মিনার রশিদ
আওয়ামী লীগার না হয়েও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ড. আসিফ নজরুল সহ অনেকেরই ভালোবাসা থাকতে পারে । এটি অস্বাভাবিক নয় , অপরাধও নয় । বরং অত্যন্ত উঁচু স্তরের একটি মানবিক গুণ ।
মাহমুদুর রহমান এবং শফিক রেহমানদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে । ফরহাদ মজহারকে চুপ বা সাইলেন্স করে ফেলা হয়েছে । এরকম গুটি কয়েক ঝিকে মারা দেখে অপরাপর সকল ঝি ও বউ টাইট হয়ে গেছে ।
এমতাবস্থায় দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী যখন চুপ মেরে গেছেন কিংবা মেপে মেপে কথা বলছেন তখন যে দুয়েকজন মিডনাইট সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ঠোঁট ও কলম চালানো অব্যাহত রেখেছেন তাদের মধ্যে ড. আসিফ নজরুল অন্যতম ।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে মনীষীর সবচেয়ে বেশী অবদান তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান । যদিও তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতিতেই পুরো স্বাধীনতা যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল । তারপরেও উপরের এই কথাটি বললে দেশের অনেকেই মেনে নিবেন । কিন্তু তাঁর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না - সকল গন্ডগোল পাকায় এই কথাটি । যে কথা ড. হাছান মাহমুদের কন্ঠে শোভা পায় সেই কথা ড. আসিফ নজরুলের জন্যে সত্যিই বেমানান লাগে । ওবায়দুল কাদের কিংবা ড. হাছান মাহমুদের কথা বলতে কোনো সাপোর্টিং ডকুমেন্ট বা যুক্তির প্রয়োজন পড়ে না । একই প্রিভিলাইজ ড. আসিফ নজরুল গ্রহন করতে পারেন না , করা উচিতও না । কাজেই সমালোচক বা শত্রু হিসাবে নয় , একজন ভক্ত বা বন্ধু হিসাবে এই সমালোচনাটি না করে পারছি না ।
এই কথাটি বলে তিনি নিজের ভক্তদের মাঝেই অসন্তোষ /
উসখুস / হতাশা / বেদনা / কনফিউশন সৃষ্টি করেছেন । তাঁর পেইজে মন্তব্য গুলি দেখলেই এটি স্পষ্ট হবে । মনে হয় তিনি নিজেও দেখেছেন !
এই কথাটি যদি গুণমুগ্ধ ভক্তের নির্দোষ উচ্ছাস হতো তবে এই কথাটি নিয়ে তেমন আপত্তি থাকতো না । বর্তমান একদলীয় অপশাসনের জন্যে কিছুটা হলেও
নৈতিক বলটি জোগায় এই বাক্যটি । একদলীয় স্বৈরশাসনের জন্যে একজন গড বা অবতার দরকার হয় । রক্তমাংসের মানুষ দিয়ে এই কাজটি সম্ভব হয় না ।ঘটা করে মুজিব বর্ষ পালন , মুজিব ক্যালেন্ডার তৈরি , বঙ্গবন্ধু না হলে দেশ স্বাধীন হতো না এই সব কথা ছড়ানো হচ্ছে এই ধান্ধা থেকেই ।
এই কথা মেনে নেয়ার পর বর্তমান একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক জায়গাটিও ড. আসিফ নজরুলদের জন্যে হাল্কা হয়ে পড়ে । কারণ বঙ্গবন্ধু নিজেই একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেই বাকশালের সর্বময় কর্তা থাকাবস্থায়ই তাঁর দু:খজনক মৃত্যু হয় । কাজেই এটাই তাঁর জীবনের শেষ রাজনৈতিক মিশন ও ভিশন ।
একদলীয় স্বৈর শাসন আমাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কেমনভাবে পঙ্গু করে দেয় ড. আসিফ নজরুলের এই মন্তব্যই তার বড় প্রমাণ ।তখনকার সময় বা পরিস্থিতিই মুজিবকে তৈরি করেছিল । মুজিব না থাকলে তখনকার জনগণের চাওয়া ও প্রত্যাশা ধারণ করার মত মাওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন প্রস্তুত ছিলেন । নেতৃত্বের কারিশমায় শেখ মুজিব বিশ হলে তাঁরই গুরু মওলানা ভাসানী না হয় উনিশ হতেন । তাছাড়া শেখ মুজিবের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দিনের রাজনৈতিক নেতৃত্বে এবং কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানীর সামরিক নেতৃত্বে পুরো যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ! তদানীন্তন মেজর জিয়ার নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অংশের বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতার ঘোষণা পুরো পরিস্থিতি অনুকূলে নিয়ে আসে ।
এমতাবস্থায় শেখ মুজিবের জন্ম না হলে এদেশ স্বাধীন হতো না - এই কথাটি কতটুকু যথার্থ ? যুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি কোনো অবদান লক্ষ করা যায় না । তিনি একটি স্পিরিট হিসাবে কাজ করেছেন । এই স্পিরিটের জন্যে বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে রেডিমেড হিসাবে ভাসানীই যথেষ্ঠ হতেন । কিংবা অন্য কেউ বঙ্গবন্ধু হয়ে পড়তেন ।
বিশেষ করে ড. নজরুল এমন সময় এই কথাটি বলেছেন যখন স্বাধীনতার ঘোষণাকারী এক সেক্টর কম্যান্ডারকে ৪০০ টাকার কর্মচারী হিসাবে অবজ্ঞা করা শুরু হয়েছে ! স্বাধীনতার অন্যান্য মনীষীদের অবদানকে খাটো বা অস্বীকার
করা হচ্ছে - একমাত্র বঙ্গবন্ধুকে দেবতার সারিতে বসানোর নিমিত্তে । সরকারের চামচাবৃন্দ মুজিব বর্ষ নামে নতুন পন্জিকা চালু করে ফেলেছে । একমাত্র যীশু খ্রীষ্ট এবং এই মাপের দুয়েকজন ছাড়া অন্য কারো নামে এরকম সাল গণনা আছে কিনা জানা নেই ।এরকম সাল গণনা মহাত্মা গান্ধীর নামে নেই , জর্জ ওয়াশিংটনের নামে নেই , লিংকনের নামে নেই - সম্ভবত কোনো দেশের কোনো রাজনৈতিক নেতার নামে নেই । তবে আফ্রিকার কোনো দেশে আছে কি না জানা নেই !
ড. আসিফ নজরুল তাঁর জায়গা থেকে এই উন্মাদদেরই উস্কে দিয়েছেন বলেই ঠাহর হচ্ছে !
এই জলজ্যান্ত ইতিহাসকে সামনে রেখে আপনি এই কথা কীভাবে বলেন ? আমি আবারো
স্পষ্ট করে বলছি , পছন্দ করি আর না করি , পুরো স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শেখ মুজিবের ভূমিকাকে এক নম্বরে রাখতে আমার আপত্তি নেই । কিন্তু তিনি না হলে আমাদের স্বাধীনতা আসতো না - সত্যি একটু বেশি বলে ফেলেছেন !
সরকারের কট্টর সমালোচক ড. আসিফ নজরুলের এই কাফফারা/ তোহফাটি সরকারের জন্যে খুবই উপাদেয় হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই । সরকারের বিরুদ্ধে নিরানব্বই টি সত্য কথা বলেছেন এবং এখন পক্ষে একটি মাত্র মিথ্যা / অর্ধ সত্য বলে আগের সকল পাপ মোচন করে ফেলেছেন । পাঠকরা এই ধরণের ধারণা পোষণ করলে তাদেরকে খুব বেশি দোষ দেয়া যাবে বলে মনে হয় না ।
পাঠকদের কাছে এটা ড. আসিফ নজরুলের বুদ্ধিবৃত্তিক মুন্সীয়ানা বলেও গণ্য হতে পারে । ড. আসিফ যে পত্রিকাটিতে লিখেন সেই পত্রিকাটিও সারা বছর অনেক সত্য বলে পাঠক ধরে রাখে । তারপর একদিন একটি মিথ্যা পরিসংখ্যান দিয়ে আগের সকল সত্য কথাগুলি অসাড় করে দেয় । ফলে স্বৈরশাসনের ঐ দৈত্য জাতির ঘাড় থেকে কখনই সরবে না । বরং এই কিছিমের বুদ্ধিবৃত্তিক মুন্সীয়ানার মাধ্যমে এই অসহনীয় দৈত্যের জন্যে
এক ধরণের গ্রহনযোগ্যতা তৈরি করে দেওয়া হয় । একদলীয় অপশাসনের দৈত্য এবং এই ধরণের মুন্সীয়ানা যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি চলতে পারে ।
জানি না , ড. আসিফ নজরুল এই কথাটি বুঝে বলেছেন নাকি না বুঝে কিংবা দেশে থাকার প্রয়োজনে বলেছেন ?
যে কারণেই বলে থাকুন না কেন , এই কথাটি একটি ভুল ম্যাসেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে । যা তার নিজের জন্যে কিংবা দেশের জন্যে কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন