মো. ইলিয়াস
একের পর এক ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা নরেন্দ্র মোদি সরকারের! স্বাধীনতা সংগ্রামীকে লুটেরা বানাতে সহায়তা নিলেন বৃটিশ দলিলের!!
ভারতীয় রাজাকার হিসেবে পরিচিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বৃটিশদের সহায়তাকারী ”আরএসএস” সমর্থিত বিজেপি সরকার এবার নতুন করে ইতিহাস বিকৃতিতে হাত দিয়েছেন।
২০০ বছরের গোলামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের তালিকা থেকে ৩৮৭ জন মুসলিম বিদ্রোহীর নাম বাদ দিতে চলেছে দেশটির ইতিহাস গবেষণা কাউন্সিল।
কেরালার বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজীর ৭৫ হাজার বাহিনীর মধ্যে ওই ৩০০ জনের নাম রয়েছে।
যদি এই হাজি কুঞ্জাহামেদ এর বিশাল বৃটিশবিরোধীদের মধ্যে থেকে ৩৮০ জনের নাম বাদ দেয়া হয় এবং বৃটিশদের রায়ে গুলিতে নিহত হয়ে শহীদ হওয়া হাজীকেও বিতর্কীত করা যায় তা হলে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসই ওটল পালট হয়ে যাবেন বলে মনে করেন অনেকে।
হাজী সাহেবের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহীরা বর্তমানের কেরালা রাজ্যের মালাবার অঞ্চলে ১৯২১ সালে 'মোপলা বিদ্রোহ' নামে একটি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। যাতে নিম্ম বর্নের হিন্দু এবং মুসলিমরা ছিলেন।
'মোপলা বিদ্রোহ' সশস্ত্র সংগ্রামে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন বলে প্রচলিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, যার মধ্যে ২৩৩৯ জন বিদ্রোহীও ছিলেন। বাকিরা ছিলেন বিদ্রীদের পরিবারের সদস্য। অত্যন্ত নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হয়।
এই বিদ্রোহীদের মধ্যে ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করে একটি বদ্ধ ট্রেনের কামরায় চাপিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ে ৬৪ জনের মৃত্যু হয়। সে বছরের ১০ই নভেম্বরের ওই ঘটনা 'ওয়াগন ট্র্যাজেডি' নামে ইতিহাসে চিহ্নিত। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা একে অপরের মূত্র পান করে জীবনরক্ষা করতে বাধ্য হন।
অবাক করা বিষয়ে হলেও সেই আন্দোলনে নিহত ৩৮৭ জনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের 'শহীদ' বলতে রাজী নয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ (আইসিএইচআর)।
অথচ ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত দিয়ে ডিকশনারি অফ মার্টার্স - ইন্ডিয়াস ফ্রিডাম স্ট্রাগল নামের যে গ্রন্থমালা প্রকাশ করেছিল আইসিএইচআর, তার পঞ্চম খন্ডে মোপলা বিদ্রোহীদের শহীদই বলা হয়।
বর্তমান কাউন্সিল বলছেন "ওই বিদ্রোহকে কখনই স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ বলা যায় না। ওটা ছিল একটা ধর্মীয় সহিংসতা। জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরকরণের প্রচেষ্টা ছিল ওটা।
নরেন্দ্র মোদি সরকারের বর্তমান কাউন্সিল আরো বলছেন তাদের তথ্যে ব্রিটিশ প্রশাসনের নথিপত্র যেমন আছে, তেমনই আর্য সমাজের নথি রয়েছে। আবার মালাবার অঞ্চলের ডেপুটি কালেক্টরের নথিও আছে। এছাড়াও সমসাময়িক সংবাদপত্র, নানা আদালতের নথি, ইত্যাদি খতিয়ে দেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
অবাক করার বিষয় হলো তিন সদস্যের কাউন্সিল এই তথ্য নিয়েছে সব বৃটিশদের দলীল থেকে!!
মালয়লাম সকল যায়গা জমি বৃটিশরা উচ্চ হিন্দুদের (জমিদারদের) সহায়তায় বাজেয়াপ্ত করে যখন কৃষকদের ভুমিহীন করে দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টা করেছিল তখন বৃটিশদের বিরুদ্ধে হাজী সাহেবের নেতৃত্বে গঠন হয়েছিল বিশাল বাহীনি।
তারা শুধু বিদ্রহেই করেনি পুরো অঞ্চল থেকে এক বছরের মধ্যে সকল বৃটিশদের তাড়িয়ে নিজেরাই সরকার গঠন করেন। সমগ্র ভারত বর্ষে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী হয়ে ওঠেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণা এবং ব্রিটিশদের আতঙ্ক।
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ব্রিটিশ প্রশাসন ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজীকে একজন দস্যু বা লুঠেরা বলে মনে করত। তাই ব্রিটিশ নথি বা সেই সময়ের আদালতের চার্জশিট - যা অধ্যাপক আইসাকের কমিটি যাচাই করেছে, সেখানে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজীকে তাদের চোখে অপরাধী প্রমাণ করার জন্য সব ধরনের শব্দ চয়নই থাকার কথা, নানান রকম ভাষ্যই হাজী সাহেবের বিরুদ্ধে থাকবে এটাই স্বভাবিক বলে ধরে নেয়া যায়।
কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক কাডাক্কাল বলছিলেন যে মাস ছয়েক ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী মালাবার অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ প্রশাসনকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন, সেই সময়ে তিনি সেখানে মালয়লা নাদ প্রতিষ্ঠা করেন।
"মালয়লা নাদ কথাটার স্থানীয় অর্থ হল যারা মালায়লাম ভাষায় কথা বলেন, তাদের জায়গা। হাজি তো খিলাফত নাম দেন নি তার প্রশাসনের।
১৯২০ সালের অগাস্টে একটি মসজিদে হামলার পরেই সেই বাহিনী নানা দিকে ব্রিটিশ থানা ও সরকারি দপ্তরে হামলা চালায়। এর আগেও বৃটিশদের বিরুদ্ধে তাদের চোরাগুপ্তা হামলা চলেছে। বৃটিশরা অতিষ্ঠি ছিল এক হাজী সাহেবের কাছে।
প্রায় এক বছর ধরে সেই লড়াইয়ের পরে ১৯২১ সালের অগাস্টে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দিয়ে গড়ে তোলেন তার নিজস্ব প্রশাসন।
কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যে গ্রেপ্তার হন তিনি, বৃটিশরা গুলি করে মেরে ফেলেন।
কুঞ্জাহামেদ হাজীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার আগে ব্রিটিশ প্রশাসন বলেছিল তিনি যদি ক্ষমা ভিক্ষা করেন, তাহলে তাকে মক্কায় নির্বাসন দেওয়া যেতে পারে।
তবে তার জবাব ছিল মক্কা তার প্রিয় জায়গাগুলির একটা। কিন্তু তার জন্য যদি ব্রিটিশরাজের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়, তার থেকে তিনি নিজ জন্মভূমিতে মৃত্যুকেই বেছে নেবেন। তারপরই তাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
তার জীবন কাহিনী নিয়ে ১৯৮৮ সালে এক কোটিরও বেশি টাকা খরচ করে তৈরি হয় একটি সফল ছবি।
ছবিটির নাম ছিল নাইন্টিন টুয়েন্টি ওয়ান।
বিদ্রোহের শতবর্ষেও তাকে নিয়ে বেশ কয়েকটি ছবি হচ্ছে।
"অভাবের তাড়নায় পড়া গ্রামীণ মানুষরা সারা দেশেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন। সেই সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই এ ধরণের বিদ্রোহ গড়ে উঠেছিল - যেগুলোর অভিমুখ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই।
"জালিয়ানওয়ালাবাগের জমায়েতটাও তো ছিল আদতে সেখানকার কৃষক-গ্রামীণ মানুষের অভাব অভিযোগের কারণেই। একই ভাবে অযোধ্যা, অন্ধ্রতেও বিদ্রোহ হয়েছে। এই মোপলা বিদ্রোহও সেই একই সময়ের ঘটনা। এটাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে চলবে না। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন না বলা একেবারেই ঠিক নয়," বলছিলেন অধ্যাপক গণেশ।
মোপলা বিদ্রোহ নিয়ে কেন দ্বিমত?
আরএসএস-পন্থী ঐতিহাসিকরা ওই বিদ্রোহকে ধর্মীয় দাঙ্গা হিসাবে দেখাতে চান আর অন্য এক অংশ ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম বলে মনে করেন।
বিজেপির এক নেতা রাম মাধব সম্প্রতি টুইট করেছেন যে মোপলা বিদ্রোহের মাধ্যমেই ভারতের মাটিতে প্রথমবারের মতো 'তালেবানি' চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বিজেপির এই অংশটা প্রতিনিয়তই ঐতিহাসি সত্যের নানান বিষয়েই কিছুদিন পরপরই বিতর্কীত করেন। তারা তাজমহলের নিচে জগন্নাথের মুর্তী থাকার দাবি তুলে সেটা ভাঙতে বলেন। বারবী মসদিজেদের নিচে রামের সমাধী বলে বিতর্ক তুলে সেখানে তুলকাম করেছেন।
আবার দ্বিতীয় অংশটি বলছে, আরএসএস যাকে দার্শনিক গুরু হিসাবে মানে, সেই বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে যদি স্বাধীনতা সংগ্রামী বলা যায়, তাহলে মোপলা বিদ্রোহীদের সেই সম্মান দেওয়া হবে না কেন।
কিন্তু তৃতীয় একটি অংশ আছেন ইতিহাসবিদদের মধ্যেই, যারা মনে করেন বিদ্রোহীদের মধ্যে, তাদের ভাষায় কিছুটা ধর্মীয় বাড়াবাড়ি হলেও মোপলা বিদ্রোহ ছিল আদতে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম।
বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সকলেই তাদের চোখে অপরাধী ছিলেন, কুঞ্জাহামেদ হাজী যেমন বৃটিশদের চোখে অপরাধী, ক্ষুদিরামও তাদের চোখে বিচ্ছিন্নতাবাদি, ক্ষুদিরামকে যেমন অস্রলুটের অভিযোগে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল, কুঞ্জাহামেদকেও থানা লুট করার জন্য মাথায় গুলি করে হত্যার আদেশ দিয়েছিল। আজ যদি একজনকে বৃটিশদের আদালতের দলীলকে ভিত্তি করে লুটেরা বা স্বাধীনতা সংগ্রামীর তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয় তা হলে তো সকলের সংগ্রাম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। শহীদ তিতুমীর, প্রিতিলতার আত্মত্যাগ নিয়েও আগামীতে এই বিজেপী বৃটিশ দলীল দিয়ে লুটেরা বানাবে। কৃষক বিদ্রোহ, প্রজা বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালে মুসলিম সৈন্যদের বিদ্রোহসহ বৃটিশদের বিরুদ্ধে সকল বিদ্রোহেরই আলাদা আলাদা উপলক্ষ থাকলেও মূল বিষয় ছিল বৃটিশ খেদাও।
বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে বর্তমান পাকিস্তানের লাহোর, পুনে, মহারাষ্ট্র, হায়দ্রাব থেকে মালয়লাম, বিশাল ভারতের ৩৩কোটি মানুষের মধ্যে অল্প কিছু উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদার, রাজকোষ, বৃটিশ চাকর ছাড়া সকল মানুষই ছিল দখলদার ক্লাইভদের বিরুদ্ধে।
ইতিহাসের কি নির্মম পরিস্থিতি যাদের নামে বৃটিশদের দালালীর অভিযোগ, যাদের নামে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নেয়ার অভিযোগ তারাই আজ ইতিহাস গঠন করতে বসেছেন! কে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন, কে করেনি! তা তারা ঠিক করে দিচ্ছেন!!
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সবার উপরে সেখানের মুসলমানদের অবদান, ২০০ বছরের বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যেমন সবার আগে মুসলিমরা বিদ্রোহ শুরু করেছেন, লড়েছেন, জীবন দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, একই ভাবে ১৯৪৭ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কারগিল যুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময়েও ভারতীয় মুসলিমরাই সবার আগে দেশ প্রেমের নজরানা দিয়েছেন।
কারগিল যুদ্ধে আমে*রিকান* দের তৈরি তখনকার সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ট্যাংক যখন মরুভূমির মধ্যে দিয়ে ভারতীয় বাহিনী ধ্বংস করার জন্য এগুচ্ছিল, ওই সময়ে ট্যাংক ধ্বংস করার মত কোন ক্ষেপনাস্র ভারতের ছিল না। সেই ট্যাংকের সামনে বুকে মাইন বেঁধে শুয়ে পড়ে শহীদ হওয়া প্রথম যে ভারতীয় সৈনিক তিনিও মুসলিম ছিলেন। কারগিল যুদ্ধে শহীদ হওয়া সৈন্যদের বড় একটা অংশই ছিল মুসলিম। যারা ভারতের হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন।
তথ্য সূত্র: বিবিসি, উইকিপিডিয়া, অনলাইন পত্রিকা।
মো. ইলিয়াস
গণমাধ্যমকর্মী
পাঠক মন্তব্য
nijer desh er ta dekhen na!!!!
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন