আহমেদ ফিরোজ
শফী হুজুর কেন ২০১৩ সালে হেফাজতের নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন? এটার প্রধান কারণ এই না যে তাদের মাঝে তিনি বর্ষীয়ান ছিলেন। মূল কারণ তিনি ছিলেন কওমী মাদ্রাসার মাঝে সবচাইতে সনাতনপন্থী আলেম। এটাই ছিল আলেম সম্প্রদায়ের মাঝে বাকিদের তুলনায় তার গ্রহণযোগ্যতার ও শ্রদ্ধার বাড়তি কারণ।
কওমী নিজেই তো সনাতনপন্থী বলে একে উপহাস করেছেন মাওলানা মওদুদী। তার মাঝে আবার সনাতনপন্থী কী? মওদুদী এবং অন্যান্য সংস্কারবাদী ইসলামী দল সম্পর্কেও তাদের বক্তব্য ছিল এই যে, রাজনীতি করতে গিয়ে তারা ধর্মের বহু নির্যাসকে বিনষ্ট করে ফেলে। অন্যদিকে মওদুদী মনে করতেন ধর্মের নির্যাসকে রক্ষা করতে গিয়ে এরা রাষ্ট্রটাকে আধুনিকপন্থীদের হাতে ছেড়ে দেয়। এই দুই দলের তর্কের আসল সমাজতাত্ত্বিক কারণ তো এটুকু: রাষ্ট্র বিষয়টা ধর্মীয় কাঠামোর মাঝে আর নেই, অর্থনীতির প্রসঙ্গে, নারীর প্রসঙ্গে, পারিবারিক আইনের প্রসঙ্গে এবং আরও বহু বিষয়ে তার সাথে ধর্মীয় আইনের একটা দৃশ্যমান দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই কারণেই প্রয়োজনে বিচ্ছিন্ন থেকেও, দূরত্ব তৈরি করেও নিজেদের মাঝে একটা ধর্মীয় সনাতনপন্থা তারা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। এটা অবশ্য সর্বদা সম্ভব হয়নি, পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রের ইন্ধনে শামসুল হক ফরিদপুরী ফতোয়া দিয়েছিলেন, মুসলিম লীগে ভোট না দিলে ধর্ম নষ্ট হবে। হাফেজ্জী হুজুর বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তারা তাদের সম্প্রদায়ে অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদাবান মানুষ ছিলেন। এমনি অনেক ঘটনাই মিলবে যেখানে এই দূরত্ব রক্ষা করা হয়নি। তারপরও তার আবহটা ছিল।
৯০ দশকে কওমী মাদ্রার শিক্ষার্থীরা একটা নতুন চাপের মুখোমুখি হতে থাকে। সেটা জীবিকা বিষয়ক। এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের কওমী শিক্ষার্থীরা কোন না কোন ভাবে মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে জীবিকার বন্দোবস্ত করতে পারতেন, যদিও তাদের অধিকাংশেরই দারিদ্র ছিল নিত্যসঙ্গী।
[১] মির্জাপুরে বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি, পানিবন্দী হাজারো মানুষ ≣ [১] করোনার আড়ালে ডেঙ্গু, গতবারের চেয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ গুণ বেশি ≣ [১] সরকারি নিয়ন্ত্রণে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ এর মাধ্যমে বন্ধ ঘোষিত পাটকল আবার চালু করছে সরকার
কিন্তু ৯০ দশকে বাংলাদেশের সব কিছুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধির প্রবণতার শুরু হয়, এখন তা হয়তো শব্দের বেগে ছুটছে। অথচ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তখনও অন্য পেশায় যাবার সুযোগ পেতেন বেশ কম। কারণ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বড় অংশটি এমনকি বাংলা পড়ারও সুযোগ পেতেন না। ২০০৭ সালেও লুকিয়ে বাংলা পড়ার অপরাধে মার খেতে দেখেছি একজন শিক্ষার্থীকে, ঢাকার একটি মাদ্রাসায়।
কিন্তু উলটো স্রোতও ততদিনে চালু হয়ে গিয়েছিল। কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষা দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের সনদ যোগাড় করে রাখাটা খুব চালু হয়ে গিয়েছিল। এর আগেও কেউ কেউ তা করলেও সম্ভবত বেশিরভাগই তা করতেন না।
শফী হুজুর আসলে তার এই অবস্থান নিয়ে ৬০ দশকে, অবস্থান করছিলেন। ৮-৯০ পরবর্তীতে শিক্ষা অনুযায়ী চাকরি পাওয়া মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিনতম বিষয়ে পরিণত হয়েছিল, সেই বাস্তবতা তিনি মেনে নিতে পারেননি আদৌ।
যা হোক, বলছিলাম আল্লামা শফীর কথা। তিনি ছিলেন কওমী রক্ষণশীলতার অন্যতম প্রতীক। ২০১০ সালের দিকে তার একটা সাক্ষাতকারে পড়েছিলাম, তিনি ইসলামী ব্যাঙ্ক, আল আরাফা ব্যাঙ্ক সহ যে কোন ইসলামী ব্যাঙ্কের বিরোধী। তিনি কওমী শিক্ষার্থীদের যে কোন রকম ইহজাগতিক প্রশিক্ষণের বিরোধী। তিনি ঘোরতর জামায়াত বিরোধী। কওমী শিক্ষার যে কোন সংস্কারের তিনি বিরোধী। ওই বইটাতে অন্য যে সকল আলেমের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছিল, তারা সকলেই কম বেশি সংস্কারের গুরুত্ব সম্পর্কে বলছিলেন, যেন বাংলা শিখে তারা সাংবাদিকতা করতে পারেন, কম্পিউটার শিখে কিছু আয় করতে পারেন। কিন্তু আল্লামা শফী অনুরোধ করছিলেন, যেন কওমী শিক্ষার্থীরা এই সব জাগতিক জঞ্জাল থেকে দূরে একটা স্থানে থাকতে পারেন।
ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র কওমী মাদ্রাসা থেকে কেন আর আগের মত আধ্যাত্মিক ব্যক্তি বেরিয়ে আসছেন না, এমন প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা শফী বলেন: “এটাই হবে। কিয়ামত অনিবার্য। কেয়ামতের আগে ইসলাম উঠে যাবে, দীন উঠে যাবে, সব কিছু উঠে যাবে। এটা আস্তে আস্তে হতে হবে। যদি দিন দিন আমরা আরও ভাল হই তাহলে কেয়ামত তো আর আসবে না।”
এইটাই আসলে ছিল শফী সাহেবের অন্যতম একটি আধ্যাত্মিক চেতনা। যদি সংসারের কাজকর্ম থেকে দূরে রাখা একদল মানুষ থাকে যারা দীনের চর্চা করছেন, কিয়ামত হবে না। কওমী মাদ্রাসার সাথে দুনিয়াবি মিলিয়ে দিলে কিয়ামত অনিবার্য হয়ে উঠবে।
নারী প্রশ্ন এবং ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারের কারণে ধর্মীয় আইনে হস্তক্ষেপের বিষয়গুলো বাদ দিলে শফি হুজুর তাই প্রধানত রাজনীতির বাইরেই থাকতেন। এছাড়া, এর আগে অন্যান্য যে সব মাদ্রাসা রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিল, সেগুলোর পরিনাম ভালো হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের মত কিংবদন্তী, কিংবা মুফতি আমিনীর উত্তরাধিকাররা মারামারি ও দলাদলিতে নিজেদের মর্যাদাকে নামিয়ে এনেছেন। রাজনীতি মানেই ক্ষমতা, অর্থ, রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ, বিত্তের লোভ, অনুগত মাদ্রাসাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার, শিক্ষার্থীদের লাঠিয়াল হিসেবে মাঠে নামানো, গোয়েন্দা সংস্থা এবং নানান আরও বহু ঘটনা।
সেই শফি হুজুর এমন ঘোরতম দুর্যোগে পতিত হলেন, হুবহু একই কারণে। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আর কেউ বোধ হয় হননি, এবং বাকিদের মত মৃত্যুর পর নয়, জীবদ্দশাতেই তিনি এই অবমাননা সহ্য করে গেলেন। হুবহু একই কারণে, আরও ঘনীভূত আকারে– রাষ্ট্র, অর্থ, বিত্ত, যোগাযোগ, ক্ষমতা। কারণ হাটহাজারীর মত বিশাল একটা মাদ্রাসা যে সম্ভাব্য রাজনৈতিক ক্ষমতার, জমায়েতের কেন্দ্র হবার মত সম্ভাবনাময়, তাকে অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা বানাবার কাজে ব্যবহার না করার লোভ উপেক্ষা করা কঠিন।
দেওবন্দী ঘরানার শুরু থেকেই ধর্মীয় জীবনের নেতা হবার উপযুক্ত করে যাদের গড়ে তোলা হচ্ছে,তাদের পেশাগত প্রশিক্ষণ দেয়া হবে কি না, সেটা নিয়ে বিতর্ক ছিল। দুই ধারায় তারা চলেছেন, পরস্পরের প্রতি মোটামুটি সম্মান বজায় রেখেই। আশরাফ আলী থানভীরা বাস্তব বিবেচনাবশতঃ জীবিকা হিসেবে কোন কাজের প্রশিক্ষণের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু অধিকতর মর্যাদাবান ওস্তাদরা তা ছিলেন না।
আপাতত হাটহাজারীর সর্বশেষ বিবাদে এই সবের কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। কিন্তু দেখার বিষয় এই যে, বাকি দুনিয়াকে একদিকে ঠেলে রাখা আল্লামা শফী যে শক্তিটি, কওমী জগতে যে মর্যাদার আসনটি গড়ে তুলেছিলেন, কিভাবে সেটির বাণিজ্যিক মূল্যের সম্ভাবনা অন্তিম বয়েসে পুত্র-পরিজনের ক্ষমতার লোভের বাহন হয়ে তাকে নিজ সমাজেই কোন অধঃপাতে টেনে নিয়ে গেলো।
দেওবন্দ মাদ্রাসা রাষ্ট্রের এখতিয়ারের বাইরে থাকার জন্য যথাসম্ভব সব কিছু করার চেষ্টা করতো। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য অধিকাংশ রাজনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় মাদ্রাসাগুলো বলা যায় রাষ্ট্রীয় নানান সংস্থার একটি মৃগয়া ক্ষেত্র।আস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন