তারেক রহমান সম্পর্কে যা শুনেছি ,শুনছি এবং যেরকম দেখেছি
================================
নব্বই সালের মাঝামাঝি সময় I প্রফেসর গোলাম আজমকে নিজের চর্ম চোখে দেখার একটা উদগ্র বাসনা আমার মনের মধ্যে জাগিয়ে দেয় আমাদের মিডিয়া । তখন তাঁর সাদা কালো ছবি দেখেছি মাত্র । কপালে চাঁদ - তারা খচিত ব্যাজ , আর ভয়াবহ ড্রাকুলারূপী মুখে দাঁড়ি ও মাথায় টুপি দিয়ে আঁকা তাঁর কার্টুন দেখতাম নিত্যদিন । । এই ছিল মোটামুটি গোলাম আজম এবং সঙ্গীদের অংকিত চেহারা । কাজেই আসল চেহারাটি দেখার মানসে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে নব্বই সালের মাঝামাঝি সময়ে মগবাজার মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে যাই । এমতাবস্থায় তাঁকে দেখে সত্যি সত্যি একটা ধাক্কা খাই । তখন ঐ মসজিদটি খুবই ছোট ছিল । দরজার সামনে থেকে ঈমামের খুতবার জায়গা মাত্র কয়েক মিটার । অনেকটা বেয়াক্কেলের মত দরজার সামনে দাড়িয়ে খুতবা পাঠরত গোলাম আজম সাবকে দেখতে থাকি । সত্যি বলতে এত শ্বেতশুভ্র চেহারা আমি এর আগে কখনোই দেখি নাই । আমাকে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনিও আমার দিকে তাকালেন , আমার মতলব বুঝতে চেষ্টা করলেন । তখন আমার খেয়াল হলো , উথাল পাতাল মন নিয়েই ভেতরে গিয়ে বসে পড়ি ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব চেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তির মধ্যে একজন গোলাম আজম হলে অন্যজন নি:সন্দেহে তারেক রহমান । এক সময়ে প্রফেসর আজম সম্পর্কে দুয়েকটা প্রশংসা সূচক বাক্য বলা এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ে খুবই দুরূহ কাজ বলে গণ্য হত । কেউ নিজের বিরাট সর্বনাশ করতে না চাইলে এমন বোকামি কেউ করতেন না । এখন তারেক রহমান সম্পর্কে অনেকটা কাছাকাছি ফ্যানোমেনা শুরু হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে মনে হয় তার চেয়েও অনেক বেশি ! নিজের দলের নেতারাই এব্যাপার মুখ খুলতে ভয় পান । সরকার পক্ষ দিনে কয়েকবার বেগম খালেদা জিয়ার ও তারেক রহমানের সাজার কথা বলেন । কিন্তু তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দিয়ে জাজ মোতাহার হোসেনকে যে দেশ ছাড়তে হয়েছে , সেই কথাটি বিএনপি নেতারা বছরে একবারও উল্লেখ করেন না । যদিও বিএনপির জন্যে এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী পয়েন্ট ।
যে সুশীল গ্রুপটি প্রফেসর আজমকে নিয়ে ভয়াবহ কার্টুন আঁকত এরাই পরবর্তিতে তারেক রহমানের মোটা গর্দান ও ফোলা গালের কার্টুন ছাপাতে শুরু করে ।উক্ত প্রপাগান্ডা বাজেটের নব্বই ভাগ খরচ করা হয় তারেক রহমানকে নিয়ে । যে পত্রিকাটি এবিষয়ে বেশি উৎসাহ দেখাত তারেক রহমানের দলের নেতা কর্মীদের ঘরে ঘরে সেই পত্রিকাটিরই বেশি দেখা মিলত , হয়তোবা এখনও তাই মিলে ।
সবকিছু নিজের চোখে কিংবা নিজের অনুভবে পরখ করে নেওয়ার এই স্বভাবটি আমার মজ্জাগত । আমার ব্যক্তিগত , পারিবারিক এবং পেশাগত জীবনেও আমি এই পলিসিটি অনুসরন করি । আমার মা-বোন সম্পর্কে আমার স্ত্রীর বর্ণনা কিংবা আমার স্ত্রী সম্পর্কে আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কোনো মন্তব্যকেও একই ভাবে পরখ করে নেই ।যাতে কারো সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টিতে সেই ব্যক্তির উপর অবিচার করে না বসি । এর ফলে আমার পরিবারে বড় কোনো জটিলতা দেখা দেয় নাই । পেশাগত জীবনেও অনেক মানুষের কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিত ভালো ব্যবহার/ আচরণ পেয়েছি যা শুনে অন্যরা অবাক হয় । আমি কান দিয়ে যা শুনি , অন্য চার ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে তা পরখ করে নেই ।
২০১৬ সালের অক্টোবরে এই অনুসন্ধিৎসু মন নিয়েই লন্ডনে যাই তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করতে । বিষয়টি আমি কখনোই পাবলিক করতে চাই নি । কারণ অনুসন্ধানটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত , খরচ সম্পূর্ণ নিজের পকেট থেকে । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ বিষয়ে কিছু না লিখলে কোথায়ও অবিচার করা হবে ।
তাই আজ চার বছর পর সেই ঘটনাটি কিঞ্চিৎ লিখছি । তখনকার একটি ছবিও সংযুক্ত করলাম ।তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পর আগে শোনা অনেক কিছুই মেলাতে পারি না । আমি এদেশের কেউকেটা কেউ নই । তারপরেও আমাকে যতটুকু সময় দিয়েছেন , আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছেন তাতে তাকে এতবড় দলের সেকেন্ডম্যান বলে মনে হয় নাই । আমি সেখানে থাকাবস্থায় দলের বেশ কয়জন সাধারণ নেতা কর্মীর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি । তাদের সকলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজেও এমন কিছু চোখে পড়ে নাই । কাজেই তারেক রহমান দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে যথাযথ সম্মান দেখান না , বিষয়টি আমার কাছে কিছুটা খটকা লাগে !
আমি চলে আসার দিন হোটেল থেকে নেমে আমাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছেন ! এমন একজন ব্যক্তি দলের সিনিয়র নেতাদের যথাযথ সম্মান দেখান না বিষয়টি আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে । এটা তার ইনবিল্ট ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না । তবে যে দলে তিন শ এমপি পদের জন্যে কমপক্ষে তিন হাজার শক্তিশালী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যান - সেখানে সকলকে সন্তুষ্ট রাখা একজন রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে কতটুকু কঠিন তা সহজেই অনুমেয় । সোনার হরিণ হাতে পাওয়া এই তিন শ জন তার প্রতি সন্তুষ্ট হলেও বাদবাকি ২৭০০ তার প্রতি রুষ্ট হবেন । এই না পাওয়াদের হাওয়া বা বাতাস দেয় বিশেষ মিডিয়া ! আদর্শ ব্যতিরেকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে এই আচরণ অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত কিছু নয় ।
আমার তিন দিন অবস্থানের অধিকাংশ সময় এসব বিষয় নিয়েই ওয়ান টু ওয়ান আলোচনা করেছি । একটা নলেজ বেইজড পার্টি ও দেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি । আমি বলেছি আমার থিওরিটিকেল কথা বার্তা । জবাবে উনি বলেছেন উনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা । সেগুলোর কিছু পাল্টা জবাব দিয়েছি । অনেকগুলির জবাব দিতে পারি নাই ।
একুশে আগষ্ট নিয়েও খুচিয়ে খুচিয়ে প্রশ্ন করেছি । ক্ষমতা গ্রহন করলে নেতা কর্মীদের এতদিনের ক্ষোভ কীভাবে সামাল দিবেন - এক পর্যায়ে সেটাও জানতে চেয়েছি । নির্বাসিত একজন নেতা যার শত শত নেতা কর্মী গুম হয়েছে, হাজার হাজার জেল খাটছে , লাখ লাখ নেতা কর্মীর মাথায় মামলা - সেই নেতার পক্ষে এমন প্রশ্নের জবাব দেয়া সত্যিই কঠিন । উনার জবাব আমার মন:পুত না হলে পাল্টা প্রশ্ন করেছি । এই সব প্রশ্ন এবং পাল্টা প্রশ্নে আমার মনে কোনো ভয় জাগে নাই যে আমি একজন ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছি ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ আর্মির একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর তারেক রহমানকে বেশ কিছু নসিহত করেছেন । তাঁর অভিযোগ , তারেক রহমান দলের বয়স্ক নেতাদের সম্মুখে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেন ইত্যাদি ইত্যাদি ।ভিডিওটি দেখে একটু খটকা খেলাম । বয়েস হিসাব করে দেখলাম উনি নিজেও তারেক রহমানের জুনিয়র হবেন । একজন সিনিয়রকে তিনি যে কিছিমে আদব শিক্ষা দিচ্ছেন , সেটিও অনেক দৃষ্টিকটু ঠেকেছে ।
আজকে যেখানে সকল জাতীয়তাবাদী শক্তির ইস্পাত কঠিন ঐক্যের প্রয়োজন সেখানে এই ধরণের একা একা গোল দেয়ার প্রবণতা কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখার বিষয় । আমরা ফ্যাসিবাদি শক্তির সার্বিক শক্তি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল না থাকার কারণেই এরকম আচরণ করছি ।
আমরা যেভাবে ফ্রি স্টাইলে একজন আরেকজনকে সমালোচনা করি , সবাই নিজেকে হিরো এবং অপরকে জিরো জ্ঞান করি তাতে এই ফ্যাসিবাদকে সরানো দুরূহ হয়ে পড়তে পারে
আমরা এখন একমত যে একটি গণ জাগরণ ও গণঅভ্ভূথ্থান ছাড়া এই ফ্যাসিবাদের হাত থেকে সহজে মুক্তি মিলবে না । তজ্জন্যে সকল মহলের বোধ আর ভাবনায় পরিবর্তন জরুরি । বড় রাজনৈতিক দলকে যেমন তার বড়ত্বের অহমিকা ও নেতৃত্ব হারানোর ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তেমনি ছোট খাট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও একা একা হিরো বনার বৃত্ত / ফ্যান্টাসি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে । একটা ফায়ার বা আগুনের জন্যে যেমন একটি স্পার্ক দরকার তেমনি সেই স্পার্ককে অক্সিজেন জোগানের জন্যে বাতাস দরকার । সেই বাতাসটি সরবরাহ করবে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলি ।
এমতাবস্থায় ব্যক্তি তারেক রহমানের একটা ভূমিকা এখনও গৌণ হয়ে পড়ে নি ।
সেই আশাবাদ থেকে মি: রহমানকে তাঁর ৫৬তম জন্ম দিনে একটা শুভেচ্ছা জানালে খুব বেশি ক্ষতি হবে না ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন