দুই বাংলা ভাই ভাই। দুটো বাংলাই আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তা অবিকল একই ব্যবহার। হিন্দু মুসলমানে ঝগড়া লড়াই হয়, পূর্ব পশ্চিম ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু আমার ব্যপারে পূর্ব আর পশ্চিমের চিন্তাভাবনা এক, সিদ্ধান্ত এক, তারা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
একসময় বাংলার পূর্ব পারে আমার জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁতো, মানুষ দূর দূর শহর থেকে আমাকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে আসতো। এক বইমেলাতেই কুড়ি পঁচিশ হাজার বই বিক্রি হয়ে যেত। প্রকাশকদের অগ্রীম রয়্যাল্টি রেখে কূল পেতাম না। সেই দেশে হঠাৎ শুনি ধর্মান্ধরা ফুঁসছে, ধর্মান্ধরা তো ফুঁসবেই, আমি যে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লিখি।
এরপর শুনি পুরুষতান্ত্রিকরা ফুঁসছে। এর পেছনেও যুক্তি আছে, আমি নারীর সমানাধিকারের পক্ষে কথা বলি, ওরা ফুঁসবেই। এরপর শুনি শিল্পী সাহিত্যিকরা ফুঁসছে। ও বাবা, তা কেন ? আমি তো দেশের একটিও পুরস্কার পাইনি, প্রতাপশালী প্রভাবশালী কারো সঙ্গে ওঠা বসা নেই। বইও ব্যান করে দেয় সরকার। তাহলে রাগটা কেন? বই বিক্রি হতো বলে?
সে তো অতীতে, এখন তো বই ছাপাও হয় না, বিক্রিও হয় না, তাহলে এখনও ফুঁসছে কেন? আত্মজীবনীতে সত্য কথা লিখেছি বলে? তাহলে ২/১ জন ফুঁসলেও ফুঁসতে পারে, সবাই কেন? ২৫ বছর হয়ে গেল দেশ থেকে বের করেছে সরকার, আমার অনুপস্থিতিতে যে যার খুশিমতো আমার বিরুদ্ধে রাশি রাশি মিথ্যে লিখে কাগজ বিক্রি করেছে।
আমাকে নিষিদ্ধ করেছে সর্বত্র। দেশের চেহারাও এর মধ্যে পালটে গেছে। মেয়েদের মাথায় হিজাব উঠেছে, পুরুষের কপালে নামাজের কালো দাগ পড়েছে। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, পুরুষতন্ত্র, নারীবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা এখন দেশের সম্পদ। এই দেশে নিষিদ্ধ হওয়াও বোধহয় বড় এক প্রাপ্তি।
পশ্চিমবঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছে। তুমুল জনপ্রিয় আমি। আমার নাম মুখে আনা মানে জাতে ওঠা। তারপর সরকার বলা নেই কওয়া নেই রাজ্য থেকে তাড়ালো আমাকে। অত্যন্ত অন্যায় আচরণ করলো। তছনছ করে দিল বাংলায় বাস করার আমার সব স্বপ্ন। ব্যস অমনি এক তুড়িতে জনপ্রিয়তা হাওয়া হয়ে গেল। আমার নাম মুখে আনলে এখন জাত যায় লোকের।
কেউ কেউ বলে এক প্রখ্যাত সাহিত্যিক নাকি আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়াবার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, বড় রাজনীতিক এবং বড় প্রকাশক শুধু মঞ্চে এসে অভিনয় করে গেছেন। কিন্তু আমি তো বড় কোনও পুরস্কার পাইনি। সাহিত্য একাডেমি, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ইত্যাদি কিছুই তো পাইনি, তাহলে রাগ কেন? সাহিত্যিকদের শখের রাগ! মাঝে মাঝে লোকে যখন আমার উদ্দেশে বলে, 'ও তো কোনও সাহিত্যিকই নয়', তখন বেশ স্বস্তি পাই। সাহিত্যিক নই বলে সাহিত্যিকের ওইসব শখের রাগও নেই আমার। আমি যে কতকিছু থেকে মুক্ত!
কেউ কেউ আবার বলে দেশে পুরস্কার না পেলেও বিদেশ থেকে কত পুরস্কার পেয়েছি! সেইজন্য রাগ? কিন্তু বিদেশ তো স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছি আমি। যোগাযোগও সব বন্ধ করে দিয়েছি। বিদেশে পুরস্কার পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই এখন। আমি তো সেইখানে এসে নোঙর ফেলেছি, যেখানে আমি নিষিদ্ধ। সেইখানে এসে থেমেছি যেখানে পায়ের তলায় কোনও মাটি নেই । আমার এত পতন, এত না-পাওয়া তাদের তো অন্তত খুশি করতে পারে!
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন