অলিউল্লাহ নোমান
সাবেক সচিব হাবিবুল আওয়ালকে আওয়ামী নির্বাচন কমিশনে প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগের পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন প্রধান চ্যালেঞ্জ সব দলকে জাতীয় নির্বাচনে নিয়ে আসা। তাঁর সাথে তাল মিলিয়ে আওয়ামী সুশীল গোত্রের প্রাণীরাও সূর তোলেছেন। কথিত সুশীল প্রাণীরাও বলছেন, এই কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো সবার আস্থা অর্জন করা। হাবিবুল আওয়াল সাহেবের কথার সাথে সুশীল প্রাণীদের সূরের মিল আছে। তাল ও লয় একটু ভিন্ন। তবে কথার অর্থ প্রায় কাছাকাছি।
২০১৮ সালের শেষ দিনের ইলেকশনের আগেও এরকম একটা সূর উঠেছিল। আওয়ামী সুশীলদের গডফাদার ইন্ডিয়া থেকে বলা হয়েছিল-একটা অংশগ্রহনমূলন নির্বাচন দেখতে চায় তারা। মানে সবাই অংশগ্রহন করছে এরূপ নির্বাচন। তখন ক্ষমতার স্বপ্নো বিভোর বিরোধী দলের নেতারা মনে করেছিলেন কাম হইয়া গেছে! এইবার আওয়ামী লীগ ধরা খাইছে! ইন্ডিয়া অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন চাইছে। সুতরাং বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত! এছাড়া শীর্ষ গোয়েন্দা কর্তারাও নাকি যোগাযোগ শুরু করেছিলেন বিরোধী নেতাদের সাথে। জানতে চেয়েছিলেন ক্ষমতায় গেলে তাদের সাথে কিভাবে কাজ করবে। আর যায় কৈ!! আজান দিয়া অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনের আওয়াজকে সফল করা হয়। হাতে সলতেবিহীন হারিকেন ধরাইয়া ঘরে ফিরাইয়া দিল সবাই মিলে। কিছুটা পুরাতন কাসুন্দি টানলাম যাতে ঘটনা গুলো বুঝতে সুবিধা হয়।
বলছিলাম হাবিবুল আওয়ালকে নিয়ে। তিনি হলেন ঘাপটিমারা আওয়ামী সুশীল গোত্রের প্রাণীদের একজন। তাঁকে কাছে থেকে দেখেছি ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত। পেশাগত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসাবে প্রায় নিয়মিত আইন মন্ত্রণালয়ে যাতায়াত ছিল তখন। তিনি ছিলেন আইন মন্ত্রণায়ের ড্রাফটিং শাখার যুগ্ম সচিব। পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছিলেন আওয়ামী আমলে। তাঁকে সচিব বানানোর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আইন মন্ত্রণায়ের বিচার শাখার কর্তারা। এক পর্যায়ে সচিব পদে তাঁর নিয়োগ নিয়ে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল আওয়ামী হাইকোর্টে। শেষ পর্যন্ত বিচার শাখার কর্তারা তাঁকে হাইকোর্ট দেখিয়ে তাঁকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে বদলী করতে বাধ্য করেছিলেন সরকারকে।
বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে পুরেপুরি পৃথক ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে তৈরি করতে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা অনেক পুরাতন। বিচারপতি মোস্তাফা কামাল প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিয়ে বিচার বিভাগ, সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে অনেক টানাটানি হয়েছে দীর্ঘদিন। এই হাবিবুল আওয়ালরাই ছিলেন বিচার বিভাগকে প্রশাসন খেকে পৃথক করার বিরুদ্ধে।
ঘাপটিমারা আওয়ামী হিসাবে আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং বিভাগে থাকার সুবাদে সরকারের অনেক গোপন খবর আওয়ামী লীগের কাছে পৌছাতেন তিনি। চার দলীয় সরকারের অনেক আইনের খসড়া আগেই পৌছে দিতেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে। পরবর্তীতে পুরস্কৃত হয়েছেন। আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছেন। হাইকোর্টের আদেশ হওয়ার পর তাঁকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বানানো হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বও পেয়েছিলেন একবার। চাকুরির মেয়াদ বয়স শেষ হয়ে গেলে পুরস্কার হিসাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছেন। সুতরাং একদিকে আওয়ামী লীগে অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি বা পদোন্নতি বঞ্চিত করে কর্মহীন অবস্থায় রেখেছে। আরেক দিকে আওয়ামী ব্লাড পরীক্ষার মাধ্যমে পুরস্কৃত করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারে যাওয়ার পর পুরস্কৃতদের একজন হলেন হাবিবুল আওয়াল। এখন সবার আস্থা অর্জনের মাধ্যমে একটি অংশগ্রহনমূলক ইলেকশনের দিকে যাওয়া হলো তাঁর দায়িত্ব। এই এই দায়িত্বে তাঁকে সফল করতে আওয়ামী সুশীল গোত্রের লোকজন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যেভাবে আওয়ামী সুশীলরা ব্যস্ত হয়েছিলেন ২০১৮ সালে। তখনো জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন সফলের পেছনে সুশীলদের অবদান অনস্বীকার্য।
শেখ মুজিবের নামে জিকির করে মুখে ফেনা তোলেন ড. কামাল হোসেন। তিনি আবার আওয়ামী সুশীল নেতা। তাঁকে ঈমাম বানিয়ে সুশীলরা আওয়াজ দিলেন আসুন অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন সফল করি। সেই আওয়াজে শরীক হলেন বিএনপিসহ অন্যান্য দল গুলো। ইন্ডিয়ার চাহিদা অনুযায়ী অংশগ্রহনমূলক নিবাচন সফল করতে সবাই সহযোগিতা করলেন।
হাবিবুল আওয়ালকেও সফল করতে শেখ মুজিবুর রহমানের আধ্যাত্মিক সন্তানরা আওয়াজ উঠিয়েছেন। কোন কৌশলে এবার আস্তা অর্জন ও অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন হয় সেটাই দেখার অপেক্ষায়।
শেষ করবো সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফের একটি উক্তি দিয়ে। তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম একবার। দীর্ঘ ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন তিনি। ইন্টারভিউতে একটি প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কি করা প্রয়োজন? তখন তিনি এক কথায় বলেছিলেন, কোন কিছুরই প্রয়োজন নাই। আমি তাঁর দিকে হা করে তাকালম।
তারপর বললেন, বড় রাজনৈতিক দল গুলো প্রতিজ্ঞা করতে হবে নির্বাচনে কোন রকম প্রভাব বিস্তার করা থেকে বিরত থাকবে। এই প্রতিজ্ঞা সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকলে নির্বাচন অটোমেটিক নিরপেক্ষ হবে। ভোটগ্রহনের দায়িত্বে যারা থাকবেন তারা সুন্দারভাবে ভোটগ্রহন শেষে ফলাফল ঘোষণা করে দিবে। সবাই সেটা মেনে নিয়ে ঘরে ফিরবে। এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে সবাই নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা ব্যতিত ভোট নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ নাই।
এ প্রসঙ্গে তিনি একটি ইদাহরণ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তাঁর সময়ে টঙ্গি পৌরসভা এবং দাপুনিয়া ইউনিয়ন নির্বাচন করেছিলেন সরকারি আমলা ও পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া। টঙ্গি পৌরসভায় দীর্ঘ বছরের পর বছর নির্বাচন করা সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি স্থানীয় সকল রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালীদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করলেন। সবাইকে রাজি করালেন প্রতিজ্ঞা করতে নির্বাচনে অবৈধ কোন প্রভাব বিস্তার থেকে বিরত থাকবে। সবাই রাজি হলেন। ভোটের দিন কেন্দ্রে কোন পুলিশ লাগে নাই। পুলিং অফিসার হিসাবে নিয়োগ দিলেন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের। ভোটের দিন সব প্রার্থীদের নিয়ে তিনি কেন্দ্রে কেন্দ্রে গেলেন। সরকারি হস্তুক্ষেপের কোন সুযোগ রাখা হয় নাই। সুন্দর মডেল নির্বাচন করে দেখিয়ে দিলেন সব প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দল চাইলে সরকারি সহযোগিতা ছাড়াও সুষ্ঠু-সুন্দার নির্বাচন সম্ভব।
এখান আপনারাই ভাবুন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে ফেরেস্তাকে নির্বাচন কমিশনে বসালেও কি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব!!!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন