হাসান জাকির
‘পাপিয়ারা কত সহজে কোটি টাকা কামায় করে অথচ মঈনদের...’
ঝকঝকে টাক। টাকের উপর সাদা গোল টুপি। ফাগুনের সন্ধ্যায় লোকাল বাসের মধ্যে বেশ গরম। এই গরমেও টুপিওয়ালা কন্ডাক্টরের পরনে লম্বা হাতাওয়ালা মোটা জাম্পার।
লোকটাকে লোকাল বাসের কন্ডাক্টর মনে হচ্ছে না। কোনো মলম-টলম বিক্রির হকার হলে মানাত। লোকাল বাসে সিট পাওয়া বাঘের দুধ পাওয়ার চেয়েও কঠিন। বিশেষ করে অফিস আওয়ারে।
ভাগ্য বেশ প্রসন্ন। বাসে উঠেই সিট পেলাম। সিটে একজন হা করে ঘুমাচ্ছে। দুই পা দু' দিকে ছড়ানো। খালি সিটটাও তিনি প্রায় দখল করে ফেলেছেন।
হা-টা এত বড় যে, মশা-মাছি না; মুখের ভেতর আস্ত পাখ-পক্ষীও ঢুকে যেতে পারবে। দুই-একবার ডাকলাম। কোনো সাড়া নেই। নাক ডাকার ঘর ঘরাৎশব্দ আসছে। কন্ডাক্টরকে ডাকলাম। ঘুমন্ত যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল কন্ডাক্টর।
সিটে খানিকটা জায়গা বের হলো। কোনো মতো বসলাম। ধাক্কার পরও লোকটার ঘুমের কোনো ব্যাঘাত হলো না। আচ্ছা, লোকটাকে কি দুর্বৃত্তরা কিছু খাইয়ে অচেতন করে রেখেছে! কেমন যেন সন্দেহ তৈরি হলো।
পেছনের সিটে দুইজন তরুণ-তরুণী। হালকা স্বরে মিষ্টি গল্প করছে। তরুণীর নাক অবধি স্কার্ফে ঢাকা। এটা ধুলোবালি থেকে রেহাই পেতে নাকি পর্দা করার জন্য, জানি না।
তরুণী বলছে, 'আপনি অন্য মেয়েদের সঙ্গে দুষ্টামি করেন। সবাই বলে।'
আরে না, তেমন না। সবার সঙ্গে না।
- তো কার কার সঙ্গে?
-আপনার সঙ্গে একটু আধটু করি। অফিসের সেলসের কয়েকজন ঈর্ষা করে মনে হয়।
দুজন আপনা-আপনি করে সম্বোধন করছে। প্রথমে মনে হচ্ছিল প্রেমিক-প্রেমিকা। কিন্তু তা না। একটা ভালো সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কটা হয়ত আরও গাঢ় হতে পারে। হয়ত তারা এভাবে চলতে চলতে বলতে বলতে প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে উঠতে পারে। কোনো একদিন এমনই লোকাল বাসে উঠে এই দুজনকে যদি ফিসফিস করে 'তুমি' সম্বোধনে মিষ্টি গল্প করতে দেখি মন্দ হবে না। তেমন কী আর হবে নাকি!
কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা, টুপি টাক ঢাকার জন্য নাকি অরিজিনাল?
- 'কী কন মামা। টাক-টুক ঢাকার জন্য টুপি পরুম কেন। অরিজিনাল। আমার মইধ্যে ভেজাল নাই।'
পাশ থেকে এক যাত্রী খেঁকিয়ে ওঠে, হুম ফরহেজগার আসছে। বাটপার একটা। ৪০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা নিছে। আবার অরিজিনাল মারে। মিছা কথা কইতে কইতে ওর রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দেখেন না, এই গরমে কত বড় জাম্পার গায়দে আছে!
কন্ডাক্টরের এসব শোনার সময় নাই। সে ভাড়া কাটায় ব্যস্ত। বাসে দুই চার জন দাঁড়ানো যাত্রী। ফলে খুব বেশি ভিড় নেই। কেউ কেউ মোবাইল টিপছে। কয়েকজন বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে টেস্ট কাটাছেড়া করছে।
মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে বিসিবি সভাপতি পাপনকে ধুয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, লোকাল বাসের মধ্যে উনাকে পেলে কয়েক চোট হয়ে যেত!
ক্রিকেট থেকে গল্প পাপিয়ার দিকে মোড় নিচ্ছে। বনানী থেকে বাস যাচ্ছে সাতরাস্তার দিকে আর গল্প ঢুকে পড়েছে গুলশানের অভিজাত ওয়েস্টিন হোটেলে।
পাপিয়ারা কেন তৈরি হয়, তার খদ্দের কারা- এসব গবেষণা হচ্ছে। লোকাল বাসে এসব বিষয়ে ভালো গবেষকও মেলে!
আমার পাশে বসা লোকটা এতক্ষণে একবারও চোখ মেলল না। হা-ও বন্ধ করলো না। এত কিছুর মধ্যে তার ঘুমের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সন্দেহ তীব্র হচ্ছে, কোনো চক্রের ফাঁদে পড়েছি কি লোকটা?
ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়েছে কি? এর মধ্যে সামনের সিটের একজন লোকটাকে ডাকতে থাকলো, ওই মঈন উঠ। আইসা পড়লাম তো।
সামনের সিটের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনার কি কোনো সমস্যা হয়েছে। এরকম ঘুমায় ক্যান?
-না ভাই, সুমুস্যা নাই। হারারাত জাইগা কাজ করি তো। ঘুমানোর সুম হয় না।
- কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি, কী কাজ?
-'মিক্সার টানা। বিল্ডিংয়ের ঢালাই চলতাছে। সারারাত ধইরা কাম করছি।'
ফের হা করা মঈনের মুখের দিকে তাকায়। ধুলোমাখা পরিশ্রান্ত মুখ। ওই মুখে তাকিয়ে মায়া লাগে।
এই শহরে পাপিয়ারা কত সহজে কোটি কোটি টাকা কামায়। অথচ মঈনদের কটা টাকা রোজগার করতে দিন-রাত এক হয়ে যায়। শরীরের রক্ত নুনা ঘাম হয়ে ঝরে পড়ে।
এত শ্রমের পরও কয়টা টাকাই বা মেলে। মঈন ঘুমাক। আমি আরও খানিকটা সরে গিয়ে তাকে আরও একটু জায়গা করে দেই। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় মনটা ভরে ওঠে, এরকম ঘুম কি টাকার পাহাড়ে শুয়ে থাকা মানুষগুলো দিতে পারে?
হাসান জাকিররের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন