ড. কামরুল হাসান মামুন
শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হল অব্যস্থাপনার দুটি ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ঢাবির পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। স্ট্যাটাসে তিনি ঢাবি ছাত্রদের গণরুমের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা তুলে ধরে আক্ষেপ করে বলেছেন, 'আসলে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভোঁতা হয়ে গেছে।'
পাঠকদের জন্য পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো,
''শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গর্বের জায়গা দুটি:
(১) ১৯৪৭ আগের বিশ্বমানের যুগান্তকারী কিছু গবেষণা ও গবেষক নিয়ে।
(২) ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন আর ১৯৭১-এ বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা।
সত্যিই একটি দেশ সৃষ্টিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন জোরালো ভূমিকা রেখেছে বিশ্বে এমন আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যাবে কিনা আমার সন্দেহ।
অর্থাৎ ৪৭ এর আগে শিক্ষা ও গবেষণায় এবং ৪৭ এর পর থেকে ৭১ পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গর্ব করা যায়। আজ কি এই দুটির কোনটি নিয়ে গর্ব করার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট আছে? যেই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ নামক দেশটির সৃষ্টিতে এত জোরালো ভূমিকা রাখলো সেই স্বাধীন দেশটি যারা চালালো তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কি প্রতিদান দিল? সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আজ ঘুমানোর জন্যই জায়গা পায় না। যেই রুমে ৪ জনের থাকার কথা সেখানে ৪০ থেকে ৫০ জন থাকে। যাদের লাইব্রেরির ভিতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বিশ্বমানের গ্রাজুয়েট ও আন্ডারগ্রাজুয়েটের বই এবং গবেষণা প্রবন্ধ পড়ার কথা তারা লাইব্রেরির বাহিরে যত্রতত্র টেবিল বিছিয়ে চাকুরীর প্রত্যাশায় গাইড বই পড়ছে। এইসব নিয়ে কারো কোনরূপ উৎকণ্ঠা আছে?
দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৮৩১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা হয়েছে। প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বে এত বড় বিশ্ববিদ্যালয় খুব কমই আছে। এর চেয়ে অনেক ছোট অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের বাজেটও ৮৩২ কোটি টাকার অনেক বেশি। যেই বিশ্ববিদ্যালয় এই রাষ্ট্র সৃষ্টি করল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এত অমানবিক ভাবে রাখতে রাষ্ট্র যারা চালায় তাদের লজ্জা লাগে না? যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন করা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা আজ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাবি পর্যন্ত জানায় না।
বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই অবর্ণনীয় মানবেতর আবাসিক জীবন নিয়েও নস্টালজিক হয়। এটাকেও তারা মিস করে। এই গণরুম এবং নিম্নমানের খাবার নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্টেটাসও দেয়। নীলিমা আখতার নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসলেই বিশ্ববিদ্যালয় নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার চেয়ে অনেক বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু চাকরির বাজারের জন্য গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন বদলায়। এমনই যে পেছনে তাকিয়ে দেখলে দেখা যায়, জীবনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সময়টাই স্বর্ণ সময়। সীমাবদ্ধতা তো আছেই। কিন্তু একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের সরকারের টাকায় চলে এ বিশ্ববিদ্যালয়। গণরুমের বদনাম শুনি! আমি গণরুমে থেকেছি! কোন আক্ষেপ নেই!" দেখুন কি সাংঘাতিক কথা। গণরুমে থেকেছে কিন্তু কোন আক্ষেপ বা দুঃখবোধ কিংবা রাগ কিছুই নেই।
আসলে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভোঁতা হয়ে গেছে। জানেই না আমাদের শিক্ষার্থীদের সঠিক একটা পরিবেশ দিলে আজকে ভিন্ন এক বাংলাদেশ হতো। যেই স্বপ্নে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল সেই বাংলাদেশ হতো। অথচ শিক্ষার ন্যূনতম পরিবেশের অনুপস্থিতিতে মান সম্পন্ন শিক্ষার অভাবে আমরা জর্জরিত। গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমরা তলানিতে। আমরা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য যোগ্য কর্মী তৈরী করতে না পারার কারণে বড় বড় চাকুরীগুলো আজ বিদেশীদের হাতে চলে যাচ্ছে। অথচ আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলি।
বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কি নিয়ে গর্ব করা যায়? নিচের ছবির মত দৃশ্যের?''
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন