ফারহানা নীলা
সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২৪ ঘণ্টায় দেশে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪১ জন এবং মারা গেছেন ১০ জন। আজ পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১৫৭২ জনে দাঁড়িয়েছে এবং মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ জনে। একে একে কোয়ারেন্টিনে অনেক ডাক্তার। আইসোলেশন আর কোয়ারেন্টিনে হয়তো আরো ডাক্তার চলে যাবেন। অনেক হাসপাতাল লক ডাউন।
এত স্বাস্থকর্মী কেন আক্রান্ত, সেটা এখন ভাবার বিষয়।
১. পিপিই কি মানসম্মত
২. মাস্ক কি আসলেই মানসম্মত[
৩. সবার কি পিপিই ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা আর প্রশিক্ষণ আছে
৪. রোগীরা কি সঠিক ইতিহাস দিচ্ছেন
৫. সচেতনতা কি এসেছে
৬. ডিসপোজাল ঠিক মত হচ্ছে পিপিই
৭. ডিসপোজেবেল ভাবে ব্যবহার হচ্ছে নাকি রি- ইউজ হচ্ছে
৮. ডাক্তার কি সুরক্ষিত নাকি অরক্ষিত
৯. সবার কি কন্টাক্ট ট্রেসিং হচ্ছে
১০. আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন কি সঠিকভাবে মানছে
এতগুলো মানুষ মনের আনন্দে বাজার করছে। গার্মেন্টস শ্রমিক পারিশ্রমিকের জন্য রাস্তায়। দিন মজুর কাজের জন্য রাস্তায়। কোথায় সামাজিক দূরত্ব?
সচেতন নাগরিক ঘরে। ডিপ্রেশন আর আতংকে দিন কাটায়। মানুষ ক্ষুধা নিয়ে কাজ খোঁজে। চারিদিকে আক্রান্ত জনপদ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা আর মনোবল আমাদের চাঙ্গা করে।তিনি মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন। কিন্ত ষোল কোটি মানুষের আজ বড় ব্যথা... নিরাপত্তার অভাব।
আসলে গলদটা কোথায়? একসময় কুষ্ঠ রোগ শুনলেই তার ধারের কাছে কেউ যেতো না। ডাক্তারের চিকিৎসা চলতো। যক্ষা রোগীর সংস্পর্শে কেউ আসতো না। বছরের পর বছর মাত্র ২৫০ টাকা ঝুঁকি ভাতায় ডাক্তার টিবি রোগীর চিকিৎসা করেন। রক্ত নিয়ে যারা কাজ করেন, হেপাটাইটিস বি,সি আর এইডস্ এর মত জীবনঘাতি অসুখের মারাত্মক ঝুঁকি তাদের। যারা পরিপাক তন্ত্রের রোগীর চিকিৎসা করেন তাঁরাও ঝুঁকিতে। যারা সার্জারী করেন, ঝুঁকি তাদেরও।
এমন হাজারো হাজার ঝুঁকি নিয়েই ডাক্তারের জীবন। ডাক্তার ভয় পায় না। ডাক্তারের ভয় পেতে নেই। নার্স ভয় পায় না, স্বাস্থ্য কর্মীদের ভয় পেতে নেই।
মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে নিতে হবে... আজ হোক আর কাল হোক।সময় এলেই যেতে হবে... চিরন্তন সত্য এটা। ডাক্তার তো একা নন, তাঁর পরিবার আছে। বাবা,মা, ভাই, বোন, সন্তান, স্ত্রী, স্বামী, আরো অনেকে...তাঁদের অনেক বন্ধন আর অনেক বাঁধা... পায়ে পায়ে পেঁচিয়ে ধরে ভালবাসা, মায়া। কর্তব্যের কোনো হেরফের হয় না তাতে। তাঁরা অকুতোভয়, তাঁদের এমনই হতে হয়।
মানুষের সীমাবদ্ধতা থাকে। মানুষের ভুল থাকে। আর ডাক্তার তো মানুষ। মানুষের ঊর্ধ্বে ওঠার সামর্থ্য তো নাই কারো, থাকেও না।
আপনারা এখন আক্রান্ত হচ্ছেন, ঘরে ঘরে কোভিড ১৯ রোগী। সারাদিন ফোন পাই। আর ভয় পাই রোগী বাড়ছেই। গতরাতে একজনের খবর জানলাম। তিনি মাত্র একদিন ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন। তাঁর একজন বাচ্চা প্রতিবন্ধী। তিনি পজিটিভ। বাচ্চাটাকে তিনি দেখাশোনা করতেন। এখন তিনি আইসোলেশনে।
যদি আক্রান্ত হয়েই যান, তবে আর কি? ভয় পাবেন না। সুরক্ষিত থাকুন। নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলুন সবার থেকে। আলাদা ঘর, আলাদা বাথরুম, খাওয়ার বাসন কোসন আলাদা— নিজেকে বন্দি করে রাখুন চৌদ্দ দিন। মাস্ক পরুন। কারো সাথে মিশবেন না। তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন পারিবারিক পরিমন্ডলে।
জ্বর আসলে প্যারাসিটামল খাবেন। সর্দিকাশি থাকলে এন্টিহিস্টামিন খাবেন। গরম পানি খান। ঠান্ডা কিছু খাবেন না। চা খান। ভিটামিন সি খান। মাল্টিভিটামিন খান। নিজের মত প্রার্থনা করুন। নিজেকে চাঙা রাখুন।
বাসায়ই থাকুন। বাসার সবার পরীক্ষার জন্য আইডিসিআরের হটলাইনে ফোন করুন। হটলাইনের নম্বর...১৬২৬৩, ৩৩৩।
শ্বাসকষ্ট হলে আইডিসিআরকে জানান। নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তি হোন। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে, কুর্মিটোলা হাসপাতালে, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে, মুগদা মেডিকেলে—আপনার নিকটস্থ হাসপাতালে।
শতকরা আশি জন চৌদ্দ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবেন। সাতদিন পর আবার পরীক্ষা করুন। তারপর তিনদিন পর আবার পরীক্ষা করুন। দুইবার নেগেটিভ এলে আপনি সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ। যারা ঢাকার বাইরে তারা নিকটস্থ করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে যোগাযোগ করুন। সযেহেতু সামাজিক দূরত্ব মেনে বা মেপে চলা হয়নি.... এখন তো আর কিছু করার নেই।
টেলিমেডিসিন সেবা নিন। অনেকে চিকিৎসা দিচ্ছেন টেলিফোনে। আপনিও সেই সেবার আওতায় আসুন। অযথা দৌড়াদৌড়ি করে আর কাউকে সংক্রমিত করার প্রয়োজন নেই। এতে আপনার ক্ষতি, সবার ক্ষতি। পরিবারের ক্ষতি, সমাজের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি।
এতে স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তারা আক্রান্ত হবেন। ডাক্তার আক্রান্ত হবেন। তখন আপনাদের চিকিৎসা করার জন্য কাউকে পাবেন না।
আল্লাহ ক্ষমাশীল। আমাদের ক্ষমা করুন। কিন্তু এখনো আমরা এত এত অন্যায় করছি, এত এত দুঃসাহস দেখাচ্ছি— ক্ষমা পাবো কিভাবে? আমরা মানবিকতা হারিয়ে ফেলছি, আমরা স্বার্থপর হচ্ছি প্রতিনিয়ত। মনুষ্যত্ব ক্রমশ মিইয়ে পড়ছে। আমরা কিসের মত আচরণ করছি? আসলেই কি মানুষের মত? বিভৎসতা বেরিয়ে আসছে— মানুষের মত আদলে।
আসুন আরো একবার আমরা মানুষ হই। এই বৈরী পৃথিবীতে মানুষের জন্য জাগিয়ে তুলি ভালবাসা। দিনশেষে আমাদের পরিচয় হোক— মানুষ।
লেখক: ফারহানা নীলা, চিকিৎসক ও কবি।
পূর্বপশ্চিমবিডি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন