয়ামীলীগের দালালদের মুখে শোনা যায়, এরা শুধু শুধু মিছিলে এসে মরছে কেন? আবারও সেই ভিক্টিম ব্লেমিং। এখানে প্রশ্ন হবার কথা ছিল, পুলিশ কেন গুলি করছে? জনগণের প্রতীবাদ করার অধিকার আছে। কিন্তু সেই প্রতীবাদ মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করার অধিকার কোন আইনে পেল? একটি সিভিল ইস্যুকে সিভিল আইনে ম্যানেজ না করে কেন মিলিটারি পদ্ধতিতে মানুষের বুকে, মাথায় গুলি করা হচ্ছে?
ভিক্টিম ব্লেমিং-এর আরেকটি অবিশ্বাস্য উদাহরণ হচ্ছে- আবরারের ঘটনা। এই কয়েক বছর আগে বুয়েটে আবরারকে বীভৎসভাবে পিটিয়ে হত্যা করার পর আওয়ামীলীগারদের মুখে শুনতে পেলাম, কি দরকার ছিল ফেসবুকে লিখে খালি খালি জীবনটা দেওয়ার?!! সেই ভিক্টিম ব্লেমিং। এই সাংবাদিক মশায় যেমন প্রশ্ন করছেননা আমার দেশকে সরকার কোন আইনে বন্ধ করল? এভাবে কি চাইলেই একটি গণমাধ্যম বন্ধ করে প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া যায়? তেমনিভাবে আবরারের খুনিদের সমর্থকরাও প্রশ্ন করছেনা ফেসবুকে একজনের পোষ্ট মতের বিপক্ষে গেলেই তাকে পিটিয়ে হত্যা করা কোন সভ্য সমাজে সম্ভব?
এটি স্পষ্ট যে আমার দেশকে নিয়ে এই সাংবাদিক মশায়ের মন্তব্য আওয়ামীলীগ ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগীদের ভিক্টিম ব্লেমিং ছাড়া আর কিছুই নয়। তবুও আমরা একটু পেছনে ফিরে দেখবো আমার দেশ কি সংবাদপত্র হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ডিলুশনাল ডেমাগগের রুদ্র রোষে পড়েছে নাকি ঐ সাংবাদিক মশায়ের কথামত নিজের দোষে ডুবেছে।
এই সাংবাদিক মশায় যদি পেশাদার সাংবাদিক হয়ে থাকেন তবে তিনি নিশ্চয় জানেন যে সাংবাদিকতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হচ্ছে – দেশের নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক বা ওয়াচ ডগ হিসাবে কাজ করা। সাংবাদিকদের একটি অন্যতম মূল দায়িত্ব হচ্ছে- সরকারের কাজকে মনিটর করা, প্রশ্ন করা এবং সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করা।
চলুন দেখি আমার দেশ কি করেছিল – দুহাজার নয় সালে ক্ষমতায় এসে কিছুদিনের মধ্যেই আওয়ামীলীগ যখন দুর্নীতির রেকর্ড গড়ে ফেলে, আমার দেশ তখন তথ্য প্রমাণ সহ প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও তৎকালীন জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই এলাহীর পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের খবর মানুষের সামনে তুলে ধরে। এই অভিযোগের তদন্তের জন্য পেট্রো-বাংলা এবং মন্ত্রণালয়ের চিঠি চালাচালির বিষয়টিও আমার দেশ জনসমক্ষে নিয়ে আসে। আবার দুহাজার বারো সালের ডিসেম্বরে আমার দেশ ফাঁস করে দেয় তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক নাসিমের সাথে বেলজিয়াম প্রবাসী আওয়ামী আইনজীবী জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন। এই কথোপকথনে পরিষ্কার দেখা যায় কিভাবে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে আওয়ামী সরকার। আমেরিকায় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি যেমন এক ঐতিহাসিক ঘটনা, তেমনি বাংলাদেশে- স্কাইপ কেলেঙ্কারি একটি জঘন্য ও অমানবিক ষড়যন্ত্রের ঐতিহাসিক দলিল। আমার দেশের সাহসী সাংবাদিকতা ও দায়িত্বশীলতার এমন আরও উদাহরণ দেওয়া যাবে।
এই প্রতিটি সংবাদ ছিল দেশের ও জনগনের স্বার্থ ও সম্পদ রক্ষায় দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু আওয়ামীলীগ বুঝতে পারে এরকম সাহসী সংবাদপত্র রেখে দুর্নীতি চালিয়ে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়। তাই তারা আমার দেশ-এর বিরুদ্ধে মামলা, হামলা করে গায়ের জোরে পত্রিকা বন্ধ করে সম্পাদককে গ্রেফতার করে রিমান্ডের নামে তাঁর উপর নির্মম নির্যাতন চালায়। এ সাংবাদিকের তখন দায়িত্ব ছিল সংবাদপত্রের উপর এমন নিপীড়নের প্রতীবাদ করা। তিনি কি তা করেছিলেন?
সাংবাদিক মহাশয়কে এখন দেখা যাচ্ছে বীর বিক্রমে আমার দেশকে দোষারোপ করে মন্তব্য করতে। কিন্তু তিনি কি এমন সাহসী ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নজির দেখাতে পারবেন? তিনি কি গুম হয়ে যাওয়া কাউকে নিয়ে একটি ফিচার লিখতে সাহস পাবেন? তিনি কি প্রশ্ন করতে পারবেন, কেন একজন সাবেক মন্ত্রী, বিগ্রেডিয়ার, ব্যারিস্টার, পরিচিত রাজনৈতিক নেতা, একজন সাধারণ ছাত্র অথবা দেশের নাগরিক গুম হয়ে গেল? তিনি কি প্রশ্ন করতে পারবেন বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের টাকা কিভাবে লোপাট হল? কিভাবে তদন্তে জড়িত একজন আইটি এক্সপার্ট গুম হয়ে গেল? কেন সে ফিরে এসে আর কোন কথা বলে না? এই প্রশ্ন তোলা কি সাংবাদিকের দায়িত্ব নয়? এই দায়িত্ব কি তিনি পালন করছেন ? নাকি তিনি মাফিয়াদের সহচর হয়ে, অবৈধ খুনি সরকার– ডেলুশনাল ডেমগগের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রয়োজনে ভিকটিম ব্লেমিং-এ ব্যস্ত আছেন?
(লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কলাম লেখক)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন