জিন্নাতুন নেছা
এক করোনা ভাইরাসই প্রমাণ করে দিল বাংলাদেশের উন্নয়ন কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে? কতটুকু মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। জিডিপির হার বৃদ্ধির অর্থ আসলে কি? প্রায় ৩ মাস পূর্বে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকেই চীনে করোনা ভাইরাস নিয়ে কথাবার্তা শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। যা জানুয়ারি মাসে এসে তীব্র আকার ধারণ করে এবং মহামারিতে রূপান্তরিত হয়। ক্রমান্বয়ে অনেক দেশেই ছড়িয়ে পরে এবং এখন প্রায় এমন কোন দেশ নেই যে এই করোনা ভাইরাসের ছোঁয়া পায় নাই। এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এই ভাইরাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে হিমশিম খাচ্ছে। চীন, ইতালি, স্পেন, ইরান, কানাডা, জার্মানি, আমেরিকাসহ প্রায় বিশ্বের ১৬৯ টি দেশে মহামারি রূপ নিয়েছে এই ভাইরাস।
যখন চীনে এই ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়েছিল তখন অনেকের মুখেই এমন কথা বাতাসে উড়িয়ে বেড়াচ্ছিল যে চীনের লোকজন সাপ, ব্যাং, কুচো জাতীয় প্রাণী খায় তাই তাদের এই ভাইরাস আক্রান্ত করেছে, বাংলাদেশের লোকজন সাধু এবং ইসলাম ধর্মের অনুসারী তাই এই দেশে এসব কিছু আসবে না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বলে যে, এশিয়া প্যাসিফিকের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে ছিল।
২০০৮ সালে নেচারে একটি আর্টিকেল প্রকাশ পেয়েছিল যেখানে বলা হয়েছিল Emerging infectious diseases এর গ্লোবাল ট্রেন্ড অনুসারে এশিয়া প্যাসিফিকের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে আছে। Emerging infectious diseases চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ (১) Zoonosis (যে সকল রোগ প্রাণী থেকে হয়) from wild life, (2) Zoonosis from non-wild life (3) Drug resistance pathogens (4) Vector borne diseases- এই প্রতিটি রোগের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ খুব ঝুঁকিতে আছে।
পুঁজিবাদের এই যুগে বিশ্বায়নের প্রভাবে পুরো বিশ্ব একটা গ্রামের মতো। যেখানে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাওয়ার জন্য আকাশপথে যোগাযোগ অতীব সহজ এবং খুব কম সময়ের মধ্যমেই হয়ে থাকে। আর করোনা ভাইরাসের রোগী প্রায় সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে থাকার কারণে বাংলাদেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে খুব দ্রুতই। ডিসেম্বর,২০১৯ এর মাঝামাঝি থেকে ৮-ই মার্চ, ২০২০ প্রায় ৪ মাস ব্যবধানে করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশে যা ঘোষিত হয়েছিল আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা এর মাধ্যমে। প্রায় ৪ মাস সময় পেয়েছিল বাংলাদেশ এই ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার।
এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত কিংবা কতটুকু প্রস্তুতি নিতে পেরেছে? এই প্রেক্ষিতে আগে কিছু ঘটনা বলে নেয়া দরকার বলে মনে করছি- আজ (২৫.০২.২০২০) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আতিকা রমার ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখলাম। তিনি আজ ১২ দিন যাবৎ প্রচণ্ড জ্বর, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা, শ্বাস-কষ্ট, শুকনা কাশি, কফ, পেট ব্যথায় ভুগছেন। তার হিস্ট্রিতে তিনি বলেছেন, ভারত থেকে তার কিছু গেস্ট এসেছিল যাদের তিনি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দিয়ে এসেছেন। তাদের ট্রলিটা তিনি খালি হাতে ধরে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছেন। এটি ছিল ১০ মার্চের ঘটনা। এরপর থেকে তার উপরিউক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে। তিনি নিজে আইসিডিআরের পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা এর সাথে কথা বলেছেন কিন্তু কোন লাভ হয় নাই। তিনি আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু বলে নানান ধানাইপানাই করেই চলেছেন। আজ ২৫ মার্চ অবধি আতিকা রমার কোনো কোভিড-১৯ টেস্ট করা হয়নি। প্রচণ্ড সাহসী এবং শক্তিশালী নারী বলেই আজও তিনি কোভিড-১৯ এর সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।
মজার ব্যাপার হলো মীরজাদি আজও ঘোষণা দিয়েই চলেছেন, নতুন করে আর কোন করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। শুধু একজনের মৃত্যু হয়েছে। সরকার কি তাহলে ‘নো টেস্ট নো করোনা এমন নীতিতেই এগোচ্ছে?’ এই ঘটনার দিকে তাকালে দেখা যায় ডিসেম্বরে চীনে করোনা শনাক্ত হয়েছে। আর এই ভাইরাস মানুষের মধ্যেই ছড়াচ্ছে। কিন্তু ১০ মার্চও বাংলাদেশ সরকার তার বিমান চলাচল বন্ধ করেননি।
গতকাল উইমেন চ্যাপ্টারে একটা লাইভ দেখছিলাম করোনা নিয়ে যেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট এর সিনিয়র চিকিৎসক ড. কাজী বেননুর। তিনি বলছিলেন, গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে ১০ হাজার পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্টের জন্য চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছিল, কিন্তু এখন মাত্র ৩০০ তাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু তাদের হাসপাতালে ফ্রন্টলাইন ডাক্তারই আছে ৮০ জন। এছাড়াও আয়া, ওয়ার্ড বয় আর অন্যান্য ডাক্তাররা তো আছেনই। তাছাড়া এই ইকুইপমেন্ট আবার পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়। তাহলে কীভাবে চিকিৎসা দেবেন? তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, আমাদের যদি আগে জানাতেন তাহলে হয়তো আমরা আমাদের মতো করে এতদিনে চেষ্টা করতাম। কিন্তু এই চরম সময়ে যেখানে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার মতো নেই সেখানে আর কি করতে পারি? আমার অনেক ডাক্তার বন্ধু সবারই একই ধরনের মন্তব্য পিপিই ব্যতীত তারা কিভাবে সেবা দেবেন? মিরপুর ডেলটা হাসপাতাল, কক্সবাজার হাসপাতালে একজন রোগী শনাক্ত হবার পরপরই ইমার্জেন্সি ইউনিটের সকল ডাক্তারকে হোম কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়েছে? তাহলে কি করে সামনে যদি কোভিড-১৯ মহামারি আকার ধারণ করে তার চিকিৎসা বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিত করবে তা আমার বোধগম্য নয়,বোধকরি কারওই বোধগম্য হওয়ার কথা নয়।
সরকার ২৬ তারিখ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে, আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এই চরম দুর্যোগের সময়ে কেন এটাকে সাধারণ ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। এটাকে বিশেষ ছুটি কেন ঘোষণা করা হলো না? কেন ছুটি ঘোষণা করার আগেই সকল কিছু বন্ধ করে তারপর ঘোষণা করা হলো না? বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অধিকাংশ মানুষই দিন আনে দিন খায়। অনেকেই ঢাকা শহরে একা থাকে কিংবা যেখানে চাকরির সুবাদে থাকেন, সেখানে একা থাকেন। তারা এ রকম একটা ছুটিতে বাড়ি যাবার এক ধরনের চেষ্টা করবেন এটা খুব স্বাভাবিক। এই সুযোগ কেন সরকার তাদের দিল? এইটা কি খুব সুচারু রাজনীতির ফলাফল নাকি একান্তই নির্বুদ্ধিতা?? সরকার কি তার রাজনীতির খেলায় মেতে জনগণের জীবন নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন? এই কয়েক দিনে বাংলাদেশে প্রায় বহু সংখ্যক প্রবাসী এসেছেন। প্রবাসীরা এই দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। এই দেশের নাগরিক। তারা দেশে আসবেই। কিন্তু সরকার তাদের প্রোপার কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশান নিশ্চিত না করে কেন আনলেন? আর কেনই বা গত এক সপ্তাহ পূর্ব অবধি বিদেশি নাগরিক ও বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়া হলো? এত এত প্রশ্ন মাথায় সব সময় ঘুরপাক খাচ্ছে?
আমি বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তত এই দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, তাহলে তিনি কেন এমন সব সিদ্ধান্ত নিলেন, যা কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার জন্য সহায়ক। অন্যদিকে কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা তো নেননি আবার উল্টোপাল্টা কথা বলেই চলেছেন তার মন্ত্রী মিনিস্টাররা। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর একটায় আমার কাছে মনে হয়েছে তা হলো বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা আর সমন্বয়ের অভাব। বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে এই মিথ্যা বিষয়টাকে সরকার জোর করে টিকিয়ে রাখতে চাইছে। আর তাই বলেই চলেছে আমাদের এই আছে সেই আছে আমরা প্রস্তুত এই করোনা যুদ্ধ মোকাবিলায়, কিন্তু বাস্তবে তা শূন্য। সরকার বুঝতে পারছে না এইটা জীবনযুদ্ধ? প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে বিলবোর্ডের উন্নয়ন দেখানো যায়। কিন্তু জীবন রক্ষা হয় না।
এটি একটি ক্ষুদ্র জীবাণু প্রথমেই রাষ্ট্রের উচিত ছিল পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমন্বয় করার। তাহলে কোভিড-১৯ নিয়ে একটা ধারণা অন্তত পেত। কি উপায়ে এটা প্রতিরোধ করা যায় তা অন্তত কিছুটা হলে ও সঠিক পথে এগোতে পারত। এরপর সকল বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করার দরকার ছিল। তাহলে অন্তত টাকার অভাব হতো না/ পিপিই এর অভাব হতো না? এমনকি এইযে সকল দরিদ্র, অতিদরিদ্র মানুষগুলো কেবল পেটের কথা চিন্তা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামছেন, তা করত না। আমার তিনবেলা খাবার, চিকিৎসা নিশ্চিত থাকলে আমি কেন রাস্তায় নামব? আমি এত বোকা নই? আমার জীবনের ভয় আছে? বাংলাদেশের মানুষও নামতো না বলেই আমি বিশ্বাস করি? কিন্তু রাষ্ট্র এগুলো কিছুই না করে কয়েক লাখ প্রবাসীকে গ্রাম পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে করোনা ছড়িয়ে দেবার জন্য। আবারও কোনো কিছু বন্ধ না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে আর ছড়িয়ে দিল বলেই আমি মনে করি? কিন্তু কেন ছড়িয়ে দিল? গ্রামে গেলে করোনায় আক্রান্ত হলেও টেস্টের সুযোগ থাকবে না এ জন্যই কি? তাহলে কি রাষ্ট্র ‘নো টেস্ট নো করোনা’ নীতিতে এগোনোর রাজনীতি শুরু করেছে সকল ধরনের অপারগতাকে ঢাকার জন্য। তাহলে কি এক করোনার কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে না বাংলাদেশের উন্নয়ন?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন