পিনাকী ভট্টাচার্য
আল যাযিরার প্রচারিত ডকুমেন্টারির প্রতিবাদে সেনাসদরের খুবই দুর্বল এবং অপ্রাসঙ্গিক বিবৃতিটা দেখলাম। সত্যি বলতে কী আমি খুব হতাশ হয়েছি বিবৃতিটা দেখে।
সামি মাদকাসক্তির কারণে বহিষ্কৃত ক্যাডেট কিনা, বা তাসনীম খলিল মুলধারার সাংবাদিক কিনা, নেত্র নিউজ অখ্যাত পোর্টাল কিনা এটায় আমাদের মানে জনগণের কী আসে যায়? সেনাসদরের উচিত ছিল ডকুমেন্টারিতে যেসব অভিযোগ ওখানে তোলা হয়েছে, যা নিয়ে আপামর মানুষ উদ্বিগ্ন যে আবার কী হতে যাচ্ছে, সেসব অভিযোগের জবাব দিয়ে সবার উদ্বেগ নিরসন করা। সেদিকে একেবারেই না গিয়ে যারা অভিযোগ তুলেছে তাঁদের নৈতিক অবস্থান থেকে সেনাসদরকে ডকুমেন্টারির প্রতিবাদ জানাতে হচ্ছে কেন? ডকুমেন্টারি প্রস্তুতের সাথে জড়িতদের চরিত্রে কালি লাগানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে কেন? ডকুমেন্টারি তৈরির সাথে যারা জড়িত তাদের চরিত্রে কালি লাগালে কী অভিযোগগুলো হাওয়ায় উড়ে যাবে?
অন্যের গায়ে কালি লাগিয়ে পরোক্ষভাবে নিজেকে সফেদ দেখানোর কৌশল অনুসরণ করতে গিয়ে কী নিজেদেরকেই আরো বেশি করে সন্দেহের কাতারে ফেলে দেয়া হচ্ছেনা? এই চেষ্টা করতে গেলেই জনগণের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, ডকুমেন্টারিতে উত্থাপিত তথ্যের বিরুদ্ধে সেনাসদরের বলার মতো সলিড কিছু নাই। ডকুমেন্টারি তো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, বর্তমান সেনাপ্রধান ও তার ভাইদের নানা অপকর্ম নিয়ে করা, সেই সাথে তাদের সাথে সরকার প্রধানের কী ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিলো সেইটা উন্মোচন করে, কীভাবে সেনাপ্রধানের অপরাধী ভাই সেই ঐতিহাসিক সম্পর্কেকে এক্সপ্লয়েট করছে সেই স্টোরি বলা। সেই ব্যক্তিবিশেষের অপকর্মের দায় কেন সেনাসদর যেচে নিতে যাচ্ছে?
সেনাসদরকে সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমেরিকার সেনাবাহিনীর অবস্থানের প্রসঙ্গ মনে করায়ে দিতে বলতে চাই, সেনাবাহিনীর আনুগত্য রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে নয়। আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে সংবিধানের কাছে। সেইজন্যই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থাতেও ট্রাম্পের অবস্থানকে সমর্থন না করে সেনাবাহিনী সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছিলো। রাজনৈতিক সরকারকে রক্ষার দায় সেনাবাহিনীর নয়। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে, রাষ্ট্রের নাগরিককে রক্ষা করবে। রাজনৈতিক সরকারকে এবং তার যাবতীয় দুষ্কর্ম থেকে সুরক্ষা দেয়ার দায় সেনাবাহিনীর নাই। রাজনৈতিক দলের সরকার দুষ্কর্ম বা সুকর্ম যাই করুক এর দায় ও কৃতিত্বের পুরোটাই ঐ দল ও সরকারের।
ডকুমেন্টারিতে রাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিনা দেখুন। রাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে রুখে দাড়ান। কিন্তু কোন ব্যক্তি; সে যেই হোক, তার কর্ম - সে আপনার বাবা বা ভাই হলেও তাকে রক্ষার দায় আপনার নাই। রাষ্ট্র আর সরকারের তফাৎ না বুঝলে, রাষ্ট্র আর সরকার একাকার হয়ে গেলে ধরে নিতে হবে রাষ্ট্র নাই হয়ে গেছে। রিপাবলিক আর পাবলিকের রাষ্ট্র নাই কোন একটা রাজার রাজত্বে পর্যবসিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মাঠে আপনাদের পূর্বসূরিরা কী বাংলাদেশকে একটা রাজত্ব বানানোর জন্য জান লড়ায়ে যুদ্ধ করছিলো? মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী যেই সেনাবাহিনীর লড়াকু যোদ্ধাদের সাহসে ভর করে সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে বাংলাদেশ স্বাধীন করছিলো; জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সাথে যেই বাহিনীর জন্ম জড়িত। সেই বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মহীয়ান আদর্শ একটা আধুনিক রিপাবলিকের কাছে অনুগত না হয়ে যদি নৈশ ভোটের প্রতারণার অনির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসে, তা আপামর মানুষকে ব্যথিত করে। সেনাবাহিনীর অগৌরব, আমাদেরও অগৌরব। সেনাবাহিনীর গায়ে কালি লাগলে আমাদের হৃদয়ও রক্তাক্ত হয়।
মেহেরবানী করে সরকারের কাছে আনুগত্য দেখাইতে গিয়া নিজেদের গায়ে এই অগৌরবের কালি লাগতে দিয়েন না। জনগণের একজন হিসাবে বলতে পারি আপনাদের বিবৃতি আমাদেরকে খুবই হতাশ করেছে।
কোন সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই তাকে ডিফেন্ড করতে ছুটতে হবে কেন? আপনাদের কী সবার আগে উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে আভ্যন্তরীণ তদন্ত করে দেখা উচিত ছিল না? আপনারা কীভাবে নিশ্চিত হলেন অভিযোগ গুলো সত্যি না, মিথ্যা? খুবই দুঃখজনক! সেনাবাহিনীর মতো পেশাদার রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠান যদি কোন সংকট মোকাবিলার নুন্যতম পদ্ধতিগত দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এটাই ধরে নিতে হয় রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়ছে বা দুর্বল হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুর্বল হইলে তা আমাদের কারো জন্যই শুভ নয়। রাষ্ট্ররে বাচায়ে রাখতে হবে, কারণ ওইটাই আমাদের শেষ আশ্রয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন