ডা. সুমন নাজমুল হোসেন
আজ থেকে ২৫ বছর আগের কথা, ৩ নভেম্বর ১৯৯৬। যে দিনটি কখনো ভুলবার নয়। তখন সদ্য দু'মাস হল কার্ডিয়াক সার্জারীর সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে আমি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (NICVD) যোগ দিয়েছি। আগের দিন ওটিতে একজন রোগীর বাইপাস অপারেশনে ব্লিডিং বন্ধ করতে সমস্যা হচ্ছিল। ওটির কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে বিকেল পাঁচটা প্রায়। বাড়ি ফিরেই শুনি যে আমার মা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে আমার কর্মস্থল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
৯৬-এ মোবাইল সহজলভ্য ছিল না। কাজেই আমি জানতেও পারি নি যে, অন্য এক রোগীর জীবন বাঁচাতে আমি যে হাসপাতালে সংগ্রাম করছি, সে হাসপাতালের আরেকটি অংশে আমার আম্মার জীবন বাঁচানোর যুদ্ধের মূল্যবান সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
হেমন্তের সেই বিকেলে যখন আমি সিসিইউতে আম্মার কাছে পৌঁছুলাম, তখন হার্ট এটাকের তীব্র যন্ত্রণা এবং চিকিৎসার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার তিনি ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি। সে অবস্থাতে তাঁর সাথে দু'একটা কথা বলার সুযোগ হল।
সারা জীবন কষ্ট করে যে সন্তানকে চিকিৎসক বানিয়েছেন, এ কঠিন সময়ে তার উপস্থিতি হয়তো তাঁকে কিছুটা স্বস্তি দিল। কিন্ত এ স্বস্তি ছিল অলীক। রাত গভীর হবার সাথে সাথে তাঁর কষ্টের মাত্রা বাড়তে থাকল। এখন বুঝি যে, severe Acute MI ক্রমেই Left ventricular failure রূপ নিচ্ছিল। ৩ নভেম্বর রাত দুটোর পরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। হৃদরোগ সার্জারী বিভাগে মাত্র দুই মাস কাজের অভিজ্ঞতায় সেদিন আমার বিশেষ কিছুই করার ছিল না।
মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পরে মা একাই আমাদের বড় করেছেন। তিনিই ছিলেন আমার পৃথিবী। মাকে ছাড়া পৃথিবীতে আমি একটি দিনও থাকতে পারব, এমন ধারনা আমার ছিল না। কিন্ত জীবন কেটে যায় পেরিয়ে গেছে সিকি শতাব্দী। এ পঁচিশ বছরে কতো হাজার হৃদরোগীর জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় অংশ নিয়েছি, কিন্ত সেদিনের সেই অপারগতার দুঃখ আজো কাটে নি। ৩রা নভেম্বর ১৯৯৬ আজো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আমার মা ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক রাজিয়া বেগমের মৃত্যুকে তাঁর জন্য কিছু করতে না পারার বেদনা এক জীবনে কাটবার নয়।
সবার কাছে আমার বাবা-মার জন্য দোয়ার অনুরোধ রইল।
[লেখক: বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিয়াক সার্জারী বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন