রাকিবুল হাসান:
বর্তমানে সবচে বেশী ব্যবহৃত সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম—ফেসবুক। এপ্রিল, ২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী মাসে ২.৬ বিলিয়ন মানুষ লগইন করছে এই প্লাটফর্মে। এভারেজ দৈনিক লগইন করছে ১.৭৩ বিলিয়ন মানুষ। ফেসবুক ব্যবহারকারী বিশাল এই জনগোষ্ঠীর সবাই কিন্তু কল্যান এবং ভালোবাসা ছড়াতে প্লাটফর্মটি ব্যবহার করছে না। বরং অনেকেই এটি ব্যবহার করছে বর্ণবাদ, ইসলামফোবিয়া, ভায়োলেন্স এবং জাতিগত ঘৃণা ছড়াতে। পোস্টে, কমেন্টে, মেসেজে, ছবিতে, মিমসে, ভিডিওতে—তারা জাতিগত ঘৃণা উসকে দিচ্ছে। ইসলামফোবিয়ার বিস্তার ঘটাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ইসলামফোবিয়া ইন্ডাস্ট্রি। এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে বিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার।
ফেসবুকে কিভাবে ইসলামফোবিয়া ছড়াচ্ছে তার একটা চিত্র তুলে ধরা হবে এই লেখায়। পাশাপাশি এর কারণ, কার্যকরণ নিয়েও আলোচনা করা হবে।
ডা. ইমরান আওয়ানের রিসার্চ
বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং ইসলামফোবিয়া ও সাইবার বিদ্বেষ বিশেষজ্ঞ ডা. ইমরান আওয়ান ফেসবুকে ইসলামফোবিয়া বিষয়ে একটি রিসার্চ করেছিলেন। তিনি ১০০টি ফেসবুক পেজের পোস্ট, কমেন্ট পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এই ১০০টি পেইজে তিনি অন্তত ৪৯৪টি পোস্ট পেয়েছিলেন, যে পোস্টগুলো সরাসরি মুসলিমদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। ইসলামফোবিয়া ছড়ানো হয়েছে। শুধু বিরুদ্ধ মতামত নয়, বরং অনেক পোস্টে মুসলিমদের শারীরিক হুমকিও দেয়া হয়েছে। এসমস্ত পোস্টে মোট পাঁচটি বিষয়কে হাইলাইট করা হয়েছে।
১. মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে ভায়োলেন্ট এবং নন-ভায়োলেন্ট মুসলিমের কোনো পার্থক্য করা হয়নি। বরং ঢালাওভাবে তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
২. মুসলিমদের ধর্ষক এবং সিরিয়াল রেপিস্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে।
৩. মুসলিম মহিলাদেরকে সুরক্ষার হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, বোরকা, হিজাব এবং পর্দা সুরক্ষার জন্য হুমকি।
৪. বুঝানো হয়েছে—মুসলিম এবং আমাদের মাঝে যুদ্ধ চলে আসছে। তারা আমাদের শত্রু। আমাদের ভূমি দখলকারী।
৫. এখানে মুসলিমদেরকে নির্বাসিত করার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি হালাল ফুড নিষিদ্ধকরণ, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে মুসলিমদের ওপর বাজে মন্তব্য করা হয়েছে।
ডা. ইমরান আওয়ান তার রিসার্চে মোট পাঁচটি টেবিল তৈরী করেছিলেন। ৩ নং টেবিলে দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামফোবিয়া ছড়ানোর ক্ষেত্রে নারীদের তুলনায় এগিয়ে পুরুষরা। পুরুষ ৮০% এবং নারী ২০%। ৪ নং টেবিলে দেখা যায়, ফেসবুকে ইসলামোফোবিয়া ছড়ানোয় প্রথমে রয়েছে যুক্তরাজ্য (৪৩%)। তারপর আমেরিকা (৩৭%)। তারপর অস্ট্রেলিয়া (২০%)।
১ নং টেবিলে ডা. আওয়ান ২০টি শব্দ উল্লেখ করেছেন। এই শব্দগুলো মুসলিমদের চিত্রিত ইসলামফোবিক গোষ্ঠী ব্যবহার করে। তারমধ্যে অন্যতম হলো—মুসলিম, ইসলামিক, পাকি, গ্যাং, রেপিস্ট, এশিয়ান, ডার্টি, মসজিদ, বোমা, চরমপন্থী, হালাল, সন্ত্রাসী, কিলিং ইত্যাদি।
ডা. ইমরান আওয়ান বিভিন্ন পেজের ইসলামফোবিক মিমস দিয়েও উদাহরণ দিয়েছেন। একটি মিমসের টেক্সট ছিলো—’বয়কট হালাল ফুড; যদি আপনি হালাল ফুড ক্রয় করেন, ধরা হবে আপনি ইসলামিক জিহাদকে সমর্থন করছেন।’ একটা মশলার প্যাকেটে পাগড়ি পড়া একজনের ছবি দিয়ে তৈরী করা হয়েছে আরেকটি মিমস। তার টেক্সট—’মিস্টার পাকি।’ ‘ব্যান ইসলাম ইন অস্ট্রেলিয়া’ ফেসবুক পেইজের একটি মিমসের নীচে কমেন্ট ছিলো—’ইসলাম ইবোলা ভাইরাসের মতো।’ ‘ইসলাম ক্যান্সারের মতো।’ ‘ইংলিশ ব্রাদারহুড’ ফেসবুক পেইজে একটি মিমস শেয়ার করা হয়েছে। ছবিতে দুটি কুরআন। একটির নিচে লেখা—ইসলামিক কুরআন। আরেকটির নিচে লেখা—আইএসআইএস কুরআন।
ফ্যাক্ট চেকিং সার্ভিস স্নোপেস ফেসবুকে ইসলামোফোবিয়া নিয়ে একটি তদন্ত করেছিল। তদন্তে আমেরিকার ২৪টি ফেসবুক পেজের সন্ধান পেয়েছে তারা। খৃস্টানদের ছোট একটি দল এই পেইজগুলোর মাধ্যমে মুসলিমবিরোধী ঘৃণা ছড়ায়। এই পেইজগুলোর পেছনে অর্থায়ন করে ‘দ্য আমেরিকা কনজার্ভেন্সি’ এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, খৃস্টান ধর্ম প্রচারক কেলি মনরো কুলবার্গ। এই পেইজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো— Women for trump, Christians for trump, Evangelical for trump।
ফেসবুক ইন্ডিয়া : ইসলামফোবিয়া
একটি মানবাধিকার ও প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান ইউজারদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বিশ্লেষণ করেছিল। তাতে দেখা গেছে ভারতের ফেসবুকে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ৩৭ শতাংশই ইসলামোফোবিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এরমধ্যে ১৬ শতাংশ ভুয়া খবর, ১৩ শতাংশ হিংসাত্মক বক্তব্য। দীর্ঘ চারমাস ভারতের ছয়টি ভাষার হাজারের অধিক পোষ্ট বিশ্লেষণ করে তারা এই তথ্য প্রদান করে।
‘ফেসবুক ইন্ডিয়া: টুওয়ার্ডস দ্য টিপিং পয়েন্ট অফ ভায়োলেন্স ক্যাস্ট অ্যান্ড রিলিজিয়াল হেট স্পিচ’ শীর্ষক মার্কিন-ভিত্তিক ইক্যুয়ালিটি ল্যাবসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামোফোবিয়ার বাইরে অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর হার মাত্র ৯ শতাংশ। যেখানে ইসলামোফোবিয়ার হার ৩৭ শতাংশ।
সর্বশেষ দিল্লিতে তাবলীগ জামাতের নিজামুদ্দিন মারকাজে তাবলীগের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামফোবিক পোস্ট এবং কমেন্টের হার বেড়ে গেছে। করোনার শুরুতে সমাবেশ আয়োজন করেছিল নিজামুদ্দিন মারকাজ। সমাবেশে অংশ নেয়া অনেকের পরবর্তীতে করোনা পজেটিভ আসে। এরপর থেকেই শুরু হয় মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা। তৈরী হয় #করোনা_জিহাদ এবং #নিজামুদ্দিন_ইডিয়টস। বিদ্বেষী প্রচারণার স্রোতে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ভুয়া খবর।
ভুয়া খবর যাচাই করে দেখে এমন একটি ওয়েবসাইট ‘অল্ট নিউজ’। অল্ট নিউজের সম্পাদক প্রতীক সিনহা বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তারা দুটি ভুয়া খবর যাচাই করে দেখেছে। ১. একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মুসলিমরা প্লেট চেটে খাচ্ছে। ভিডিওটি শেয়ার করে কেউ কেউ লিখেছে—এভাবেই মুসলিমরা করোনা ছড়াচ্ছে। অথচ এটি বোহরা মুসলিমদের একটি খাবার রীতি। খাবার পর প্লেটে যেন অবশিষ্ট কিছু না থাকে, তাই তারা চেটে খায়। ২. একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মুসলিমরা মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করছে। ভিডিও শেয়ার করে লেখা হয়, ‘হাঁচি দিয়ে মুসলিমরা করোনা ছড়াচ্ছে।’ অথচ তারা হাঁচি নয়, বরং যিকির করছিলো। নিজামুদ্দিনে তাবলীগের সমাবেশের পরই মূলত এসব ভুয়া খবর ছড়াতে থাকে।’
ফেসবুক বাংলাদেশ : ইসলামফোবিয়ার চিত্র
বাংলাদেশে ইসলামোফোবিয়া ছড়ানোর সবচে সুলভ মাধ্যম এখন ফেসবুক। পোস্ট, কমেন্ট, মেসেজ, মিমস, ভিডিওর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ছড়ানো হচ্ছে জাতিগত ঘৃণা, বিদ্বেষ, ইসলামোফোবিয়া। প্রযুক্তির কল্যানে এই ঘৃণা-সংস্কৃতি ছড়ানোর পেছনে অমুসলিমরা যেমন কাজ করছে, তেমনি দুঃখজনক হলেও সত্যি, নামধারী কিছু মুসলমানও শামিল হয়েছে এই মিছিলে।
বাংলাদোশের ইসলামফোবিকরা কমন কিছু বিষয় নিয়ে সবসময় হৈচৈ করে। নিম্নে কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো।
এক. হজরত মুহাম্মদ সা.
ফেসবুকে প্রায়শই আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ সা.-কে নিয়ে কটূক্তি করা হয়। অনেকক্ষেত্রে পাড়ার হিন্দু ছেলেটাও কটূক্তি করতে কসুর করে না। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ভোলায় বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য নামে এক হিন্দু ছেলে রাসূল সা.কে কটূক্তি করে লেখা মেসেজ মেসেঞ্জারে ছড়িয়ে দেয়। প্রতিবাদে জেগে উঠে তৌহিদি জনতা। ভোলার বুরহানুদ্দিনে প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় ৪ মুসলিম।
প্রথমে একে ফেইক বলা হলেও এখনো পর্যন্ত এটি প্রমাণ করা যায়নি। ধর্ম অবমাননার দায়ে অনেকে গ্রেফতার হয়, অনেকে হয় না। তবে এই গ্রেফতার করা নিয়েও সুশীলদের চুলকানি হয়। একজন তো বলেই ফেলেছে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানে এমন হতো। এখন পূর্বপাকিস্তানেও ঘন ঘন হচ্ছে।’বাংলাদেশে ফেসবুকে হজরত মুহাম্মদ সা.কে কটূক্তি করার ঘটনা ভুরি ভুরি। অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে।
দুই. ইসলামি ব্যক্তিত্বদের আক্রমণ
বিভিন্ন মিমসে ইসলামি ব্যক্তিত্বদের নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়। কটূক্তি করা হয়। হেয় করা হয়। ২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ‘থাবা বাবা রিলোডেড’ পেইজে আল্লামা আহমদ শফিকে রাজাকার বলে ট্যাগ দেয়া হয়।
‘চক্রধার চৌধুরী’ নামের আইডি থেকে হজরত মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর মাহফিলের পোস্টার শেয়ার করে হুরদের নিয়ে টিপ্পনি কাটা হয়।
‘প্রান্ত দে’ আইডি থেকে শেয়ার করা একটি মিমসে হুজুর এবং কুরআন নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়।
‘ডাকসু মিমস’ পেইজে মুফতি কাজি ইবরাহিমকে উগ্রবাদী ট্যাগ দিয়ে এবং কোটা আন্দোলনের রাশেদ খানকে সীমিত পরিসরে উগ্রবাদী মুফতি ইবরাহীম ট্যাগ দিয়ে একটি মিমস শেয়ার করে।
‘ক্বারী সাহেব ৪.০’ পেইজে সদ্যপ্রয়াত মাওলানা যুবায়ের আহমাদ আনসারীকে নিয়েও মিমস শেয়ার করা হয়। অপারেশনের কারণে তার মুখে তৈরী বক্রতাকে তুলনা করা হয় মালালা ইউসুফ জাইয়ের মুখ ভেঙচির সাথে। পাশাপাশি এখানেও অশ্লীল ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
‘বাংলা মিমস’ পেইজে ব্যঙ্গ করা হয় মাওলানা যুবায়ের আহমাদ আনসারীর জানাযায় অংশ নেয়া মুসল্লিদেরও। মিমসের টেক্সটে বলা হয়, ‘লকডাউনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জানাযায় অংশ নিয়ে মানুষ এগুলো পেতে পারে?
তিন. মুসলিমদের সন্ত্রাসী ট্যাগ
‘ক্বারী সাহেব ৪.০’ পেইজে একটি মিমস শেয়ার করা হয়েছে। তাতে প্রবলেম হিসেবে দেখানো হয়েছে পাঁচটি জিনিস। নাস্তিক, মুক্তমানা, বিজ্ঞান, সমকামী, লিঙ্গসমতায় বিশ্বাসী। সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখানো হয়েছে একটি ছবি। মেয়েটির মাথায় টুপি, হাতে দেশীয় অস্ত্র, মুখে রক্ত।
‘বাংলা মিমস’ পেইজে ২৫ মে ঈদুল ফিতরের দিন একটি মিমস শেয়ার করা হয়েছে। সেখানেও কৌশলে মুসলিমদের সন্ত্রাসী বলা হয়েছে।
‘কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বাংলাদেশ’ পেইজে ভারতভাগের জন্য মুসলিমদের দায়ী করেছে। বলেছে, মুসলিমরা দেশভক্ত হলে পাকিস্তান হতো না, বাংলাদেশ হতো না। শুধু মুসলিম নয়, প্রাকরান্তরে এখানে বাংলাদেশের জন্মকেই অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে।
চার. ইসলামের বিভিন্ন বিধান, জায়গা নিয়ে ঠাট্টা
‘ডাকসু মিমস’ পেইজ থেকে ‘ক্যাম্পাসে মেট্রোর স্টেশন চাই না’ আন্দোলন নিয়ে একটা মিম শেয়ার করা হয়েছিল। সেখানে ইসলামের বিখ্যাত ‘মুতার যুদ্ধ’ নিয়া ফান করা হয়েছে। মূলত মুতার যুদ্ধের সাথে টিএসসিতে স্টেশনের কোন সম্পর্ক নেই। ‘মুতা’ নামটাকে ফানি সেন্সে ব্যবহার করতে, সাথে মুসলিমদের চটাতে এই কনটেক্সটা ব্যবহার করা হয়েছে। আরেক কারণ হলো—টিএসসিতে মেট্রোর স্টেশন হলে বাইরে থেকে লোকজন এসে পেশাব করে বা মুতে পুরা টিএসসি ভাসিয়ে ফেলবে। তাই এটাকে ‘মুতার যুদ্ধ’ ট্যাগ দিয়ে ইসলামের যুদ্ধের জায়গার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এটা ইসলামের প্রতি বিরুপ একটা মিম।
‘সুষুপ্ত পাঠক ‘ আইডি থেকে একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, রমজানে উন্মুক্তভাবে খাবার বিক্রি করায় খাবার ভ্যানওয়ালাকে পুলিশ শাসাচ্ছেন। সুসপ্ত পাঠক তাকে ‘শরীয়া পুলিশ’ বলে ঠাট্টা করেছেন।
‘ক্বারী সাহেব ৪.০’ পেইজে কম বয়েসে বিয়ে নিয়ে ঠাট্টা করে একটি ছবি শেয়ার করা হয়েছে। ছবিটিতে এডিট করে যা লেখা হয়েছে দেখতেই পাচ্ছেন।
‘ক্বারী সাহেব ৪.০’ পেইজে হজ এবং ইজতেমা নিয়েও বিদ্রুপ করা হয়েছে। দুটোকেই দেখা হয়েছে বিজনেস পলিসি হিসেবে।
করোনাকে মুসলমানরা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার পাপের শাস্তি হিসেবেই দেখছেন। কারোনাকে কেন আল্লাহ তায়ালার শাস্তি হিসেবে দেখা হবে—এটা নিয়ে রীতিমতো গালি গালাজ করেছেন নির্বাসিত লেখিকা তাসলিমা নাসরীন।
২০২০ এর বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গনে বিশাল জামাত নিয়ে নামাজ আদায় করেছিল মাদরাসা ছাত্র এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। এই নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন নির্বাসিত লেখিকা।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় মুসলিম বিদ্বেষ
ফেসবুকে বিভিন্ন উপলক্ষে শর্ট ফিল্ম প্রতিযোগিতা ঘোষণা করা হয়।। ২০২০ সালেও ‘সবাই ভিন্ন একসাথে অনন্য’ শিরোনামে এই প্রতিযোগিতার আহ্বান করা হয়েছিল। প্রতিযোগিতায় মূলত গল্প আহ্বান করা হয়। বাছাইকৃত গল্প দিয়ে তৈরী হয় শর্ট ফিল্ম। সম্প্রীতির নামে এসব প্রতিযেগিতায় ছড়ানো হয় জাতিগত বিদ্বেষ। ইসলামফোবিয়া।
এবারের একটি শর্টফিল্ম ‘নিঃশব্দ’। এতে দেখানো হয়—হিন্দু ছেলের ফেসবুক আইডি থেকে মুসলিম বিদ্বেষী পোস্ট দেয়ার কারণে তাকে মারধর করা হয়। ছেলেটা মারাও যায়। কিন্তু গল্পে এটাও দেখানো হয়, মূলত হিন্দু ছেলের আইডি হ্যাক করেছে মুসলিম ছেলে। মুসলিম ছেলেই মূলত মুসলিম বিদ্বেষী পোস্ট দিয়েছে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নেবার জন্য। গল্পে ক্রিমিনাল বানানো হয় মুসলিমদেরকেই। হিন্দুদেরকে বানানো হয় নিষ্পাপ। যেন সবকিছুর জন্য দায়ী মুসলিমরা।
প্রতিযোগিতার আরেকটি শর্টফিল্ম ‘পর্দা’। এতে দেখানো হয়—মুসলিম ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসে ঢাকায়। ঢাকায় তার পরিচিত কেউ নেই। গ্রামের ইমামের সূত্র ধরে এক মাদরাসায় রাত কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার অজুহাতে ছেলেটিকে রাতা কাটানোর জায়গা দেয়নি। গেট থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। পরে হিন্দু ছেলে তাকে জায়গা দেয়। নিরাপত্তার ধার ধারে না সে। গল্পে মূলত মাদরাসার সংকীর্ণ, অসামাজিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। আর মুসলিমরা কেবল সম্প্রীতির পথে বাধাই সৃষ্টি করে।
২০১৮ সালে আরেকটি ভিডিও ক্যাম্পেইন করা হয়েছিল। ওখানেও মূলত গল্প আহ্বান করা হয়েছিল। গল্পে নির্মিত হয়েছিল শর্টফিল্ম। এরমধ্যে একটি শর্টফিল্মের নাম ‘আব্দুল্লাহ’। এখানে মূলত সরাসরি মাদরাসা শিক্ষার প্রতিই অনাস্থা প্রকাশ করা হয়েছে। মাদরাসায় ছাত্রদেরকে ছোট ছোট বিষয়ে বেত্রাঘাত করা হয়। মাদরাসা শিক্ষিতরা মাদরাসার বাইরে কেনো কাজ করতে পারে না, বাইরে কাজ করতে গেলেও তাদের কনফিডেন্স থাকে না, মাথা নুইয়ে মিনমিন করে চলতে হয়—এইসব।
আব্দুল্লাহ ছিল মূল চরিত্র। এই চরিত্রে যে অভিনয় করেছে, তাকে ইনবক্সে জিজ্ঞেস করেছিলাম—কওমির ছাত্ররা আসলেই তো এত কনফিডেন্সহীন না যে, অফিসের সামান্য কেরানির দায়িত্বও পালন করতে পারবে না। সবজায়গায় উপেক্ষিত। আসলে এই চিত্রায়নটা কেন? অভিনেতার সরল উত্তর ছিল—স্ক্রিপ্টের বাইরে কিছু করার সাধ্য আমার ছিল না!
উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে
আসলে পুরো ফেসবুক জুড়েই এখন মুসলিমবিরোধী সর্বগ্রাসী প্রচারণা চলছে। আরব নিউজ একবার তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছিল—ফেসবুকের এলগরিদম এন্টি মুসলিম এলগরিদম। মুসলিমদের বিরুদ্ধে যতই ঘৃণা ছড়ানো হোক, ফেসবুক পোস্টগুলো রিমুভ করে না। দক্ষিণ এশিয়ার আমেরিকান মানবাধিকার এবং প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা তাদের তদন্তে বলেছিল—ভারতের ফেসবুকে যেসব মুসলিম বিদ্বেষমূলক পোস্টে রিপোর্ট করা হয়েছে, তার ৯৩ শতাংশই ফেসবুক কর্তৃপক্ষ রিমুভ করেনি। জাতিসংঘের তদন্তকারী ইয়াঙ্গি লি বলেছেন, ‘ফেসবুক এখন সংঘাতকে উদ্বুদ্ধ করার বাহন হিসেবে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার পেছনের চালিকাশক্তি ছিল ফেসবুক এবং এর বিদ্বেষমূলক প্রচারণা।’
বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকগণ বলছেন, ফেসবুকের শক্ত নীতি এবং নৈতিকতা দরকার। নয়ত আগামী পৃথিবী আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে ফেসবুক। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। প্লাটফর্ম বড় এবং বিস্তৃত হচ্ছে। সবার ক্ষেত্রে সমান দৃষ্টি বজায় না রাখলে, ফেসবুকের পোস্ট এবং মন্তব্য ঘিরেই তৈরী হবে সংঘাত, সংঘর্ষ। এভাবেই বাড়বে বিদ্বেষের সংস্কৃতি।
সূত্র :
১. মিডলইস্ট আই, ২৯ জুলাই, ২০১৬
২. আরব নিউজ, ২১ জুন, ২০১৯
৩. ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস, ১১ জুন, ২০১৯
৪. দ্য গার্ডিয়ান, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯
৫. Islamphobia on Social Media: A Qualitative Analysis of the Facebook’s Walls of Hate, Imran Awan
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন