মো. ইলিয়াস মাহমুদ
একটু বলে রাখি আজ থেকে মাত্র ১২০ বছরের আগে পৃথিবীর কোন ধর্মে (ইসলাম ছাড়া) মেয়েদের সম্পত্তির পারিবারিক ভাগ দেয়নি।
পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রের সংবিধানেও (মদিনার সংবিধান ছাড়া) ঘরের কন্যার সম্পত্তি নিশ্চিত করতে পারেনি।
”ইসলামের আগমনের আগে নারীর সম্পত্তির অধিকার ছিল না।
ইসলামের বাহিরে পৃথিবীর শুরু থেকে আজকে পর্যন্ত মাত্র ১৮ টি সভ্যতা এসেছে যার একটিতেও নারীর পূর্নাঙ্গ অধিকার দেয়া হয়নি। এই ১৮ সভ্যতার মধ্যে আবার অন্যতম ছিল গ্রীক সভ্যতা, যে সভ্যতায় নারীকে মানুষই মনে করা হতো না।
সভ্যতার দাবিদার ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে নারীকে পুড়িয়ে মারার আইন রদ করা হয় ১৭৩৬ সালে। বৃহৎ ভারতে স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রীকেও স্বতিদাহ প্রথার নামে পুড়িয়ে মারার বিভৎসতা বন্ধ হয় বলতে গেলে এই সেদিন ।
সারা বিশ্বের প্রগতি ও আধুনিকতা নিয়ে চিৎকাররত ব্রিটেনে নারীর অবস্থা ছিল খুবই করুণ! Married Women's Property Act : ১৮৮২ এর আগ পর্যন্ত সেদেশের আইনে নারীদের নারীর সম্পত্তি ছিল অবৈধ।
বিয়ের আগেও যদি কোনো নারী চাকরি বা অন্য কোনো কাজ করে অর্থ উপার্জন করত তাহলে তার বিয়ে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব সম্পত্তির মালিক হয়ে যেত তার স্বামী।
জার্মানী নারীদের ১৯০০ সাল, সুইস নারীদের ১৯০৭, অষ্ট্রেলীয় নারীদের ১৯১৯ সালের আগে ছিল না কোনো উত্তরাধিকার সম্পত্তি।
অথচ ইসলামের নবী, বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ‘সভ্য পৃথিবীর’ও ১৩০০ বছর আগে মরুভূমির প্রান্তে দাঁড়িয়ে উত্তরাধিকারসহ সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের কথা ঘোষণা করেছিলেন দীপ্তকণ্ঠে।
একজন পূর্ণ বয়স্ক মুসলিম নারী, তিনি বিবাহিত হন বা নাই হন, কারো সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই সম্পদের মালিক হতে পারেন, মালিকানা হস্তান্তরও করতে পারেন। রয়েছে তার মাতাপিতার পরিত্যক্ত স্পত্তিতে ন্যয়সঙ্গত অধিকার।”
বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) আজ থেকে ১৪শত বছর আগেই বলে গিয়েছেন, “উত্তরাধিকার আইন নিজে জানো ও অপরকে শেখাও, সকল জ্ঞানের অর্ধেক হল এই জ্ঞান”।
মুসলিম হাওয়া সত্ত্বেও আমাদের অনেকেরই উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। আজকের সমাজে সম্পত্তি নিয়ে যে পারিবারিক কলহ ঘরে ঘরে তা থাকতো না যদি উত্তরাধিকার আইনের বিষয়ে স্পস্ট ধারণা থাকতো ।
আমাদের সমাজে ইদানিং কিছু মানুষ বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য চাক্ষুষ দৃষ্টিতে ছেলে বাবার থেকে মেয়ের থেকে একটু বেশি সম্পদ পায় বলে সেটা নিয়ে প্রশ্ন করলেও একজন মেয়ে যে বাবার থেকে ভাইয়ের অর্ধেক, স্বামীর থেকে সারা জীবনের ভরন পোষণ এবং সম্পত্তিরও বড় একটা অংশ পায়, এর পরে বোন তার ভাইয়ের সম্পত্তি থেকেও পায়, মায়ের থেকে পায় এভাবে ৫টি যায়গা থেকে থেকে একটা মেয়ে সম্পত্তি থেকে পেয়ে থাকে ।
এতগুলো যায়গা থেকে একজন কন্যা সম্পত্তি পেয়ে থাকলেও সে কিন্তু কোথাও ব্যায় করতে বাধ্য না ।
বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তার সকল ভরণ পোষণ চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচের দায়ভার কিন্তু ছেলের, মেয়ের নয় । অথচ মেয়েটাও কিন্তু বাবার সম্পত্তি পেয়েছেন । ভাই যদি ১০ টাকা পেয়ে থাকেন বোনটা পেয়েছেন ৫ টাকা । ভাই তার সম্পত্তি থেকে বাবা মা ভাই/বোন, ভাইগ্না/ভাইগ্নি চাচা, ফুফু বা এ সম্পর্কীত যত আত্মীয় আছেন সকলের জন্য দেখভালের জন্য বাধ্য থাকলেও মেয়কে এমন সকল দায়ভার থেকে দায়মুক্তি দিয়েছেন ।
আমার এক শ্রদ্ধ্যেও শিক্ষক তার ফেসবুক পোস্টে খুব সুন্দর ভাবে নিন্মোক্ত বিষয়টা তুলে ধরেছেন
(”নিজের, স্ত্রীর, ছেলের, মেয়ের, বোনের ও ফুফুর দায়িত্ব ছেলের। সে পিতা ও মাতার থেকে পেয়েছে ২,০০,০০০/- দুই লক্ষ টাকা।
নিজের, স্বামীর, ছেলের, মেয়ের, বোন ও ফুফুর দায়িত্ব তার নেই। সে পিতা ও মাতার থেকে পেয়েছে ১,০০,০০০/- এক লক্ষ টাকা।
সকল দায়িত্ব মাথায় নিয়ে ২ লক্ষ টাকা,
কোন দায়িত্ব মাথায় না নিয়ে ১ লক্ষ টাকা।
২ লক্ষ টাকা + দায়িত্ব।
১ লক্ষ টাকা + দায়মুক্তি।
বোকা লোকেও এ হিসাব বোঝে। শুধু বোঝে না ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরা।
কোনটা সহজ ও ঝুঁকিহীন এটা বুঝতে অনেক লেখাপড়ার দরকার নেই।
সুতরাং ইসলাম মেয়েদের ঠকায়নি। দায় মুক্ত রেখেছে। তাদের শরীরের কাঠামো ভারী কাজের জন্য উপযুক্ত নয় তাই তারা ঘরে থেকে হালকা কাজ করবে।
নরম হাতে শক্ত কাজ ইট ভাঙ্গা তাদের কাজ নয়। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত কলে কারখানায়, অফিস আদালতে তাদের কাজ কখনোই নিরাপদ ছিল না, আগেও ছিল না, এখনো নাই, ভবিষ্যতেও হবে না। যারা ঐ পথ বেছে নিয়েছে তারা কেমন আছেন ১০০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে দেখুন।” )
নারীদের পূর্ণ নিরাপত্তার জন্য নারী নিয়ন্ত্রীত অফিস দরকার যেটা আরব রাষ্ট্রের অনেক দেশে রয়েছে যেখানে স্কুলের প্রিন্সিপাল নারী আয়া বুয়াও নারী ।
এছাড়া...............
পবিত্র কোরআনুল কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন: একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর সমান। আর যদি শুধু নারীই হয় দু-এর অধিক, তাহলে তাদের জন্যে ওই ত্যাজ্য মালের তিন ভাগের দুই ভাগ। আর যদি (কন্যা) একজনই হয় তাহলে সে জন্য অর্ধেক।’ (সুরা নিসা: ১১)।
স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তিতেও রয়েছে নারীর অধিকার। খ্রিষ্টান ধর্মে পিতার মৃত্যুর পর যদি তার কোনো পুত্র সন্তান জীবিত থাকে তবে কন্যা পৈতৃক সম্পত্তি থেকে কিছুই পাবে না। এ বিষয়টি প্রচলিত বাইবেলে উল্লেখ আছে। পুত্র সন্তান দু’জন হলে বড় পুত্র পাবে ছোটজনের দিগুণ। পুত্র না থাকলে সমস্ত সম্পত্তি কন্যার। কন্যা না থাকলে (মৃতের ) ভায়ের।
ভাই না থাকলে নিকটাত্মীয়র। তবুও মৃত ব্যক্তির বিধাবা স্ত্রী কিছুই পাবে না। অথচ ইসলাম স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার খুব মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
যদি কারো স্বামীর ইন্তিকাল হয় আর সে স্বামীর কোনো সন্তান না থাকে তাহলে স্বামীর সমূদয় সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ পাবেন। আর যদি স্বামীর সন্তান থাকে তাহলে স্ত্রী পাবেন এক-অষ্টমাংশ (আট ভাগের এক ভাগ)।
পবিত্র কোরআনুল কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘স্ত্রীদের জন্য তোমাদের ত্যাজ্য সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে তাহলে তাদের জন্য হবে ওই সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ।’। (সুরা নিসা: ১২)।
সন্তানদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতেও রয়েছে মায়ের অধিকার। মা জীবিত থাকা অবস্থায় সন্তানের ইন্তিকাল হলে সন্তানের যদি কোনো সন্তান-সন্ততি না থাকে তাহলে সেই সন্তানের সম্পদের এক- তৃতীয়াংশ পাবেন মা।
আর যদি মৃত সন্তানের কোনো সন্তান-সন্ততি থাকে তাহলে মা সেই (মৃত) সন্তানের সম্পত্তির একঅশষ্টমাংশ (ছয় ভাগে এক ভাগ) পাবেন।
পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেন, ‘মৃতের কোনো পুত্র থাকলে পিতা-মাতার প্রত্যেকের জন্য (সন্তানের) ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ। যদি পুত্র না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিশ হয়, তবে মাতা পাবেন তিন ভাগের এক ভাগ।’। (সুরা নিসা: ১১)। এভাবেই ইসলাম সম্পত্তিতে ও উত্তরাধিকারে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে।
অতএব উপরোক্ত বর্ণনা থেকে এটা স্পস্ট যে একজন নারী অনেক যায়গা থেকে সম্পত্তি পেলেও তিনি কোথাও সেই সম্পত্তি কারো পিছনে ব্যায় করতে বাধ্য নয় । সে সম্পত্তির একান্ত ভোগের অধিকার তার নিজের । সে যা খুশি তাই করতে পারে যাকে খুশি তা থেকে দিতে পারে ।
কিন্তু একটা ছেলে যে সম্পত্তি পারিবারিক ভাবে পায় তার জন্য তার বৃদ্ধ বাবা-মা কে যেমন দেখা শুনাসহ যাবতীয় খরচ করতে হয় একি ভাবে বোন ফুফুসহ এ সম্পর্কিত যত আত্মীয় আছে তাদের দায়ভারের দায়ীত্বও ছেলেটার উপর । যদি তারা অসহায় হয়ে পড়ে।
অনেকে বলেন যে যদি এক ছেলে এক মেয়ে হয় সেখানে কেন উভয়কে সমান সম্পত্তি দেয়া হলনা ?
ধরুন আপনি ছেলে এবং মেয়েকে সমান করেই দিলেন মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলো , শশুর বাড়ি এবং তার নিজের সন্তান নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে পেড়লেন আপনি বাবা আপনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন আপনার সকল দায় দায়ীত্ব এসে বর্তালো ছেলেটার উপর ছেলেটাকেই আপনার চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচ করতে হয় । অথচ আপনার মেয়েটাও আপনার থেকে সমান সম্পত্তি পেয়েছে কিন্তু আপনার দেখাশুনা চিকিৎসার কোন দায় দায়ীত্বই তার নেই ! কি মনে হবে তখন ? ছেলেটাকে ঠকিয়েছেন ??
আমাদের সমাজের সমস্যা হলো একটা মেয়ে পারিবারিক ভাবে যে সম্পত্তি পায়, পাওয়ার কথা মুসলিম আইন অনুযায়ী তা আমাদের পরিবার, সমাজ, এবং রাষ্ট্র তাকে বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে । তাকে ঠকিয়ে রাখে ।
সুতরাং ঐশী গ্রন্থের এই ফর্মুলার থেকে এত সুন্দর বন্টন এর আগে এবং এর পরে পৃথিবীর কোথায়ও ছিল না হবেও না ।
(তথ্য সুত্র: কুরআন হাদিস, ফিকাহ, & ইন্টারনেট)
লেখক,ব্লগার,সংবাদকর্মী : মো. ইলিয়াস মাহমুদ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন