করোভাইরাসের এই ক্রান্তিলগ্নে সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যকর্মীরা। এ কাজে মাঠে রয়েছেন সাংবাদিকরাও। ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিন সাংবাদিক। এদেরই একজন সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকন। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তার স্ত্রী ও ছেলেও।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে হুমায়ুন কবীর খোকনের স্ত্রী ও ছেলে চিকিৎসাধীন আছেন রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত রিজেন্ট হাসপাতালে। এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৮ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন দৈনিক সময়েরে আলো পত্রিকার চিফ রিপোর্টার হুমায়ুন কবীর খোকন।
প্রয়াত সাংবাদিক খোকনের স্ত্রী কবি শারমিন সুলতানা রিনা গতকাল রোববার তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে করোনা চিকিৎসার অভিজ্ঞতা নিয়ে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
‘দেবদর্শন’ শিরোনামে দেওয়া তার সেই স্ট্যাটাসটি দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
‘গল্পটা এভাবেও শুরু হলে হয়তো ভালো হতো-
একটি রুমে দুটি বেড আর পাশাপাশি দুটি মানুষ গল্প ও খুনসুটিতে কেটে যেতে পারতো আরও কিছু বর্ণিল সময়। আমাদের আরেকটা নতুন গল্পের সূচনা হতে পারতো এখান থেকে ; কিন্তু হলো না কিছুই। ভাগ্যের অজানা পরিহাসে সব উল্টেপাল্টে গেল এক মুহূর্তে আমার বাঁচার উপাদান। আমার হাসবেন্ড সাংবাদিক হুমায়ূন কবির খোকন; যাকে আমি সবসময় ‘‘সাংবাদিক’’ বলে সম্মোধন করতাম। যে একাকী চলে গেছে নির্জন মাটির ঘরে। তার ঠিক দুদিন পর ছেলেকে নিয়ে এসে উঠেছি হাসপাতালে; পাশাপাশি দুটি সিটের কেবিনে। নিদারুণ শ্বাসকষ্ট নিয়ে আট দিন আইসিউতে কাটানোর পর ফিরে এলাম জেনারেল বেডে। আমি ও আমার ছেলে আবীর দুই মা-বেটা একটা কেবিনে আছি।’
‘পুরো বিশ্ব এখন কোভিড-১৯ করোনার মরণ ছোবলের কাছে হার মেনে যাচ্ছে। যুগে যুগে মানুষই সব বাঁধা বিপত্তি দূর করে অন্ধকার থেকে ছিনিয়ে এনেছে সোনালী আলোর বিকিরণ। মানুষ আবার জয়ী হবে, জয়ী তাকে হতেই হবে। জয় শব্দটা মানুষের আরেকটি প্রতিরূপ। ‘
‘আমি যে হাসপাতালে আছি সেটা উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতাল। দেশের একমাত্র প্রাইভেট করোনা হাসপাতাল এটি।’
‘আজীবনই আমার চোখে ঘুম কম। আমার খোকন সাহেব তার কাজ সেরে বাসায় আসতো রাত দুইটা বা তিনটায় । আসলে আমরা খেয়ে-দেয়ে গল্প করতাম। চা খেতাম। গভীর রাতে আমাদের একসাথে কখনো পাশাপাশি কখনো মুখোমুখি বসে চা পানের তুমুল নেশা ছিল দুজনেরই। রাতে আমাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। কিন্তু ঘুম আসে না। আগে জেগে থাকতাম সুখে; আর এখন একটা শূন্যতা ঘিরে ঘিরে থাকে, যার কোনো বর্ণনা হয় না। হয়তোবা এটাই আমার অযাচিত নিয়তি।’
‘রাতে একের পর এক করোনা রোগী আসে। তরুণ ডাক্তার নার্সগুলো তাদের অক্লান্ত সেবা দিয়ে যায়। সবার পরনে সাদা পিপি। তাদের দেখলে এক একজনকে মনে হয়— সফেদ দেবতা নেমে এসেছেন ধরায় ; মর্ত্যবাসীদের উদ্ধারে। এখানে আসার পর রোগ সম্পর্কে আমার ভয় কেটে গেছে। কেটে গেছে হাসপাতাল সম্পর্কে অনীহা। এই রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতিটা সদস্যদের আচরণে যে ভালোবাসা আর মুগ্ধতা পেলাম, তাদের এ অবদান কখনো ভুলবো না।’
‘এই হাসপাতালের যিনি চেয়ারম্যান জনাব শাহেদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার কথা হয়নি, তবে আমার প্রিয়জনের সঙ্গে নিয়মিত আমাদের চিকিৎসা নিয়ে যোগাযোগ করছেন। এখানকার ডাইরেক্টর মিজান ভাই আমাকে বোনের ভালোবাসায় আগলে রেখেছেন। সর্বক্ষণ আমার ও ছেলের খোঁজ নিচ্ছেন। আছেন গণসংযোগ কর্মকর্তা শিবলি ভাই। ডা. ওয়াহিদ, যিনি নিয়ম করে দেখে যাচ্ছেন প্রতিদিন।’
‘আসলে বলতে চেয়েছিলাম ডাক্তারদের গল্প, কিন্তু শব্দেরাও হাত বাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চায়।’
‘চোখের সামনে দেখা এসব ডাক্তার নার্সরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কী অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন; তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ডা. নুসরাত, ডা. মণি, ডা. ইমতিয়াজসহ আরও অনেকেই এখানে আছেন। আছেন নার্স, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা এসব করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, আনন্দ বিলিয়ে দিচ্ছেন রোগীদের মাঝে। তাদের এই ঋণ কি আসলে শোধ হবে?’
‘ঢাকা শহরে বড় বড় হাসপাতালে করোনার কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না। অথচ প্রতিদিন রোগী বাড়ছে। আর করোনা নিয়ে মানুষের মনেও রয়েছে প্রচুর ভয়। করোনা রোগীর তিন ফুটের দূরত্বে ভাইরাস আসতে পারে না। আর মানুষের মৃত্যুর পর তিন ঘণ্টায় ভাইরাসের কার্যক্রম নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং লাশের শরীর থেকে তিন ঘণ্টা পর ভাইরাস ধ্বংস হয়ে যায়।
‘করোনা আক্রান্ত রোগীর কোনো দোষ নয় এটা। এটা বিশ্বজুড়ে এক মহামারি। যেকোনো সময় যে কাউকে আঘাত করতে পারে। আবার প্রথম দিকে বুঝতে পারলে তা বাসার চিকিৎসাতেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু করোনা আক্রান্ত রোগীকে তাচ্ছিল্য করা হয় বলে এরা জনসম্মুখে মুখ খোলে না, ঘাতক ব্যাধিকে যন্ত্রণায় পোষে। সামাজিক লজ্জায় এরা আরও ছোট হতে থাকে তখন তাদের মানসিক অবস্হার দ্রুত পতন ঘটে, যার পরিণাম মৃত্যু।’
‘গতকালও দেখলাম এক উপসচিবের মৃত্যু। কিডনি জটিলতায়ও করোনা মনে করে তাকে কোনো হাসপাতালে ভর্তি করা হলো না। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করে মানবিক হতে হবে। আমরা শারীরিকভাবে একজন একজনের থেকে দূরে থাকবো এই দূরে থাকাটাই আমাদের আরেও কাছে টানবে। আমরা ভুলে যাই সব ভেদাভেদ। এখন কেউ কাউকে দোষ দিয়ে পিছিয়ে পড়ে মৃত্যুর কোলে আর ঢলে না পড়ি। সরকার, প্রশাসনসহ সবার কাজে সহোযোগিতা করি। বিশ্বের এই লগডাউনের বিপদে আমরা সবাই সবার পাশে দাঁড়াই।’
‘যে ভাবে লিখতে চেয়েছিলাম সেভাবে পারিনি। অনুভূতি কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। আমার এ ঘোর বিপদে যারা আমার পাশে আছেন তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। তাদের সবার জন্য আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সুস্হ হয়ে যেনো বাসায় যেতে পারি— আপনারা আমার ও আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।’
‘অবশেষে দেবতার রূপে প্রতি মুহূর্তে এখন যাঁদের দেখছি তাদের জন্য ‘‘কবি শেখ ফজলুল করিম’’ এর এই কবিতাটি বারবার মনে পড়ছে-
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়ে ঘরে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন