শরিফুল হাসান
প্রাথমিক শিক্ষা সনদ অনুযায়ী উম্মে কুলসুমের বয়স ১৪ বছর। সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে পাঠাতে হলে নূন্যতম ২৫ বছর বয়স হতে হয়। তাই পাসপোর্টে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার বয়স ২৫ করা হয়েছিল। দেড় বছর পরই লাশ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরেছে মেয়েটি।
গত ৯ আগস্ট সৌদি আরবের কিং ফয়সাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ১২ সেপ্টেম্বর তার মরদেহ দেশে পৌঁছে। তার স্বজনের দাবি, কুলসুম যে বাড়িতে কাজ করতো সেই বাড়ির নিয়োগকর্তা ও তার ছেলে মেরে দুই হাত-পা ও কোমর ভেঙে দিয়েছে। একটি চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। তারপর ওই অবস্থায় রাস্তায় ফেলে গেছে। সৌদি পুলিশ সেখান থেকে কুলসুমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
কুলসুমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার গোকর্ণ ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামে। শহিদুল ইসলাম ও নাসিমা বেগমের তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে কুলসুম দ্বিতীয়। কুলসুমকে নিযার্তনের বিষয়টি উল্লেখ করে নাসিরনগর থানায় একটি মামলা করেছে পরিবার। সেই সঙ্গে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) বিএমইটিতে লিখিত অভিযোগ করেছে।
২০১৭ সালে প্রাথমিক নূরপুর লাহাজুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয় কুলসুম। সনদপত্র অনুযায়ী, তার জন্ম ২০০৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর। পরিবারও বলছে ২০০৬ সালেই জন্ম মেয়েটির। কিন্তু তার পাসপোর্টে জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয় ১৯৯৩ সালের ১৩ মার্চ।
কুলসুমের পরিবার জানায়, বিদেশে পাঠানোর জন্য এজেন্সি ও দালাল মিলে পাসপোর্ট বানায়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে যে জন্ম সনদ দেওয়া হয়, তাতেও তার জন্ম সাল ১৯৯৩ দেখানো হয়। এর ভিত্তিতেই পাসপোর্ট করা হয়। প্রতিবেশী রাজ্জাকের কথায় ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকার ফকিরাপুলের মেসার্স এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে গৃহকর্মীর কাজ দিয়ে কুলসুমকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। সৌদি আরবে যাওয়ার পর থেকেই মালিকপক্ষ কুলসুমকে শারীরিক নির্যাতন করতো। স্থানীয় দালাল রাজ্জাককে সে কথা জানিয়ে কোনো ফল পাওয়া যায়নি। পুলিশের কাছে গিয়েও প্রতিকার মেলেনি।
গত ১৭ আগস্ট ঢাকায় জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালকের কাছে একটি অভিযোগ দেয় কুলসুমের পরিবার। তাতে বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে কুলসুম। মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য বারবার যোগাযোগ করা হলেও এজেন্সি সাড়া দেয়নি। এরপর তারা জানতে পারেন, যে বাড়িতে কাজ করতো সেই বাড়ির নিয়োগকর্তা ও তার ছেলে এপ্রিল মাসে মারধর করে কুলসুমের দুই হাত-পা ও কোমর ভেঙে, একটি চোখ নষ্ট অবস্থায় তাকে রাস্তায় ফেলে গেছে। তিন মাস পর গত ৯ আগস্ট সৌদি আরবের কিং ফয়সাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কুলসুমের মৃত্যু হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর মেয়ের মরদেহ পেয়েছে কুলসুমের পরিবার।
কুলসুমের মা নাসিমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে গণমাধ্যমকে বলেছেন, রমজান মাসের শেষ রোজার দিন দুপুরে ফোন করে তাদের জানানো হয়, কুলসুম হাসপাতালে। তারা তখন জানতে পারেন মালিকের খারাপ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মারধর করে ফেলা রাখা হয়। এরপর কোরবানি ঈদের পরদিন মেয়ের সঙ্গে হাসপাতালে শেষ কথা হয়। তখন পরিবারের কাউকে চিনতে পারেনি কুলসুম। কারও কথার উত্তর দিতে পারেনি।
এমন কুলসুম একজন না! বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ র্পযন্ত চার বছরে বিভিন্ন দেশ কাজ করতে যাওয়া ৪১০ নারী লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই প্রাণ হারিয়েছেন ১৫৩ জন। এ ছাড়া, র্জডানে ৬৪ জন, লেবাননে ৫২ জন, ওমানে ৩৮ জন, দুবাইয়ে ২৩ জন এবং কুয়েতে ২০ জন মারা গেছেন। অন্যান্য দেশ থেকে এসেছে ৬০ নারীর মরদেহ। এই ৪১০ জনের মধ্যে ৬৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। শুধু সৌদি আরবেই আত্মহত্যা করেছেন ৩৯ জন। আত্মহত্যা ছাড়াও গত চার বছরে ৬৯ নারী দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে নথিতে বলে হয়েছে। যার মধ্যে সৌদি আরবেই মারা গেছেন ২৯ জন।
পরিবারগুলো বলছে, প্রতিটি মৃত্যুতেই কোনো না কোনো কিন্তু আছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন বেগম। সৌদি থেকে কীভাবে মিশরে গিয়ে তিনি মারা গেলেন সেই রহস্যের সমাধান হয়নি।
মিশরের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জানানো হয়, ২৯ মে মিশরে ৫ তলা থেকে পড়ে মোসাম্মৎ বেগম নামে এক নারী গৃহকর্মী মৃত্যুবরণ করেন। বেগমের স্বামী আব্দুল আজিজ বলেন, বেশ কিছু দিন আগে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জানতে পারেন, বেগম নামে এক নারী মিশরে মারা গেছেন। কিন্তু তার স্ত্রী সৌদি আরবে থাকায় তিনি বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি। এরপর মিশর থেকে যখন তাকে ফোন করা হলো, তখন বুঝতে পারেন তার স্ত্রী মিশরে মারা গেছেন।
বিএমইটি’র তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আট লাখেরও বেশি নারী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অর্থাৎ তিন লাখই গেছেন সৌদি আরবে। মূল সংকটটা সেখানেই।
ঠিক নয় বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরব যখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী চায় তখন এ ঘটনা নিয়ে ২০১১ সালের ৭ মে ‘সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো নিয়ে উদ্বেগ, কয়েকটি দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা, সরকারের নিরাপত্তার আশ্বাস শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম।
ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের কারণে এই দেশগুলো যখন তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে দেশটি।
ওই প্রতিবেদনের পর নারীদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি বন্ধ না হলেও কিছুটা গতি হারায়। ততদিনে কেটেছে আরও চার বছর। ২০০৯ থেকে ২০১৫। ছয় বছর ধরে সৌদি আরবে পুরুষ কর্মী পাঠানো বন্ধ। বাংলাদেশ বারবার অনুরোধ জানাচ্ছে শ্রমবাজার চালুর কিন্তু সৌদি আরব সাফ জানিয়ে দিলো বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী দিতে হবে। নয়তো বাজার খুলবে না।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ে উপমন্ত্রী আহমেদ আল ফাহাইদের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। এবার তারা নারী শ্রমিকদের নেবেই। শ্রম বাজার চালুর জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করল বাংলাদেশ। সে দিনও এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা তুলে ধরে লিখেছিলাম।
ওই চুক্তির পর ২০১৫ সালে গেলেন ২১ হাজার নারী শ্রমিক। ২০১৬ সালে গেলেন ৬৮ হাজার। ২০১৭ সালে ৮৩ হাজার, ২০১৮ সালে ৭৩ হাজার, ২০১৯ সালে ৬২ হাজার। সৌদি আরবে গিয়ে এই নারীরা কেমন ছিলেন?
সংসারে সচ্ছলতা আনার আশায় কুড়িগ্রাম থেকে যাওয়া এক নারী সৌদি আরবে গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। পরে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নেন রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে। দুই মাস পর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
দেশে এসে ঢাকার উত্তর বাড্ডার আরেক নারী বলেন, যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, ওই বাসার পুরুষেরা তাকে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করতো। প্রতিবাদ করলে তার চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হতো। মানিকগঞ্জের এক নারী বলেছেন, সৌদি আরবের বনি ইয়াসার এলাকায় কাজ করতেন তিনি। নির্যাতনের কারণে চার তলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। পরে তার স্থান হয় হাসপাতালের আইসিইউতে। কুমিল্লার এক নারীকে নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়, ১৪টি সেলাই লাগে। গত বছর সৌদি আরব থেকে জীবন বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছিলেন সুমী আক্তার। পরে তাকে উদ্ধার করে দেশে আনা হয়। গত বছর এভাবে আড়াই হাজার মেয়ে দেশে ফিরেছে। ২০১৮ সালে ফিরেছে এক হাজার ৬৫৬ জন।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে গত বছরের আগস্টে একটি প্রতিবেদন পাঠায় মন্ত্রণালয়। তাতে সৌদি আরব ফেরত ১১০ নারী গৃহকর্মীর তথ্য দিয়ে বলা হয়, ৩৫ শতাংশ নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো না।
দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মন্ত্রণালয় তাদের ফিরে আসার ১১টি কারণ চিহ্নিত করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে ফিরে আসা নারীদের মধ্যে ৩৮ জন শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৪৮ জন নিয়মিত বেতনভাতা পেতেন না। এ ছাড়া, অন্তত ২৩ জনকে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না।
গত বছর সৌদি আরবের সঙ্গে যৌথ কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ নিপীড়নের বিষয়টা তুলে ধরে। সৌদি আরবও আশ্বাস দেয় বরাবরের মতো। মন্ত্রণালয় ১২ দফা নির্দেশনা দেয়। কিন্তু কুলসুমদের মৃত্যু বন্ধ হয়নি।
কোনো কোনো সময় কর্তা ব্যক্তিরা বলেন, এই যে তিন লাখ নারী সৌদি আরবে গেল তার মধ্যে মাত্র তো আট-নয় হাজার ফিরেছে। বাকিরা নিশ্চয়ই ভালো আছে। ভালো আছে কি না সেটা আসলে জানা যায় না। কারণ সৌদি আরবের সেই বাড়িগুলোতে যাওয়ার অধিকার কারও নেই। আর এই যে শতাধিক নারী মারা গেল, কেন একটি ঘটনায় সৌদি আরবের নিপীড়নকারীদের শাস্তির আওতায় আনা গেল না!
হ্যাঁ, এটা তো সত্যি অনেক নারী হয়তো ভালো আছেন। কিন্তু যারা নির্যাতিত হয়ে ফিরছেন তাদের কী হবে? যারা মারা গেলেন? মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তো সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না। সৌদি আরবে যদি একটি মেয়েও নির্যাতিত হয়ে কাঁদে, সেই কান্না কি পুরো বাংলাদেশের নয়? এই কান্নার শেষ কোথায়? এজেন্সিগুলো কবে দায়িত্বশীল হবে? রাষ্ট্র কী করেছে? এই যে ১৪ বছরের একটা মেয়ের বয়স ২৫ হয়ে যায়, আমাদের পাসপোর্ট অধিদপ্তর, পুলিশ, রিক্রুটিং এজেন্সি, বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ কেউ দেখে না? আর কত কুলসুমের মৃত্যুতে টনক নড়বে আমাদের?
শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
পাঠক মন্তব্য
সৌদি আরবে যদি একটি মেয়েও নির্যাতিত হয়ে কাঁদে, সেই কান্না কি পুরো বাংলাদেশের নয়? এই কান্নার শেষ কোথায়?
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন