ড. মো: আব্দুস সালাম আজাদি
যেসব ভায়ের মুখ দেখে চাঁদ ছোঁয়ার অনুভুতি হয়, আমার প্রিয় মাওলানা মুহাদ্দিস আবুসাঈদ মুহাম্মাদ শাহাদাত হুসাইন ছিলেন তাদের অন্যতম। মানুষকে কাছে টানার জন্য দুইটা চুম্বকীয় শক্তি দরকার হয়। একটা মুখ ভরা হাসি। আরেকটা মন ভরা ভালোবাসা। এই ভায়ের মাঝে সেই গুণ দু’টাই ছিলো পরিপূর্ণ। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি যে সব ব্যক্তিত্বকে কাছে পেয়ে তর তর করে আকাশের উচ্চতায় স্থান করে নিচ্ছিলো নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে আজকের এই ভাই, সাতক্ষীরার কাজী শামসুররহমান প্রভৃতিগণ ছিলেন আল্লাহর খুব কাছের মাশাআল্লাহ।
খারাপ লাগছে। ঘুম থেকে আজ উঠেই আমার প্রিয় এই ভায়ের ইন্তেকালের সংবাদ পেয়ে মনটা বেদনার নীলে কাতর হয়ে উঠলো।
তিনি যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়ার মকুন্দপুরে জন্ম গ্রহন করেন। আমার জানা মতে ভাই তারা ৪ জন। আনোয়ার ছিলো আমার ছোট ভায়ের মত। মেঝভাই বাংলাদেশের সাহিত্যাকাশের জ্বলজ্বলে তারা কবি মোশাররাফ হুসাইন খান। পাথরে পারদ জ্বলের মত সেরা কাব্যগ্রন্থ উপহার দেয়া সোনালী কবি। আরেকভাই অন্য এক মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল। আর তিনি ছিলেন একাধারে বড় আলিম, অন্য দিকে গণমানুষের হৃদয়স্পন্দন। তার নামের আগে সবাই মুহাদ্দিস বলতো। কারণ তিনি যে থানায় জন্মে ছিলেন, তার সেরা প্রতিষ্ঠান ঝিকরগাছা আলিয়া মাদ্রাসায় কিছুদিন শায়খুল হাদীস হিসেবে কাজ করেছেন। তবে তিনি ছিলেন একজন জাত প্রিন্সিপ্যাল। দক্ষতার সাথে পদ্মবিলা সিনিয়র মাদ্রাসায় তিনি আমরণ অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করে গেছেন।
তিনি জামায়াতে ইসলামি করেছেন, নাকি জামায়াত তাকে পেয়ে গিয়েছিলো এ একটা মিলিয়ন পাউন্ডের প্রশ্ন। মানে হাদীসে একটা কথা আছে।
"النَّاسُ معَادِنُ كَمَعَادِنِ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ، خِيَارُهُمْ في الجَاهِلِيَّةِ خِيارُهُمْ في الإِسْلامِ إِذَا فَقهُوا. وَالأَرْوَاحُ جُنُودٌ مُجنَّدَةٌ، فَمَا تَعَارَفَ مِنْهَا ائْتَلَفَ، وَمَا تَنَاكَرَ مِنْهَا، اخْتَلَفَ
অর্থাৎ মানুষ হলো স্বর্ণ ও রূপার খনির মত। জাহিলিয়্যাতে যারা সেরা, ইসলামেও এসে তারা সেরা ই হয়ে থাকে যদি ইসলামে তারা বিদগ্ধ হতে পারে। আর মানুষের আত্মাগুলো হলো সারিবদ্ধ ভাবে থাকা সেনাবাহিনীর মত। এদের একে অপরের যখন পরিচিতি ঘটে, তখন তারা ভালোবাসার বিন্দুতে এক হয়। আর তাদের পরিচিতির গন্ডীতে একে অপরকে না টানলে তারা দূরেরই থেকে যায়। (বুখারি, ও মুসলিম)
অন্যদের কথা বলতে পারবো না, তবে যশোর সাতক্ষীরার যে সব আলিম উলামা জামায়াতের সাথে জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন ও করছেন তারা জামায়াতে আসার আগেও যেমন গণমানুষের প্রিয়পাত্র হিসেবে দেখেছি, জামায়াতে এসেও তাদের অবস্থা দেখেছি, আগের অবস্থার কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। আর এই সব লোক শুধু জামায়াতের সম্পদ হয়ে ওঠেনা, এরা হয়ে যায় উম্মাতী গগণের জ্বলজ্বলে তারা।
১৯৯৪ সালে আমি তার প্রথম দেখা পাই ঝিকরগাছা থানা সদরে। এই ঈদ পূনর্মিলনীতে আমার দুলাভাই মাওলানা মাহবুবুর রহমানে আমাকে জোরা জুরি করেন প্রোগ্রামে নিতে। আমি তখন মদীনায় পড়তাম। এই ধরণের প্রোগ্রাম সে যত বড় ইসলামি রাজনৈতিক দলের ছত্র ছায়ায় হোক, কখনো ইসলামি প্রোগ্রাম মনে হয়নি। এই ঈদ পূনর্মিলনী নামটাই আমার কাছে সব সময় খারাপ লাগতো। ঈদের দিন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত থাকবে। ঈদের দুইদিন বা তিন দিন পরে সব নেতা কর্মীদের একত্রিত করে ঈদ পার্টি করা যেন মূল অনুষ্ঠানকে ব্যাহত করে ফেলে। ঈদের দিনে নানা প্রোগ্রামে রেখে মানুষকে আনন্দময় করে রাখা শুধু ইবাদাত নয়, ইসলামের মূলধারার ফেস্টিভ্যাল পালন ও বটে। যেটা আমাদের নবী (সা) করতেন। ঈদের দিন আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে প্রোগ্রামে শুধু ব্যস্ত না থেকে, সামজিক ভাবে ঈদ পালনে আরো ব্যাপ্তি ঘোটানো কুরআন সুন্নাহের দাবি।
দুলাভায়ের জোরাজুরিতে না যেয়ে পারলাম না। তবে শর্ত দিলাম, অনুষ্ঠানে যেয়ে আমি কিছু বলবো না, একদম পেছনের কাতারে যেয়ে বসবো। আলহামদুলিল্লাহ, প্রোগ্রামে শেষ তক থাকতে পারলাম একটা বই খতম করার মধ্য দিয়ে। প্রোগ্রাম শেষে একজন ভাই পাশ থেকে সালাম দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম তিনিই আজকের প্রধান অতিথি মুহাদ্দিস আবু সাঈদ সাহেব। বললেন, এই এলাকায় এই অপরিচিত মুখ, আপনি কে? আমি নাম বলতেই, বললেন, ও আপনি মাহবুব ভায়ের শ্যালক, আবার জড়িয়ে ধরলেন। টানতে থাকলেন, চলেন চলেন বলে। মানে উনি আমাকে তার বাড়িতে নেবেন। আমি এই গল্প বলার পেছনে কারণ হলো, অপরিচিতজনকে পরিচিত করার যে ঢং ও ব্যঞ্জন তিনি আমাকে শেখালেন তা সত্যি অভিভূত করে আমাকে। পরিচিত জনদের ঘরের খবর রাখা, কে কোথায় থাকে তার সংবাদাদী রাখা, নতুন কেও এলে তার দিকে সহাস্যে এগিয়ে এসে বাড়িতে নেয়ার চেষ্টা করা এই সব ই হলো ইসলামি সভ্যতা ও আদাবের মূল বিবেচ্য বিষয়।
আমি তাকে ঈদ পূনর্মিলনীর শরঈ হায়সিয়্যাত নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি গমগীন হলেন। বলেই উঠলেন, আসলে সালাম ভাই, এটা এক ধরণের নিয়ম করে ফেলেছি যেন আমরা। এ থেকে বের হওয়া ভাল। এত বড় একজন কেন্দ্রীয় নেতা, অত বড় একজন কিতাবী আলিম, আমার সাথে পেঁচাতে পারতেন। কিন্তু হক্ব কথা মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে তার এই তড়িৎ অগ্রসরতা আমাকে বিমুগ্ধ করে।
কবি মোশাররাফ হোসাইন ভায়ের সাথে পরিচয় হয় বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারে। কবি মল্লিক ভায়ের সাথে দেখা করতে যাই মাসিক কলমের অফিসে। তিনি আমাকে পেয়ে যেন পাগল হবার যোগাড়। আমাকে বসিয়ে রেখে অফিসের সবাইকে ডাকলেন। ৪জন ভাই এলে তিনি মোশাররফ ভাইকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, তার কবিতা তুমি অনুবাদ করতে পারো। আরবরা ওর স্বাদ পেলে দেখবা বাংলাদেশের ইসলামি সাহিত্য নিয়ে গর্ব করবে। আমি তাজ্জব হলাম তার “পাথরে পারদ জ্বলে” কাব্যগ্রন্থ দেখে। তিনিই তখন পরিচয় দিতে দিতে আবু সাঈদ ভায়ের কথা বললেন। দেখলাম, সুবহানাল্লাহ, একটা পরিবারের সবাই একই রকম ভদ্র, বিনয়ী ও মানুষের অন্তরের কাছাকাছি হয়ে ওঠে কি করে! ছোট ভাই আনওয়ার হোসাইন ও তার ভাইদের মত সদা হাস্যময়। এদের দেখে ভাবতাম, আহ তার পরিবারের মত যদি একটা তারকার পরিবার আমার হতো!!
তিনি মাঝে মাঝে আমার কাছে ফোন করতেন। লন্ডনে তার ফোন পাওয়া মানে কমপক্ষে আধা ঘন্টা তিনি নিবেনই। তার আলোচনা থাকতো ইসলামি পলিটিক্স ও সভ্যতার দ্বন্দে আমাদের কর্মপদ্ধতির উপর। তিনি অনেক কথা খুটে খুটে শুনতেন এবং নির্দেশনা দিতেন কিছু বিষয়ের উত্তর খোঁজার জন্য। আমি ভাবতাম গ্রাম দেশে থেকে এই ভাই এতো কিছু পড়াশুনা করে কখন ও কিভাবে।
২০০১ সালে তিনি এমপি হন। বড় শখ জাগে তার এমপি হবার পরের জীবন দেখতে। আমি এমপি কাজি শামসুর রহমান সাহেবের (রহ) সাথে দেখা করেছি, এমপি মাওলানা রিয়াসাত আলীর (রহ) কাছে গেছি, এমপি মাওলানা সাখাওয়াত হুসাইন সাহবকে এমপি হবার পরে দেখতে গেছি, এমপি ও প্রতিমন্ত্রী থাকা মাওলানা মুফতি ওয়াক্কাস সাহেবের বাসায় নাস্তা খেয়েছি, এমপি আবু সাঈদ ভায়ের বাসায় ও গেছি। এরা সবাই ছিলেন এমপি হবার আগের মানুষ ও এমপি হবার পরের মানুষের মাঝে পার্থক্য ঘুচানো গণমানুষের প্রিয় নেতা। আমি তখন ছাত্র ছিলাম এর পরেও তাদের ব্যবহার আমাকে আজো ঋণী ও ঋদ্ধ করে রেখেছে। আল্লাহ তাদের কল্যান দিন। মৃতদেরকে রহম করুন ও জান্নাত দান করুন।
মুহাদ্দিস আবু সাঈদ ভায়ের বড় মেয়ে হন ব্লাড ক্যান্সারের শিকার। তিনি ভারতে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। আমেরিকার আমার বন্ধু ও ছোটভাই আইনবীদ অহিদুল ইসলাম ভাই তার পাশে দাঁড়াতে বললেন। আমি ফোন করলাম। মেয়ের খোঁজ খবর নিলাম। খরচের ব্যাপার তুললাম। অসহায় বাবার করুণ আর্তি শুনতে হয় কিনা বুঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, তিনি তার অভাব অভিযোগের কোন কথা বললেন না। তখন তার হাতে কোন টাকা নেই, অথচ ভারতে না নিলে মেয়েকে বাঁচাতে পারা কষ্ট হবে এই ব্যাপারেও তার কোন অনুভূতি বুঝলাম না। এই মাত্র কিছুদিন আগেও তিনি তার এলাকার কিছু অসহায়ের জন্য লন্ডনস্ত এলাকবাসীর সাহায্য চেয়েছেন। অথচ নিজের দূর্দিনে আমাকে কিছুই বললেন না। এমি তাজ্জব হলাম। আমি যখন কিছু পাঠাবার জন্য ব্যাঙ্ক একাউন্ট চাইলাম তখন তিনি নিশ্চুপ হলেন। একদম চুপ। না, লাইন কাটা যায়নি। কিন্তু তিনি চুপ হয়ে গেলেন। নাম ধরে ডাকলাম। তিনি ফুঁপিয়ে জবাব দিলেন। বললেন, ভাই আমার মেয়েকে যে আপনি আপনার মেয়ে মনে করে নেবেন ভাবিনি, তাই আবেগে কেঁদে ফেলেছি। বুঝলাম এতক্ষণ চুপ থাকার কারণ। সেদিন বুঝলাম পরের জন্য করতে করতে এরা নিঃস্ব হন, কিন্তু নিজকে নিয়ে মোটেও এরা ভাবেননা।
গাঢ় শ্যামলা চেহারায় ঈমানে দ্যুতিতে অন্য এক উদ্ভাস তৈরি করে। সুর হীন কণ্ঠেও ঈমানের বানী গুলো গান হয়ে মনে মনে আছড়ে পড়ে। ছোট খাটো মানুষেরাও ঈমানের পথে জীবন বাজি রাখলে আকাশের উচ্চতা পায়। আর আল্লাহর ভালোবাসা পেলে মুমিন বান্দাহ প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। আজ এই ভরা দুপুরে আবুসাঈদ ভায়ের ইন্তেকালের পর সেইটাই যেন প্রমান করে দিলো। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন ও জান্নাতের উঁচ্চতম স্থানে যায়গা করে দিন। আল্লাহ তার ৩ ছেলে ও ২ ইয়াতিম মেয়েকে ভালো রাখুন।
জানিনা দেশের বর্তমান দূর্দিনে তারা কেমন আছে। তাদের জন্য দুয়া করি। আজ ওদের মাথায় হাত বুলানোই আমাদের দ্বায়িত্ব। জানিনা আমরা কে কতটুকু করতে পারবো। তবে আমার ঐ ছোট আব্বু আম্মুদের জন্য দুয়া করি। আশা করব তারা তাদের যে কোন প্রয়োজনে আমাকে তাদের পাশে রাখবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন