আলমগীর শাহরিয়ার
মহামারি করোনা মাঝে ভারতে ছড়িয়েছে নতুন ভাইরাস আতঙ্ক। রহস্যজনক এই ভাইরাসে এরই মধ্য ১৯০০ শূকর মারা গেছে, তাই শূকরের মাংস কেনা-বেচা বন্ধ করেছে আসাম সরকার। আসামের অ্যানিম্যাল হাসব্যান্ডারি, ভেটিরিনারি এণ্ড এগ্রিকালচার মন্ত্রী অতুল বোরা জানিয়েছেন, 'ভাইরাস সংক্রমণে বহু শূকরের মৃত্যু হয়েছে এবং মোট ১৯৬৪টি মৃত্যুর ঘটনা সামনে এসেছে। ছ’য় জেলায় এই ঘটনা দেখা গেছে।'
তিনি আরও বলেছেন, 'আমাদের ভেটিরিনারি ডাক্তাররা মৃত শূকরদের নমুনা সংগ্রহ করেছেন এবং তা ভুপালের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হাই সিকিউরিটি অ্যানিম্যাল ডিসিজেজ ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। এখন আমরা রিপোর্টের অপেক্ষা করছি। কিন্তু এক্ষুনি আমাদের সরকার শূকরের মাংস কেনা-বেচা ও বণ্টন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় ১৯৬১ সালে জন্ম বিজন কুমার শীলের। অকপটেই স্বীকার করেন ‘আমি কৃষক পরিবারের ছেলে। আমার বাবা ছিলেন কৃষক। বাবার সঙ্গে মাঠেও কাজ করেছি দীর্ঘদিন।’ বাবা রসিক চন্দ্র শীল ও মা কিরণময়ী শীলের ২ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম বিজন। বনপাড়ার সেন্ট যোসেফ হাইস্কুল, পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ হয়ে ভর্তি হন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে স্নাতক হন ভেটেরিনারি সায়েন্স বিষয়ে। ফলাফল ছিল প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন অণুজীববিজ্ঞানে।
কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে দ্য ইউনিভার্সিটি অব সারে থেকে ১৯৯২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো নিয়ে (ডেভেলপমেন্ট অব মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিজ)। সেই থেকে বিজন কুমার শীলের অণুজীববিজ্ঞান বিশেষ করে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর গবেষণা আর থেমে থাকেনি। অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে ১৪টি উদ্ভাবনের পেটেন্ট রয়েছে বিজন কুমার শীলের নামে। পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় জার্নালগুলোতে ২০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, ২০টির বেশি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। বিজন কুমার শীলের স্ত্রী অপর্ণা রায় একজন প্রাণী চিকিৎসক। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
কর্মজীবন
ড. বিজন কুমার শীল সিংগাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। এরপর ঐ চাকরি ছেড়ে জয়েন করেন এমপি নামক একটা বায়োলজিকস আমেরিকান কোম্পানিতে, ওটার মালিক ছিলেন যুগোস্লাভিয়ার একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। এরপর নিজেই বায়োলজিক্যাল রিয়েজেন্ট তৈরি ও ব্যবসা শুরু করেন। সম্প্রতি তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেন মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে। সেখানে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি মনোযোগ দেন গবেষনায়।
করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কার
২০০৩ সালে যখন সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল তখন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল সিঙ্গাপুর গবেষণাগারে কয়েকজন সহকারীকে নিয়ে সার্স ভাইরাস দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে ড. নিহাদ আদনান, ড. মোহাম্মদ রাঈদ জমিরউদ্দিন ও ড. ফিরোজ আহমেদ এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। ‘র্যাপিড ডট ব্লট’ পদ্ধতিটি ড. বিজন কুমার শীলের নামে পেটেন্ট করা। পরে এটি চীন সরকার কিনে নেয় এবং সফলভাবে সার্স মোকাবেলা করে। উল্লেখ্য, তার আগে ১৯৯৯ সালে ছাগলের মড়ক ঠেকানোর জন্য পিপিআর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছিলেন তিনি।
সিঙ্গাপুরেই গবেষণা করছিলেন ডেঙ্গুর ওপরে। গবেষণা চলাকালে তিনি দুই বছর আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেন। সম্প্রতি ফের বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত তখন এ অনুজীববিজ্ঞানী মনযোগ দেন করোনা শনাক্তকরণ কিট উদ্ভাবনে এবং খুব তাড়াতাড়ি সফলতার মুখ দেখেন। গণস্বাস্থ্য র্যাপিড ডট ব্লট (জি র্যাপিড ডট ব্লট) নামের এই কিট তৈরির দলে আরও যে কজন অণুজীববিজ্ঞানী রয়েছেন তারা হলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিহাদ আদনান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রাশেদ জমিরউদ্দিন এবং আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. আহসানুল হক।
তাদের এই গবেষণাকাজ সমন্বয় করেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মহিবুল্লা খন্দকার। সার্বিক তত্ত্বাবধানে আরও ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ। বিদেশ থেকে আমদানি করলে এ কিটের দাম পড়ত ৪-৫ হাজার টাকা মত। সেখানে তাদের উদ্ভাবিত কিটের দাম পড়বে মাত্র তিন থেকে চারশ টাকার মধ্যে।
অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল আমাদের আনসাং হিরো। আমাদের বীর। আমাদের গর্বের ধন। তাকে অশেষ শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই তার সহযোদ্ধাদের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন